বাংলাদেশে মানবাধিকার
বাংলাদেশের সংবিধান আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সকল মানবাধিকার ও সুশাসন নিশ্চিতকরণ, রাষ্ট্রীয় মৌলিক নীতির বাস্তবায়ন ও মৌলিক অধিকার রক্ষায় নিশ্চয়তা বিধান করেছে। তবে, একই সংবিধানে অগণিত গণতন্ত্রবিরোধী আচরণ গ্রহণে এ সকল অধিকারকে অস্বীকার করে চলেছে।
মোঃ শরিফুল ইসলামের বক্তব্য ২০০৫ সালে বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে রাজনৈতিক অস্থিরতার ন্যায় অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতার তিক্ত স্বাদ আস্বাদন করে। ১৭ আগস্ট, ২০০৫ তারিখে দেশের চৌষট্টি জেলায় একযোগে চার শতাধিক বোমা বিস্ফোরিত হয়েছিল। ফলশ্রুতিতে এই অস্থিরতা ও এর জাতীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থায় বিঘ্ন সৃষ্টির ফলে বাংলাদেশে মানবাধিকার অবনতিতে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়।
বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীকে অনবরত অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও হিউম্যান রাইটস্ ওয়াচের কাছ থেকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে সমালোচনার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। তন্মধ্যে, বিচারবহির্ভূত সংক্ষিপ্ত সময়ে মৃত্যুদণ্ড প্রদান, ক্ষমতার অপব্যবহার ও হেফাজতকালীন নির্যাতন অন্যতম। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রতিবেদক ও মানবাধিকার কর্মীদেরকে হয়রানি ও কর্তৃপক্ষের হুমকি-ধামকির সম্মুখীন হতে হয়েছে।
২০০৩ সাল থেকে ন্যায়বিচারে আইনগত বাঁধা ও নিরাপত্তা বাহিনীর জবাবদিহিতার স্বচ্ছতার বিষয়ে সাধারণ জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা দূরত্ব সৃষ্টি করছে।
হিন্দু ও আহ্মদীয়া মুসলিম সংখ্যালঘু সম্প্রদায় সমঝোতামূলক রাষ্ট্রে অবস্থান করছে ও দুর্নীতি অদ্যাবধি প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরফলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে পাঁচ বছর বিশ্বের সর্বাপেক্ষা দুর্নীতিগ্রস্ত রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে তালিকাভুক্ত রেখেছিল।
নির্যাতন
র্যাব (র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ান) ও অন্যান্য নিরাপত্তা সংস্থাকে হেফাজতকালীন ও জিজ্ঞাসাবাদকালে নির্যাতন চালানোর বিষয়ে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এ ধরনের একটি অভিযোগ এসেছে ঢাকায় এক বৃদ্ধকে সাদা পোশাকধারী র্যাব সদস্যরা শারীরিকভাবে নির্যাতনের বিষয়ে প্রতিবাদ করলে এক যুবককে গ্রেফতার করা হয়।
পরবর্তীতে তিনি গুরুতরভাবে নির্যাতনের শিকার হন।২৭ জুলাই, ২০০৫ তারিখে রাজশাহীর অধিবাসী দুই ভাই আজিজুর রহমান সোহেল ও আতিকুর রহমান জুয়েলকে মিথ্যা অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রেফতারপূর্বক ব্যাটন দিয়ে লাঠিপেটা ও বৈদ্যুতিক শক দিয়ে স্বীকারোক্তি আদায় করে।[৭] জানা যায় যে, তাদের এই বর্বরতার পিছনে অসামঞ্জস্যপূর্ণ ঘুষের অর্থ পরিবারের কাছে দাবী করা হয়েছিল। ভাইদের উপর এতোটাই নির্যাতন করা হয়েছিল যে তাদেরকে পুলিশী হেফাজতে থেকে রাজশাহী মেডিকেল স্কুল হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে।
বাংলাদেশে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য নির্যাতন চলে মে, ২০০৭ সালে যা তাসনিম খলিল নামের এক সাংবাদিক ও ব্লগারের উপর শারীরিক নির্যাতন মামলার বিষয়ের সাথে জড়িত ছিল। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে ডিরেক্টরেট জেনারেল অফ ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্সের (ডিজিএফআই) হেফাজতে থাকাকালে তিনি নির্যাতনের শিকার হন ও মুক্তির পর হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এক প্রতিবেদনে এ সম্পর্কে লিখেন।বাংলাদেশ থেকে চলে আসার পর সুইডেন সরকার তার নিরাপত্তার দায়িত্ব নেয়।

নিখোঁজ বা গুম এর পটভুমি:-
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সময়ে বাংলাদেশে গুমের প্রথম ঘটনাগুলো ঘটে। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের অনেক সদস্য, সেনা অফিসার এবং অন্যান্য বিরোধী দলীয় সদস্যদের, শেখ মুজিবুর রহমানের দ্বারা গঠিত একটি অভিজাত আধা সামরিক বাহিনী জাতীয় রক্ষীবাহিনী তুলে নিয়ে যায়।
বর্তমানে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন গঠনের মাধ্যমে এমন ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক ৪০২ জন ব্যক্তি গুমের শিকার হয়েছেন।
২০০৯ সালে নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে থাকে। বিরোধী দলের সদস্যরা ক্ষমতাসীন দলের লোকজনদের মাধ্যমে আক্রমনের শিকার হয়। এতে বেশ কয়েকজন বিরোধী দলীয় সদস্য নিহত এবং আরও অনেকে আহত হয়। সারা দেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সশস্ত্র সংঘাত ও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে।
বিরোধী দলগুলোর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে প্রায়শই আক্রমণ করা হত। ২০১০ সাল থেকে, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাসমূহের দ্বারা বিরোধী দলীয় নেতা কর্মীদের তুলে নেয়ার বিষয়টি দেশে তীব্রতর হতে শুরু করে।
প্রাক-নির্বাচনী সময়কাল, ২০১৩
২০১৩ সালের বেশিরভাগ সময়জুড়ে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং তাদের জোট, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্দলীয় নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট ও অবরোধ পালন করে।
নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে ইইউ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কমনওয়েলথ ঘোষণা করে যে তারা পর্যবেক্ষক প্রেরণ করবে না। ২০১৪ সালের বিতর্কিত জাতীয় নির্বাচনের আগে, বিরোধী দলটির ২০ জন ব্যক্তিকে নিরাপত্তা বাহিনী তুলে নিয়ে যায়।২০১৬ সাল পর্যন্ত, তারা নিখোঁজ রয়েছেন।
২০১৪ থেকে জুলাই ২০১৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ৩৪৪ জন ব্যক্তি গুমের শিকার হয়। তাদের মধ্যে ৪০ জন ব্যক্তিকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়, ৬৬ জনকে সরকারি হেফাজতে গ্রেপ্তার অবস্থায় পাওয়া গেছে এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যমতে ২০৩ জন এখনও গুম রয়েছেন। যারা দীর্ঘদিন গুম থাকার পর ফিরে আসেন, তারা গুমের ব্যাপারে মৌনতা অবলম্বন করেন।
উল্লেখযোগ্য ঘটনাসমূহঃ-
এম ইলিয়াস আলী
২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল, প্রধান বিরোধী দল বিএনপির বিশিষ্ট নেতা ইলিয়াস আলি মধ্যরাতে ঢাকা হতে তার ড্রাইভারসহ নিখোঁজ হন। তার নিজস্ব গাড়িটি ঢাকায় তার বাড়ির কাছে পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। পরবর্তীতে, নিখোঁজের প্রতিবাদে ধর্মঘট ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করায় তার দলের পাঁচ জন নিহত হন এবং অনেকে আহত হন। ঘটনাটি সংবাদ মাধ্যমে ব্যাপক প্রচার লাভ করে।
আমিনুল ইসলাম
আমিনুল ইসলাম, বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সদস্য এবং বাংলাদেশ সেন্টার অফ ওয়ার্কার সলিডারিটির একজন সংগঠক ছিলেন। ৫ এপ্রিল ২০১২ সালে, ঢাকার অদূরে তাঁর মৃতদেহ পাওয়া যায়। এর আগের দিন তিনি নিখোঁজ ছিলেন। তার শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন পাওয়া যায়। তার গুম ও হত্যা অনেক আন্তর্জাতিক সমালোচনার জন্ম দেয়।
আমান আজমি, মীর আহমদ ও হুম্মাম চৌধুরী
২০১৬ সালের আগস্ট মাসে, তিন বিরোধীদলীয় নেতার সন্তানদের আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অজ্ঞাত স্থানে তুলে নিয়ে যায়। তারা ছিলেন গোলাম আযমের পুত্র, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহিল আমান আজমি, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পুত্র, হুম্মাম কাদের চৌধুরী এবং মীর কাসেম আলীর পুত্র, মীর আহমেদ বিন কাসেম।আমান আজমিকে তার বাসা থেকে পরিবারের সদস্যদের সামনেই তুলে নেয়া হয়েছিল।
তিনটি ক্ষেত্রেই একাধিক সাক্ষী থাকা সত্ত্বেও পুলিশ তাদের গুম হবার ব্যাপারে সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করে।জাতিসংঘ এই তিন ব্যক্তির অপহরণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে এবং শেখ হাসিনার সরকারকে দেশে ক্রমবর্ধমান গুমের ঘটনা তদন্ত করার আহ্বান জানায়। হুম্মাম কাদের চৌধুরী ২০১৭ সালের মার্চ মাসে ঘরে ফিরে আসেন এবং বলেন যে কারা তাকে গ্রেফতার করেছিল তা তিনি “মনে করতে পারছেন না”। এখন পর্যন্ত আমান আজমি ও মীর আহমদের কোন হদিস পাওয়া যায়নি।
সুখরঞ্জন বলি
অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধী দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর পক্ষে সাক্ষ্য দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ায়, ৫ নভেম্বর ২০১২ সালে সুপ্রীম কোর্টের গেট থেকে সুখরঞ্জন বলিকে সাদা পোষাকের পুলিশ অপহরণ করেছিল। পরবর্তীতে তাকে কলকাতার দমদম কারাগারে পাওয়া যায়।
উইকিপিডিয়া বলছে:-
বাংলাদেশে গুম হওয়া বলতে বাংলাদেশ সরকারের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদদে কোন ব্যক্তির নিখোঁজ হওয়াকে বুঝানো হয়। ঢাকা ভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের তথ্য মতে, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে ২০০৯ হতে ২০১৭ সাল পর্যন্ত কমপক্ষে ৪০২ জন মানুষ গুম হয়েছেন।
বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ এইসব ঘটনার জন্য জাতিসংঘ ও বিভিন্ন মানবাধিকার রক্ষাকারী সংস্থা, যেমন, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ সরকারকে নিন্দা জানিয়েছে।এইসব ঘটনার অধিকাংশের জন্য বাংলাদেশের একটি আধা সামরিক বাহিনী র্যাপিড একশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) কে দায়ী করা হলেও, র্যাব এইসব অভিযোগ কখনও স্বীকার করেনি। ভুক্তভোগীরা পুলিশ হেফাজত থেকে মুক্ত হয়ে ফিরে এলেও আওয়ামী লীগ সরকার গুম হবার পেছনে তাদের সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৮২ জন গুম হয়। ভুক্তভোগীদের অধিকাংশই ছিল বিরোধী দলের নেতাকর্মী। গুম হওয়ার পরে, নিহতদের মধ্যে কমপক্ষে ৪৯ জন মারা গেছেন এবং অন্যরা নিখোঁজ রয়েছেন।বিতর্কিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন, ২০১৪’র আগে কমপক্ষে ২০ জন বিরোধী দলীয় নেতা কর্মীকে নিরাপত্তা বাহিনী সদস্যরা তুলে নেয়। ২০১৬ সাল পর্যন্ত কমপক্ষে ৮৯ জন লোক নিখোঁজ হয়েছে।
২০১৬ সালে রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনরা সরকারকে তাদের প্রিয়জনের হদিস বের করে দিতে মায়ের ডাক নামে একটি মঞ্চ গঠন করে।

নিখোঁজ এর সংজ্ঞা:-
খোঁজ পাওয়া যায় না এমন, নিরুদ্দেশ (লোকটা কী করে নিখোঁজ হয়ে গেল প্রশ্ন থেকেই যায় যে, সাধারণ নিখোঁজ আর পরিকল্পিত নিখোঁজ আমার কাছে মনে হয়েছে দু্ইটা আলাদা শব্দ।
ব্লাস্ট এর নির্বাহী পরিচালক ব্যরিস্টার সারা হোসেন বলেন, “উচ্চ আদালতের নির্দেশনায় এমনো কথা রয়েছে যে একজনকে গ্রেপ্তার করার পরপরই তার স্বজনকে তার পরিবারের কাউকে অথবা তাদের কাউকে না পাওয়া গেলে গ্রেপ্তার করা ব্যক্তির চিহ্নিত করা তার কোনো বন্ধুকে জানাতে হবে যে তাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং কোথায় রাখা হয়েছে।”
“পাশাপাশি তাকে কখন গ্রেপ্তার করা হয়েছে আর কোথা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এগুলিও জানাতে হবে। আমার জানা মতে এ দিকনির্দেশনাগুলো অনেক ক্ষেত্রেই ঠিকমতো পালন করা হচ্ছে না এবং গুম সম্পর্কিত আমরা যে তথ্য পাই সেই ক্ষেত্রে পালন করা হয়েছে তাতো মনে হয় না। পালন হলে তো গুম পর্যন্ত ঘটনাটা যেত না” বলছেন সারা হোসেন।
মানবাধিকার কর্মীদের মতে গুমের আতঙ্ক মানুষের মধ্যে ভয়াবহ ত্রাস সৃষ্টি করেছে। অনেকের মতে বিনা পরোয়ানায় আটকের ক্ষেত্রে ২০১৬ সালে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা মানলে পরিস্থিতির উন্নতি হতো।
পরিসংখ্যান বলছে ২০১৬ সালে বাংলাদেশে গুম হয়েছেন অন্তত ৯৭জন, বাংলাদেশে সাত বছর আগে ২৭শে এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ থেকে শহরের কাউন্সিলর ও আইনজীবী-সহ মোট সাতজন নিখোঁজ হয়েছিলেন। র্যাব পরিচয়ে ধরে নিয়ে যাওয়ার কয়েকদিন পর তাদের মৃতদেহ পাওয়া যায়।
বাংলাদেশে হাই প্রোফাইল ব্যক্তিবর্গ, রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, পেশাজীবী, শিক্ষকসহ সব শ্রেণী-পেশার মানুষই গুমের শিকার হয়েছে।
গুম প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পুলিশের মিডিয়া ও পাবলিক রিলেশনস বিভাগের এআইজি সহেলি ফেরদৌস বলেন, তদন্ত করে দেখা যাচ্ছে ভুয়া পরিচয়ে এরকম অপহরণ করা হচ্ছে।
তার কথায়, “যখন কোনো অভিযোগ আসছে যে এরকম তুলে নিয়ে গেছে পুলিশের পরিচয়ে এবং থানার কাছে যখন আসে অবশ্যই ব্যাপারটিকে আমরা ভেরিফাই করি যে ঘটনা সত্যি ছিল কিনা, পুলিশের ইনভলমেন্ট ছিল কিনা অথবা পুলিশ পরিচয়ে কেউ কিছু করছে কিনা।”
“প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে যে পুলিশ জড়িত, সেটা নয়। পাবলিক যখন এই অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ে তখন তারা কিন্তু হয় পুলিশ, না-হয় বা র্যাবের নামে মানুষকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে ইউনিফরমে অপহরণের থেকে বেশি সমস্যা হচ্ছে সাদা পোশাকে ডিবি পরিচয়ে” বলছিলেন সহেলি ফেরেদৗস।
তিন বছর আগের ওই ঘটনায় জড়িত র্যাব কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্টদের সাজা হলেও দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে নিরাপত্তা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ এবং গুমের ঘটনা কমছে না।২০১৫ সালে এই সংখ্যা ৫৫ জন ছিল এবং ২০১৬ সালে সেটি বেড়ে ৯৭ জনে দাঁড়ায়। আর ২০১৭ সালের তিন মাসে গুমের ঘটনা ঘটে ২৫টি, যার মধ্যে মার্চেই ১৪টি।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক গুম পরিস্থিতি নিয়ে বলেন, “এমনও অভিযোগ আসছে যে সরকারি বাহিনীর লোকজনরা সিভিল ড্রেসে বা কখনো ইউনিফর্মে কখনো অন্যের ভাড়া করা গাড়িতে বা নিজেদের গাড়িতে করে তুলে নিয়ে আসছে। এই যে যারা গুম হয়ে যাচ্ছে তাদের অনেককে আবার ফেরতও পাওয়া যাচ্ছে না।”
“এটা মানবাধিকারের একটা চরম লঙ্ঘন। সেই কারণে মানবাধিকার কমিশনও অত্যন্ত উদ্বিগ্ন যে এই জাতীয় ঘটনা কেন গ্র্যাজুয়ালি (ক্রমাগত) বৃদ্ধি পাচ্ছে।”
আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এর জরিপে গত ১৪ বছরে ৬০৪ জনকে গুম করা হয়েছে বলে জানিয়েছে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। সব গুমের অভিযোগ তদন্তে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ কমিশন গঠন করার দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি। আসকের চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে শনিবার (২৯ আগস্ট) এই দাবি জানান।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ৩০ আগস্ট আন্তর্জাতিক গুম বা বলপূর্বক অন্তর্ধান প্রতিরোধ দিবস। এর আগে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) গুমের শিকার সব নিখোঁজ ব্যক্তিকে অবিলম্বে খুঁজে বের করা, প্রতিটি গুমের অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্ত নিশ্চিতে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ কমিশন গঠন, দায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ এবং গুমের শিকার ব্যক্তি ও তার পরিবারের যথাযথ পুনর্বাসন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার আহ্বান জানাচ্ছে। একইসঙ্গে গুম সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সনদ স্বাক্ষর করে গুম প্রতিরোধে সরকারের সদিচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানানো হয়েছে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, ২০০৭ থেকে ২০২০ (২৫ আগস্ট) পর্যন্ত ৬০৪ জন গুমের শিকার হয়েছে বলে ভুক্তভোগী পরিবার ও স্বজনরা অভিযোগ তুলেছেন। এদের মধ্যে পরবর্তী সময়ে ৭৮ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। ৮৯ জনকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে এবং ৫৭ জন ফেরত এসেছে।
এসব ঘটনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরিবার, স্বজন বা প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা, সাংবাদিক বা মানবাধিকার সংগঠনের তথ্যানুসন্ধানে দেখা যায়, বিশেষ বাহিনী-র্যাব, ডিবি পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগের পরিচয়ে সাদা পোশাকে ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের তুলে নেওয়া হচ্ছে। প্রায়ই সংশ্লিষ্ট বাহিনী তাদের গ্রেফতার বা আটকের বিষয়টি অস্বীকার করে।
পরিচিত কিংবা প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ ছাড়া খুব কম ক্ষেত্রেই আলোচনা বা আলোড়ন সৃষ্টি হয় এবং উদ্ধারের তৎপরতা লক্ষ করা যায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে গুম হওয়ার কিছুদিন পর হঠাৎ করেই তাদের কোনও মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয় বা ক্রসফায়ারে তাদের মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া যায়। যারা ফিরে আসতে পেরেছেন তাদের ক্ষেত্রেও কী ঘটেছে তা জানা যায় না।
বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে গুমের ঘটনা বরাবর অস্বীকার করা হলেও দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংগঠন এবং জাতিসংঘ মানবাধিকার ব্যবস্থার আওতাধীন বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ বা বিশেষজ্ঞ কমিটি এ বিষয়ে বারবার উদ্বেগ প্রকাশ করে এসেছেন।
২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী কমিটির ৬৭তম অধিবেশনে নির্যাতন এবং অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক অথবা মর্যাদাহানিকর আচরণ বা শাস্তিবিরোধী সনদের আওতায় বাংলাদেশের অগ্রগতি পর্যালোচনা হয়।
এ পর্যালোচনায় অঘোষিত আটক, যাকে কমিটি অন্তর্ধান বা গুম হিসেবে বর্ণনা করেছে। সেই বিষয়টিতে কমিটি বলেছে, এভাবে আটককৃত ব্যক্তিকে যদি হত্যা করা হয় অথবা তিনি ফিরে আসেন−যাই ঘটুক না কেন, তাকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনে গুম হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।
কমিটি তাদের চূড়ান্ত পর্যবেক্ষণে সব আটক ও আটকাবস্থায় মৃত্যুর ঘটনার সঙ্গে অভিযুক্ত বাহিনীর বাইরে একটি স্বাধীন তদন্ত সংস্থা দ্বারা দ্রুততার সঙ্গে পরিপূর্ণ তদন্ত সম্পাদন করা এবং গুম সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সনদের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আইনের মাধ্যমে ‘গুম’কে অপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সনদটি স্বাক্ষর করার সুপারিশ করে।
গুম প্রতিরোধ দিবসে আইন ও সালিশ কেন্দ্র সব গুম হওয়া ব্যক্তির পরিবারের প্রতি সহমর্মিতা জানায় আসক। একটি ন্যায় ও মানবাধিকার ভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় গুমের মতো মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বন্ধ করতে হবে বলেও তারা মনে করে। আসক গুমের ঘটনা প্রতিরোধে এবং ভুক্তভোগী ও পরিবারের ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অবিলম্বে একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ কমিশন গঠনের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানায়।
লেখকঃ ল ফর ন্যাশনস, ইমেইলঃ lawfornations.abm@gmail.com, মোবাইল: 01842459590.
Discussion about this post