বিডি ল নিউজঃ আজ বুধবার মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াতের নায়েবে আমির মতিউর রহমান নিজামীর রায় দেবে ট্রাইব্যুনাল। তার বিরুদ্ধে ষোলটি অভিযোগের ভিত্তিতে এ রায় ঘোষিত হবে। এ রায় জামায়াতের বিপক্ষে গেলে হরতালের মত কর্মসূচি দেওয়ার সিদ্ধান্ত ইতিমধ্যেই নিয়ে রেখেছে জামায়াতে ইসলামী। রায় ঘোষনা উপলক্ষে নিজামীকে ইতোমধ্যে ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার তাকে গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়। নিজামী কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারের মিলিগিরি ভবনে ফাঁসির সেলে বন্দি ছিলেন। সেখান থেকে মঙ্গলবার (২৮ অক্টোবর) সন্ধ্যা পৌনে ৬টায় তাকে ঢাকায় পাঠানো হয়। হাইসিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার জান্নাতুল ফরহাদ এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
এদিকে জানা গেছে, জামায়াতের শীর্ষ পাঁচ নেতার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ের দিন হরতাল দিলেও মতিউর রহমান নিজামীর রায়ের আগ পর্যন্ত অপেক্ষা করবে জামায়াত। তবে রায় বিপক্ষে গেলে বৃহস্পতিবারই এক দিনের হরতাল দিতে পারে দলটি। সেক্ষেত্রে খালেদা জিয়ার জনসভা উপলক্ষে নাটোর এবং এর আশপাশের কয়েকটি জেলা হরতালের আওতামুক্ত রাখা হতে পারে।
নির্ভরযোগ্য একটি সূত্রে জানা গেছে, দলের আমীর মতিউর রহমান নিজামীর রায় বিপক্ষে গেলে বৃহস্পতিবার তো বটেই, রোববার থেকে টানা কয়েক দিনের কর্মসূচি দিতে পারে জামায়াত। আর কর্মসূচির ক্ষেত্রে হরতালই তাদের প্রথম পছন্দ। তবে মাঝের দুই দিন শুক্র ও শনিবার দেশব্যাপী দোয়া দিবস পালনের বিষয়টিও ভেবে রেখেছে জামায়াত। যদিও যে কোনো কর্মসূচি দেওয়ার আগে জোট শরিক বিশেষ করে বিএনপির সঙ্গে পরামর্শ করে নিতে চায় তারা।
প্রসঙ্গত, এর আগে গত ২৪ জুন এ মামলার রায় ঘোষণার দিন ধার্য করা হয়েছিল। হঠাৎ নিজামীর অসুস্থতার কারণে সেদিন রায় ঘোষণা করা হয়নি।
একাত্তরে বুদ্ধিজীবী হত্যাসহ ১৬ অভিযোগে জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর বিচার হয় ট্রাইব্যুনালে। উভয় পক্ষের যুক্তিতর্ক গ্রহণ শেষে বিচারিক আদালতে ২৪ মার্চ থেকে রায়ের অপেক্ষায় মামলাটি।
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগের মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুন মতিউর রহমান নিজামীকে গ্রেফতার করা হয়। পরে একই বছরের ২ আগস্ট তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার দেখানো হয়। ২০১১ সালের ১১ ডিসেম্বর তার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করে প্রসিকিউশন। পরে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় নিজামীর বিরুদ্ধে তদন্ত শেষে ৩৩৬ পৃষ্ঠার তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেন তদন্ত সংস্থা। আর আনুষঙ্গিক কাগজপত্রসহ প্রায় আড়াই থেকে ৩ হাজার পৃষ্ঠার ডকুমেন্ট তৈরি করা হয়। তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ২০১১ সালের ১১ ডিসেম্বর মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করেন রাষ্ট্রপক্ষ। এতে তার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে হত্যা, খুন, ধর্ষণ এবং অগ্নিসংযোগসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের ১৫টি অভিযোগ আনা হয়।
২০১২ সালের ৯ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিক এ অভিযোগ আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল। মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে নিজামীর বিচার শুরু হয় ওই বছরের ২৮ মে। ওই বছরের ২৮ মে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার মানবতাবিরোধী অপরাধের ১৬টি অভিযোগ এনে নিজামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ (চার্জ) গঠন করা হয়। অভিযোগ গঠনকালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগের ১৫টির সঙ্গে ১৬ নম্বর অভিযোগে বুদ্ধিজীবী হত্যা যোগ হয়েছে।
গত ২৪ মার্চ মামলাটির যুক্তিতর্ক (আর্গুমেন্ট) উপস্থাপনের মাধ্যমে প্রায় দুই বছরের বিচারিক কার্যক্রম সম্পন্ন হওয়ায় রায় ঘোষণা অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখেন ট্রাইব্যুনাল।
এরপর গত ২৪ জুন মামলার রায়ের কথা থাকলেও সে দিন ভোরে ভোররাতে উচ্চ রক্তচাপজনিত রোগে আক্রান্ত হলে নিজামীর রায় আবারো অপেক্ষমান রাখা হয়।
নিজামীর বিরুদ্ধে যতো অভিযোগ:
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে আটক জামায়াতে ইসলামির আমির মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে এপর্যন্ত ১৬টি অভিযোগ পেয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। অভিযোগগুলো হল:
১. ১৯৭১ সালের ৩ আগস্ট নিজামী চট্টগ্রাম মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে শহর ছাত্রসংঘের এক সুধী সমাবেশে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বক্তব্য দেন। ওই সভায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রসংঘের সভাপতি আবু তাহের হিন্দু সম্প্রদায়কে নিশ্চিহ্ন করার হুমকি দেন। নিজামী ওই সভায় উপস্থিত থেকেও আবু তাহেরের বক্তব্যের বিরোধিতা না করে মৌন সম্মতি দেন।
২. একই বছরের ২২ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক একাডেমি হলে আল-মাদানি স্মরণসভায় স্বাধীনতাকামীদের নিশ্চিহ্ন করতে নেতা-কর্মীদের উদ্বুদ্ধ করেন নিজামী।
৩. একই বছরের ৮ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবন প্রাঙ্গণে এক ছাত্রসমাবেশে উসকানিমূলক বক্তব্য দেন নিজামী।
৪. একই বছরের ৯ ও ১০ সেপ্টেম্বর যশোর বিডি হলে ছাত্রসংঘের মিটিংয়ে জিহাদের সমর্থনে নিজামী বক্তব্য দেন। তিনি ওই মিটিংয়ে নিরীহ বাঙালি হত্যার নির্দেশ দেন।
৫. একই বছরের ১৪ মে নিজামীর নেতৃত্বে পাকিস্তান সেনাবাহিনী, রাজাকার, আলবদররা পাবনার ডেমরা ও বাউসগাতি গ্রাম ঘেরাও করে। এরপর ৪৫০ জন হিন্দুকে এক জায়গায় জড়ো করে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে তারা। সেখানে নারীদের ধর্ষণ করা হয়।
৬. নিজামীর নির্দেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় একই বছরের ৮ মে পাবনার সাঁথিয়া থানার করমজা গ্রামের লোক জড়ো করে নির্বিচারে অসংখ্য লোককে হত্যা করা হয়। ধর্ষণ করা হয় নারীদের।
৭. একই বছরের ২৭ ও ২৮ নভেম্বর সাঁথিয়া থানার ধোলাউড়ি গ্রামে ডা. আবদুল আওয়ালের বাড়িসহ আশপাশের বাড়িঘরে হামলা চালিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় ৩০ জনকে। নিজামীর নির্দেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনী সেখান থেকে চারজনকে ধরে ইছামতী নদীর পাড়ে নিয়ে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। এদের মধ্যে শাহজাহান আলীকে গলা কেটে ফেলে চলে যাওয়ার পর ভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে যান।
৮. ১৬ এপ্রিল ঈশ্বরদী থানার আটপাড়া ও বুথেরগাড়ি গ্রামে হামলা চালিয়ে ১৯ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
৯. ১০ জুন আতাইকুলা থানার মাতপুর গ্রামের মাওলানা কছিমউদ্দিনকে ধরে ইছামতী নদীর পাড়ে নিয়ে হত্যা করা হয়।
১০. ৯ আগস্ট পাবনা শহরের নূরপুর ওয়াপদা মোড় থেকে মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মাজেদসহ দুজনকে ধরে নিয়ে হত্যার পর পাবনা সুগার মিলের পাশে লাশ ফেলে দেওয়া হয়।
১১. ৩ ডিসেম্বর বেড়া থানার বিছাখালী গ্রামে হামলা চালিয়ে ৭০ জনকে হত্যা করা হয়।
১২. আগস্টের কোনো এক সময় সাঁথিয়ার সোনাতলা গ্রামে হামলা চালিয়ে ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।
১৩. মে মাসে ঢাকার মোহাম্মদপুরে শারীরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও রাজাকাররা ক্যাম্প স্থাপনের পর সেখানে গোলাম আযম ও নিজামী নিয়মিত যাতায়াত করতেন। সেখানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে সলাপরামর্শ করতেন তিনি। তারই ফল হচ্ছে সারা দেশে হত্যা ও নির্যাতন।
১৪. ৩০ আগস্ট রাতে পুরাতন এমপি হোস্টেলে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ক্যাম্পে বন্দি জালাল, রুমী, বদিসহ বেশ কয়েকজনকে গুলি করে হত্যার নির্দেশ দেন নিজামী ও মুজাহিদ। এরপর তাদের হত্যা করা হয়।
১৫. একই বছরের ৫ মে থেকে ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে পাবনার সাঁথিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে রাজাকার ক্যাম্পে মাঝেমধ্যে যেতেন নিজামী। সেখানে রাজাকার কমান্ডার সামাদ মিয়ার সঙ্গে বৈঠক করে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের জন্য সলাপরামর্শ করতেন।
১৬. সারা দেশে ছাত্রসংঘ ও আলবদর বাহিনীর সদস্যরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগী হিসেবে হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগসহ মানবতাবিরোধী যে অপরাধ করেছে তার দায় নিজামীর। কারণ ছাত্রসংঘের সভাপতি ও আলবদর বাহিনীর প্রধান হিসেবে ওই সব কর্মকাণ্ডে পরিকল্পনাকারী ও উসকানিদাতা ছিলেন তিনি।
সূত্রঃ প্রিয়
Discussion about this post