ক্রিমিনাল মামলার ধারাবাহিক ধাপসমূহ
ক্রিমিনাল মামলার ধারাবাহিক ধাপগুলো জানা, একজন আইনজীবীর জন্য কতটা জরুরী তা আমরা ক্রিমিনাল/ফৌজদারী মামলার ধারাবাহিক স্তরসমূহ মনোযোগ সহকারে দেখলেই বুঝতে পারবো যে আসলে ক্রিমিনাল/ফৌজদারী মামলার জন্য ক্রিমিনাল/ফৌজদারী মামলার ধারাবাহিক ধাপগুলো জানা, একজন আইনজীবীর জন্য কতটা জরুরী।চলুন দেখে নেওয়া যাক ক্রিমিনাল/ফৌজদারী মামলার ধারাবাহিক ধাপসমুহঃ-
ফৌজদারী কার্যবিধি-১৮৯৮ ( The Code of Criminal Procedure-1898):-

ফৌজদারী কার্যবিধি আইন সর্ব প্রথম ভারত উপমহাদেশে ১৮৬১ সালে প্রণয়ন করা হয় । বিভিন্ন সময়ে ফৌজদারী কার্যবিধি সংশোধন ও সংযোজনের পর বর্তমান ফৌজদারী কার্যবিধি ১৮৯৮ সালের ২২ শে মার্চ প্রণয়ন করা হয় এবং ১ লা জুলাই ১৮৯৮ কার্যকর করা হয় যা আজ অবধি বিদ্যমান রয়েছে।ফৌজদারী কার্যবিধি হলো একটি পদ্ধতিগত আইন ( Procedural Law) ।
এই আইনে ফৌজদারী আদালতের গঠন এবং ক্ষমতা থেকে শুরু করে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নামে অভিযোগ দায়ের, আসামীকে গ্রেফতার, মামলার তদন্ত ,মামলা আমলে নেওয়া , অভিযোগ গঠন, সাক্ষ্য গ্রহণ, যুক্তিতর্ক উপস্থাপন, রায়, রায়ের বিরুদ্ধে আপীল ইত্যাদি সংক্রান্ত সকল নিয়ম কানুন আলোচনা করা হয়েছে।
১৮৬১ সালে সর্বপ্রথম ফৌজদারী কার্যবিধি ব্রিটিশ পার্লামেন্ট থেকে পাশ করা হয়।পরবর্তীতে ১৮৭২ এবং ১৮৮২ সালে ফৌজদারী কার্যবিধি সংস্কার করে, ভারতীয় ম্যাজিষ্ট্রেটদের প্রেসিডেন্সি শহরে বিচারিক ক্ষমতা দেওয়া হয়। পরবর্তীতে ফৌজদারী কার্যবিধি ১৮৯৮ সালে পুনরায় সংস্কার করে বর্তমানের আইনে বাংলাদেশে কার্যকর রয়েছে। যা ১৮৯৮ সালের ৫ নং আইন।
ফৌজদারী কার্যবিধি আইনের স্তর বিন্যাসঃ-
ফৌজদারী কার্যবিধি আইনের মোট ধারা রয়েছে ৫৬৫ টি এবং তফসিল[ Schedules] রয়েছে মোট ৫ টি তার মধ্যে ১ টি বাতিল করা হয়েছে।
ফৌজদারী কার্যবিধির ৪ টি তফসিল সমুহঃ-
১ম তফসিল বাতিল করা হয়েছে।দ্বিতীয় তফসিলে পেনাল কোডের অপরাধ সমুহ কোন আদালত কর্তৃক বিচারযোগ্য, আমোলযোগ্য এবং আমোলঅযাগ্য অপরাধ, জামিনযোগ্য এবং জামিন অযোগ্য অপরাধ ইত্যাদি উল্লেখ করা রয়েছে।তৃতীয় তফসিল ম্যাজিস্ট্রেটগণের সাধারণ ক্ষমতা সমূহ উল্লেখ করা হয়েছে । চতুর্থ তফসিলে ম্যাজিস্ট্রেটগণের উপর আরোপযোগ্য অতিরিক্ত ক্ষমতা সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে এবং ৫ম তফসিলে বিভিন্ন ফরম সমূহ দেওয়া রয়েছে।
ফৌজদারী কার্যবিধিতে মোর্ট ৫৬৫ টি ধারা থাকলেও ১১৭ টি ধারা বাতিল করে দেওয়া হয়েছে । বর্তমানে ফৌজদারী কার্যবিধিতে ৪৭৩ টি ধারা বলবৎ আছে।সর্বশেষ ফৌজদারী কার্যবিধি সংশোধন করা হয়েছে ২০১২ সালে।
ফৌজদারী মামলা দায়েরঃ-
ফৌজদারী মামলা দুই ভাবে দায়ের করা যায়ঃ- (১) ম্যাজিস্ট্রিটের নিকট অভিযোগ( Complaint) দায়ের করার মাধ্যমে।
(২) পুলিশের নিকট প্রাথমিক তথ্য বিবরণী/এজাহার ( First Information Report (FIR) এর মাধ্যমে ।
- (Complaint) হলো জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রিটের নিকট অভিযোগ( Complaint) দায়ের/মামলা দায়ের করাকে বুঝায়।
- ফৌজদারী কার্যবিধির ১৫৪ ধারায় পুলিশ প্রাথমিক তথ্য বিবরণী লিপিবদ্ধ করেন।আমোলযোগ্য মামলার অপরাধ সমুহ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নিকট দিতে হয়।
জি আর( GR Case)/ পুলিশ মামলার ধাপসমূহঃ-
ফৌজদারী কার্যবিধির ১৫৪ ধারা অনুসারে পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নিকট First Information Report ( F.I.R) দাখিল করতে হয়। ১৫৬ ধারা অনুসারে পুলিশ তদন্ত করবে এবং ১৬১ ধারা অনুসারে পুলিশ অফিসার সাক্ষীদেরকে পরীক্ষা করবে।অভিযুক্ত দোষ স্বীকার করতে চাইলে ১৬৪ ধারানুসারে ম্যাজিস্ট্রেট তা লিপিবদ্ধ করবেন।১৭৩ ধারানুসারে পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট অভিযোগপত্র/চার্জশীট দিবেন অথবা অভিযোগ প্রমাণিত না হলে Final Report ( চুড়ান্ত রিপোর্ট ) দিবেন।
পুলিশ অফিসার চুড়ান্ত রিপোর্ট দিলে ম্যাজিস্ট্রেট আসামীকে অব্যাহতি দিবেন অথবা ম্যাজিস্ট্রেট পুনরায় তদন্তের নির্দেশ দিবেন।তবে মনে রাখতে হবে অব্যাহতি আর খালাস এক জিনিস নয় নিম্নে সে সম্পর্কে সংক্ষিপ্তভাবে আলোচনা করা হলো্ঃ-
অব্যাহতি ও খালাস এর মধ্যে পার্থক্যঃ-

(Discharge) অব্যাহতিঃ
আদালত মামলার নথি, দাখিলকৃত দলিলাদি এবং তৎসম্পর্কে আসামী ও অভিযোগকারী পক্ষের বক্তব্য শুনার পর আদালত যদি মনে করেন যে, আসামীর বিরুদ্ধে মামলা চালাবার যথেষ্ট কোনো কারণ নাই, তাহলে আদালত ফৌজদারী কার্যবিধি ধারা- ২৬৫(গ) ধারানুসারে আসামীকে মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়ে দিবেন এবং তার কারণ লিপিবদ্ধ করে রাখবেন।
(Acquittal) খালাসঃ
আদালত অভিযোগকারী পক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণ, আসামীর জবানবন্দি গ্রহণ এবং বিষয়টি সম্পর্কে অভিযোগকারী পক্ষ ও আসামী পক্ষের বক্তব্য শ্রবণ করার পর আদালত যদি মনে করেন যে, আসামী অপরাধ করেছে বলে কোন সাক্ষ্য প্রমান নাই, তাহলে আদালত ফৌজদারী কার্যবিধি ধারা- ২৬৫(জ) ধারানুসারে আসামীকে খালাস করে দেবেন এবং তা লিপিবদ্ধ করে রাখবেন।
তাহলে মনে রাখতে হবে অব্যাহতির ক্ষেত্রে শুধু অনুসন্ধান করা হয়, বিচার কার্যক্রম শুরু করা হয় না। যদি অব্যাহতির পর নতুন সাক্ষ্য প্রমান উদঘাঁটিত হয়, তাহলে আসামীর বিরুদ্ধে পুনরায় অভিযোগ ঘটন করা যায়।কিন্তু অন্যদিকে কোন আসামীকে বিচারে খালাস প্রদান করা হলে, পুনরায় তার বিরুদ্ধে একি অপরাধের অভিযোগ গঠন করা যায় না। অব্যাহতির আদেশ আদালতের কোন রায় নয়। কিন্তু খালাসের আদেশ আদালতের একটি পূর্নাঙ্গ রায়।
(Bail) জামিন বা মুক্তিঃ

জামিন বা মুক্তি আপনি যে কোন সময় পেতে পারেন । আসামী যদি আদালতকে বিশ্বাস যোগ্য কারণ দেখাতে পারেন এবং আদালত যদি মনে করেন আসামী কে জামিন দেয়া যায় তাহলে মামলা চলাকালীন অবস্থায় আসামী কে কারাগারে না রেখে জামিন বা মুক্তি দিতে পারে । অনেক সময় আদালত আসামী কে শর্ত বা লিখিত বন্ডের মাধ্যমে জামিন বা মুক্তি দিয়ে থাকে যা ফৌজদারী কার্যবিধি ধারা- ৪৯৬-৪৯৮) আলোচনা করা হয়েছে।
ফরিয়াদী যদি মনে করেন পুলিশ অফিসার তদন্ত রিপোর্টের মধ্যে ভুল তথ্য দিয়েছে অথবা তদন্ত যথাযথভাবে হয় নাই তাইলে ফরিয়াদী উক্ত চুড়ান্ত রিপোর্ট (Final Report) এর বিরুদ্ধে ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট নারাজি দরখাস্ত/ নারাজি পিটিশন দাখিল করবেন এতে ম্যাজিস্ট্রেট সন্তুষ্ট হলে পুলিশ অফিসারকে মামলার তদন্তভার আরো ভালো ভাবে তদন্তের নির্দেশ দিবেন।
আদালত চাইলে ফরিয়াদীর নারাজি পিটিশন বা নারাজি দরখাস্ত ছাড়াও যদি আদালতের কাছে মনে হয় মামালা পুনরায় তদন্ত করা প্রযোজন / ( Further Investigation) করা প্রয়োজন তাহলে মাজিস্ট্রেট পুনরায় পুলিশ অফিসারকে তদন্তের নির্দেশ দিবেন এমনকি আসামী রিমান্ড শেষ হবার পরেও আদালত আসামীকে পুনরায় রিমান্ডে নিয়ে পুলিশ অফিসারের মাধ্যমে পুনরায় মামলার তদন্ত চলামান রাখতে পারবে।
১৯০ ধারানুসারে ম্যাজিস্ট্রেট মামলা আমলে নেবেন এবং যদি মামলাটি নিয়ে অগ্রসর হবার পযাপ্ত কারণ থাকে তাহলে ম্যাজিস্ট্রেট ২০৪ ধারানুসারে অভিযুক্তকে আদালতে হাজির হবার জন্য সমন বা পরোয়ানা দেবেন।
অভিযুক্ত ব্যক্তি হাজির হবার পর আদালত মামলার নথি ও দলিয়াদি বিবেচনা করে ম্যাজিস্ট্রেট যদি মনে করেন যে উক্ত অভিযুক্ত ব্যক্তি অপরাধটি করতে পারে তাহলে ২৪২ ধারা অনুসারে আনুষ্ঠানিক চার্জ গঠন করবেন এবং অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করবেন সে অপরাধটি স্বীকার করবেন কি না?
যদি ম্যাজিস্ট্রেট নথি ও দলিয়াদি বিবেচনা করে মনে করেন যে, অভিযোগটি ভিত্তিহীন তাহলে ম্যাজিস্ট্রেট অভিযুক্তকে ২৪১(ক) ধারা অনুসারে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে অব্যাহতি দিবেন।
ম্যাজিস্ট্রেট অভিযুক্ত ব্যক্তিকে অভিযোগ স্বীকারের কথা জিজ্ঞাসা করার পর যদি অভিযুক্ত ব্যক্তি অপরাধটি স্বীকার করে তাহলে ম্যাজিস্ট্রেট ২৪৩ ধারানুসারে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করে শাস্তি দিবেন।
আর যদি অভিযুক্ত ব্যক্তি অপরাধটি স্বীকার না করেন তবে ম্যাজিস্ট্রেট মামলার পরবর্তি ধাপ/পর্যায়ে অগ্রসর হবেন।
সি আর (CR Case)/ নালিশি মামলার ধাপসমূহঃ-

ফৌজদারী কার্যবিধির ১৯০ ধারানুসারে নালিশি মামলা/CR Case দাযের করতে হয়।এরপর ম্যাজিস্ট্রেট মামলার শুরুর প্রথম ধাপেই ২০০ ধারানুসারে ফরিয়াদী/বাদীর উপস্থিতিতে সকল সাক্ষীর মধ্যে কয়েকজনকে উপযুক্ত মনে করে শপথ বাক্য পাঠ পূর্বক জবানবন্দী গ্রহণ ও লিপিবদ্ধ করবেন। এরপর ম্যাজিস্ট্রেট আসামীকে তলব দিতে পারেন বা ২০২ ধারা অনুসারে তদন্তের নির্দেশ দিতে পারেন।
অথবা ম্যাজিস্ট্রেট যদি মনে করেন নালিশ/মামলা/ অভিযোগটি ২০৩ ধারানুসারে খারিজ করে দিতে পারেন।তবে নালিশ/মামলা/অভিযোগটি খারিজ করার আগে ফরিয়াদী/বাদী বা তার আইনজীবী/বিজ্ঞ কৌশুলীকে শুনানীর সুযোগ দিতে হবে।
ম্যাজিস্ট্রেট নালিশ/মামলা/অভিযোগটি খারিজ না করলে ২৪১ ধারা হতে ২৪৯ ধারার বিধান মতে বিচারকার্য সম্পন্ন করবেন।
পরিশেষে বলতে চাই ক্রিমিনাল মামলার ধারাবাহিক ধাপগুলো আপনি রেগুলার সিনিয়ার আইনজীবীর সাথে কোর্ট প্রাকটিস করলেই শিখে যাবেন। এর জন্য আপনাকে প্রতিনিয়ন আপনার বিজ্ঞ সিনিয়রের সাথে প্রশিক্ষণ গ্রহন করতে হবে এবং আইন অঙ্গনে বা কোর্ট চত্তরে আপনার বিচরন থাকতে হবে। প্রাকটিক্যাল বিষয়গুলো আপনার সিনিয়র কিভাবে এ্যাপলাই করছে সেটা লক্ষ্য রাখুন। দেখবেন আপনার দীর্ঘ পরিশ্রমের ফলে আপনি একদিন একজন বিজ্ঞ ক্রিমিনাল প্রাকটিনার আইনজীবী ( Criminal Counselor Lawyer ) হয়ে উঠবেন।ধন্যবাদ

লেখকঃ ল ফর ন্যাশনস, ইমেইলঃ lawfornations.abm@gmail.com, মোবাইল: 01842459590.
সিভিল মামলা কাকে বলে? সিভিল মামলার ক্রমবিকাশ! সম্পর্কে জানতে ক্লিক করুন
আইন কি? আইন সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা সম্পর্কে আরও বিস্তারিত পড়ুন
দেওয়ানী মামলার ধাপ সম্পর্কে আরও জানুন
ক্রিমিনাল মামলার ধারাবাহিক ধাপগুলো সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে পড়ুন
Discussion about this post