খাইরুল ইসলামঃ
আজকাল উপাখ্যানের শেষ নেই, নির্যাতন যেন নৈমিত্তিক কোন বিষয়। নারীর প্রতি অসহনশীল আচরণ উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত সব শ্রেণীতেই কম বেশি আছে। কয়টি ঘটনাই বা শীর্ষ খবর হয়? অধিকাংশই মঞ্চের নেপথ্যে থেকে যায়। তবুও সংবাদ মাধ্যমে, গণমাধ্যমে খবরের পর খবর। কোন এক মা, এক বোন, কিংবা এক সহধর্মিণীর বিষাদী গল্প চোখ এড়ায় না। আবারো আইন অধিকার পাতায় ভুরিভুরি আসতে থাকে মাতৃমনা নারীর কান্না ঝরা কাহিনী।অত্র আলোচ্য যৌতুক সূত্রে পাশবিক নির্যাতন এবং অত্যাচারের চতুর্মাত্রিক দিক। একবিংশ শতাব্দীর সভ্য সমাজের অংশ হয়ে শতবর্ষ প্রাচীন সেই ধ্যান ধারণার বারংবার পুনরাবৃত্তি ঘটে আজো। যে কোন সাধারণ বিষয় নিয়ে অর্ধাঙ্গের অহেতুক রোষানলে পড়ে অর্ধাঙ্গিনী। অথবা, বাইরের ব্যর্থতা- অপ্রাপ্তির ঝলকানিতে গৃহবাঘ হয়ে কোমলমতি স্ত্রীহরিণীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে অর্বাচীন স্বামী। এরূপ কদর্য আচরণ সম্পূর্ণ অনাকাঙ্ক্ষিত। বেশির ভাগ পুরুষই নারীদের দুর্বলতার সুযোগ নেয় এবং পেশিশক্তি দিয়ে পাশবিক আচরণ করে।
বাংলার বউ আর যৌতুক- যেন দুজন দুজনার। নারী পাচারের হোতা, সেও পুরুষ। আসলে নির্যাতনের ষোলোকলা পূর্ণ করতে পুরুষ বোধহয় সদা তৎপর। পুরুষের প্রেমের ব্যর্থতায় বলি হয় অগণিত কিশোরীর নিষ্কলঙ্ক চাঁদ মুখ, এসিডের ঝাঁঝালো ক্ষারে তাদের রূপা সৌন্দর্য হয় বিলীন। যে পুরুষ অবৈধ সঙ্গমের হোতা, সমাজের চোখে সে লাভ করে বীর অর্চনা; ধর্ষিতা নারীকে লেপটে দেওয়া হয় “পতিতা” খচিত সামাজিক কলঙ্ক, বানানো হয় বলির পাঁঠা। এ সবই পুরুষ শাসিত সমাজের দৈনিক কর্মকাণ্ডের খেরোখাতা।
৬০-৭০% নারী শারীরিক ও যৌন নির্যাতনে ভোগে যেখানে প্রতি ৩ জনে ২ জন যৌতুক সংক্রান্ত শারীরিক অন্যায় অত্যাচারের শিকার। আবার ১৫% নারী গর্ভকালীন নির্যাতনে মৃত্যুবরণ করে। বড্ড নিষ্ঠুর এ হালচিত্র স্বভাবতই পুরুষের হিংস্র হাতে অংকিত। আমাদের মেরুদণ্ডহীন পুরুষ তথা স্বামীরা স্ত্রী পক্ষের দান পাবার আশায় নিত্য মানসিক- শারীরিক চাপ প্রয়োগ করতেই থাকে। এই কি সভ্যতা? এ যুগল শৃঙ্খল ভাঙ্গার সম্পূর্ণ ভার পুরুষের। আইন করে কাজ হচ্ছে না, মনের আইন ঠিক করা বাঞ্ছনীয়। পুরুষত্ব চর্চার মঞ্চ কোনক্রমেই নারী দেহ বা নারী মন হতে পারে না। ধনাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি, সৌম্য শিক্ষা, পরিচ্ছন্ন চিন্তা, সম্মানের মননশীলতা, সহযোগিতার হাত- এরকম কিছু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপমা পুরুষের থাকলেই চলবে, তাতেই নারী নির্যাতন শতভাগ নিশ্চিহ্ন হবে।
নারীদের পক্ষে আইন আছে প্রচুর, প্রয়োগ অবশ্য যথেষ্ট নয়। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০৩ এবং এসিড নিক্ষেপ নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০০২– এ দ্বয়কে ধরা হয় নারীদের নিরাপত্তার লৌহ বর্ম। আবার বাংলাদেশ দণ্ড বিধি, ১৮৬০- আইনটি নারী সুরক্ষায় বহু বিধিমালার সন্নিবেশ ঘটিয়েছে। সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড সহ বড় মাপের আর্থিক জরিমানা, আইনের পূর্ণাঙ্গ প্রয়োগ আজ সময়ের দাবী। সাম্প্রতিক সাইবার আইনের হালনাগাদ, ইভ টিজিং প্রতিরোধে বহাল আইনের সংশোধন- বর্তমান সময়ের উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। তবে সত্যি বলতে কি, আইন পর্যন্ত যাওয়া লাগে না, যদি একটু সচেতনতা, সহমর্মিতা পুরুষ চরিত্রে বিকশিত হয়। কাজেই লিঙ্গ বৈষম্য এড়ানো আর পুরুষের বন্ধুসুলভ আচরণ সমাজের নিপীড়িত প্রতীক জোছনা, খাদিজা, আছিয়া, কিংবা রিমাদেরকে উৎপীড়ন, অসহায়ত্ব আর অবহেলার বিষবাস্প থেকে চির মুক্তি দিতে সক্ষম।
Discussion about this post