হবিগঞ্জ প্রতিনিধি
তথ্য জালিয়াতির মাধ্যমে আদালতকে বিভ্রান্ত করে দুই মাদককারবারীর জামিন মঞ্জুর করিয়েছেন কুতুব উদ্দিন জুয়েল নামে এক আইনজীবী। ৮ এপ্রিলের ঘটনাকে অবলীলায় ৯ ফেব্রুয়ারি বলে চালিয়ে দিয়েছেন তিনি। অভিনব এ প্রতারণার ঘটনাটি ঘটেছে হবিগঞ্জের ভারপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে।
আইনজীবীর এমন কান্ডে আদালত পাড়ায় শুরু হয়েছে তোলপাড়। এদিকে, ঘটনাটি ধামাচাঁপা দিতে দৌড়ঝাঁপ করছেন ঢাকা ও হবিগঞ্জের কতিপয় প্রভাবশালী ব্যক্তি।
আদালত সূত্র জানায়, গত ৮ এপ্রিল মাধবপুর উপজেলার জগদীশপুর মুক্তিযোদ্ধা চত্তর এলাকা থেকে ৫০ বোতল ফেন্সিডিলসহ মামুন ভূইয়া (৩৭) ও নবীর হোসেন (৩২) নামে দুই মাদককারবারীকে আটক করে পুলিশ। পরে তাদের মাদক আইনে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে প্রেরণ করা হয়।

গত ২৭ মে কুতুব উদ্দিন জুয়েল (আসামীদের দ্বিতীয় আইনজীবী) নামে আইনজীবী ভারপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ নাসিম রেজার আদালতে তাদের জামিন প্রার্থনা করেন। এ সময় তিনি আদালতকে জানান, আসামীরা ৯ ফেব্রুয়ারী থেকে কারাগারে হাজতবাসে রয়েছে। আদালত তখন হাজতবাসের সময় বিবেচনা করে তাদের জামিন মঞ্জুর করেন।
জামিনপ্রাপ্ত আসামী মামুন ভূইয়া নারায়নগঞ্জ জেলার সোনারগাঁ থানার গোয়ালদী গ্রামের হাবিবুর রহমান ভূইয়ার পুত্র ও অপর আসামী নবীর হোসেন নরসিংদীর জেলার মাধবদী থানার মৃত নুর হোসেনের পুত্র।
এ বিষয়ে আসামীদের প্রথম আইনজীবী মিজানুর রহমান অভিযোগ করে বলেন, ‘গত ১২ মে শুধুমাত্র আসামী মামুন ভূইয়ার জামিন প্রার্থনা করি । এ সময় সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট পবন চন্দ্র বর্মন তা না’মঞ্জুর করেন।
গত ২৩ মে আসামীদের স্বজনরা আমার কাছ থেকে মামলাটি এডভোকেট কুতুব উদ্দিন জুয়েলের কাছে হস্তান্তর করেন। পরে ২৭ মে ভারপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে মিস কেইস শুনানির মাধ্যমে আসামীদের জামিন মঞ্জুর করানো হয়। জামিন আবেদনে তথ্য জালিয়াতির মাধ্যমে উল্লেখ করা হয়, ‘আসামীরা গত ৯ ফেব্রুয়ারী থেকে কারাগারে হাজতবাসে রয়েছে।’
আসামীদের প্রথম আইনজীবী মিজানুর রহমান আরো বলেন, ‘খোঁজ নিয়ে জানতে পারি ১২ মে না’মঞ্জুরের নকল দিয়েই না-কি মিস কেইস করা হয়েছে। কিন্তু ১২ মে আমি শুধুমাত্র একজনের জামিন প্রার্থনা করেছিলাম। দুইজনের জন্য সেই নকল দিয়ে মিস কেইস করার কোন সুযোগ থাকার কথা নয়। এখানে স্পষ্ট জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে।
আমি বিষয়টি বারের সভাপতিকে জানিয়েছি। কিন্তু অনেক সিনিয়র নেতৃবৃন্দ ও ঢাকার এডভোকেট আমিন উদ্দিনসহ অনেকেই অভিযোগ না করার কথা বলেন। তবে আমি ন্যায় বিচারের স্বার্থে অবশ্যই বার ও আদালতসহ সংশ্লিষ্ট সবস্থানেই অভিযোগ দায়ের করব।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক তরুণ আইনজীবী বলেন, ‘জেলা ও দায়রা জজ মহোদয় করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে মিস কেইস শুনানী করেন অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ নামিস রেজা মহোদয়। তিনি জামিনের বিষয়ে অত্যন্ত কঠোর। তাই ৫০ বোতল ফেন্সিডিল নিয়ে আটক দুই মাদক কারবারীকে দ্রুত জামিন দেয়ার কথা নয়। কারণ, তার আদালতে ১০ বোতল ফেন্সিডিলের মামলায়ও ২/৩ মাসের মধ্যে কোন আসামীর জামিন হয়না।
তথ্য জালিয়াতির মাধ্যমে প্রায় দেড় মাসের হাজতবাসকে পৌনে চার মাস দেখানো হয়েছে। তদন্ত করলেই প্রকৃত সত্য বেড়িয়ে আসবে।’
এ ব্যাপারে হবিগঞ্জের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) এডভোকেট সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বিষয়টি সম্পর্কে অবগত নন বলে জানান। জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি এডভোকেট আবুল মনসুরের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘এখনও কোন লিখিত অভিযোগ পাইনি। মৌখিক কথায় কিছু বলা সঠিক হবে না।’
অভিযুক্ত এডভোকেট কুতুব উদ্দিন জুয়েলের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘মূল নথিতে আসামীদের হাজতবাসের মেয়াদ দুই মাস ছিল, আমরা সেই সময়ই উল্লেখ করেছি। কোন ভূয়া তথ্য দেইনি। আদালত হাজতবাস বিবেচনা করেই জামিন মঞ্জুর করেছেন।’
আদালতের সাথে জালিয়াতির ঘটনায় এডভোকেট কুতুব উদ্দিন জুয়েলকে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারির প্রেক্ষিতে দিদার এলাহী সাজু গণমাধ্যমে প্রকাশ করেন শুধু আদালত পাড়া নয়, আইনজীবির তথ্য জালিয়াতির কান্ডটি এখন ‘টক অব দ্যা টাউন।
শুধু আদালত পাড়া নয়, আইনজীবির তথ্য জালিয়াতির কান্ডটি এখন ‘টক অব দ্যা টাউন।গণমাধ্যমে সংবাদটি প্রকাশের পর বিষয়টি নিয়ে পুরো শহর জুড়েই চলছে তোলপাড়। এদিকে, সংবাদ প্রকাশের পর তথ্য জালিয়াতির মাধ্যমে ‘ভাগিয়ে নেয়া জামিন’ বাতিল করেছে সংশ্লিষ্ট আদালত। শুধু তাই নয়, জামিন প্রাপ্ত আসামীর বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারির নির্দেশসহ অভিযুক্ত আইনজীবির বিরুদ্ধে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করা হয়েছে।
আদালত সূত্র জানায়, আইনজীবির তথ্য জালিয়াতির বিষয় নিয়ে গতকাল বুধবার দৈনিক হবিগঞ্জ এর স্থানীয় পত্রিকায় অনুসন্ধানী সংবাদ প্রকাশের পর আদালত পাড়ায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। পত্রিকার নিয়মিত কপি বিক্রির পর অনেকেই ফটোস্ট্যাট কপি সংগ্রহ করেন। নজিরবিহীন এমন ঘটনায় বিচারক আইনজীবিসহ সংশ্লিষ্ট সকলের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে ক্ষোভ।
সূত্র জানায়, পত্রিকার সংবাদটি প্রকাশের পর ভারপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ নাসিম রেজা তথ্য জালিয়াতির মাধ্যমে জামিন প্রাপ্ত মাদক মামলার আসামী নবির হোসেন (৩২) এর জামিন বাতিলসহ তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারির জন্য সংশ্লিষ্ট আদালতকে নিদের্শ প্রদান করেন।
এছাড়াও অভিযুক্ত আইনজীবি কুতুব উদ্দিন জুয়েলের বিরুদ্ধে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করেন। নোটিশে ৩ দিনের মধ্যে তথ্য জালিয়াতির বিষয়ে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। এদিকে, তথ্য জালিয়াতির বিষয়ে পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশের পর শুধু আদালত পাড়া নয়, বিষয়টি নিয়ে পুরো শহরে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। এটিই এখন ‘টক অব দ্যা টাউন’।
Discussion about this post