ভাড়াটিয়ার সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য না নিয়ে বাসা ভাড়া দিচ্ছে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের অধিকাংশ বাড়ির মালিক। এর ফলে পেশাদার অপরাধীরা বিভিন্ন বাসাকে তাদের অপরাধ কার্যক্রমের আস্তানা হিসেবে ব্যবহার করছে। অপহরণকারীরা বাসা ভাড়া নিয়ে লোকজনকে সেখানে জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায় করছে। খুনের ঘটনাও ঘটছে। তবে সর্বশেষ সবচেয়ে ভয়ংকর যে তথ্য পুলিশের কাছে আছে, তা হচ্ছে জঙ্গি আস্তানা হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন এলাকার বাসাবাড়িগুলো। পরিচয় গোপন করে জঙ্গি সদস্যরা এসব বাসা ভাড়া নিচ্ছে। সেখানে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে, সাংগঠনিক বৈঠক করছে, অস্ত্র-বিস্ফোরকও মজুদ করছে।
এ অবস্থায় গত ৫ অক্টোবর কর্ণফুলী এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় জেএমবি’র আস্তানার সন্ধান পাবার পর নগরীর ভাড়া বাসা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন নগর পুলিশ কর্মকর্তারা। এ বিষয়ে বাড়িওয়ালাকে সচেতন করার জন্য আইনের প্রয়োগের কথা ভাবছে নগর পুলিশ।
নগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (উত্তর-দক্ষিণ) বাবুল আক্তার বাংলানিউজকে বলেন, বাড়িওয়ালারা যাকে বাসা ভাড়া দিচ্ছেন তার সম্পর্কে কোন তথ্য রাখেন না। এমনকি ভাড়াটিয়ার মোবাইল নম্বরটা পর্যন্ত অধিকাংশ বাড়িওয়ালার কাছে থাকেনা। তারা শুধু মাস শেষে ভাড়ার টাকা পাওয়াটাকেই গুরুত্বপূর্ণ ভাবছেন। কিন্তু বাড়িওয়ালাদেরও যে কিছু সামাজিক দায়িত্ববোধ আছে, সেটা কেউ বিবেচনায় নেননা।
নগর পুলিশের একাধিক সূত্রমতে, সাধারণত নগরীর উপকন্ঠের বাসাগুলো জঙ্গি সংগঠনের আস্তানা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন ভবনে মেস হিসেবে ভাড়া দেয়া বাসাগুলোকে ব্যবহার করছে জঙ্গিরা।
কর্ণফুলী থানার খোয়াজনগর এলাকায় যে বাসায় জেএমবি আস্তানা গড়ে তুলেছিল সেটি ভাড়া নিয়েছিল গ্রেনেড বিস্ফোরণে নিহত জেএমবি’র সামরিক কমান্ডার তৌহিদুল ইসলাম ওরফে জাবেদ। নিজেকে ছাত্র পরিচয় দিয়েই বাসাটি সে ভাড়া নিয়েছিল। এক্ষেত্রে বাসার মালিকের কাছে তাদের বিষয়ে কোন তথ্যই ছিলনা।
গত ৫ অক্টোবর নগরীর কর্ণফুলী থানার খোয়াজনগর এলাকায় জেএমবি’র একটি আস্তানায় অভিযান চালিয়ে আটটি হ্যান্ডগ্রেনেড ও বিপুল পরিমাণ বোমা তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করে নগর গোয়েন্দা পুলিশ। এসময় জেএমবি’র সামরিক প্রধান জাবেদসহ পাঁচজনকে আটক করা হয়। জাবেদ ৬ অক্টোবর ভোরে নগর গোয়েন্দা পুলিশের সঙ্গে আরেকটি অভিযানে গিয়ে গ্রেনেড বিস্ফোরণে নিহত হয়।
জীবিত চারজনকে জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশ ওই বাসা ভাড়া নেয়ার বিষয়ে তথ্য পেয়েছে বলে জানান এডিসি-ডিবি বাবুল আক্তার।
সূত্রমতে, জেএমবি সদস্যরা নগরীর বায়েজিদ বোস্তামি থানার টেক্সটাইল এলাকায় একটি বাসা ভাড়া নিয়ে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তুলেছিল। ওই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের দায়িত্বে ছিল জেএমবি’র আঞ্চলিক কমান্ডার ফারদিন। ওই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ছিলেন সর্বশেষ টাঙ্গাইল থেকে গ্রেপ্তার হওয়া জেএমবি সদস্য মিনহাজুল আবেদিন ওরফে সাজিদ ওরফে সাজিব।
সূত্রমতে, জেএমবি’র দুই সদস্য নগরীর রহমাননগর এলাকায় একটি বাসা ভাড়া নিয়েছিল। দু’জন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের পরিচয়পত্রের ছবি পাল্টে নিজেদের ছবি বসিয়ে দিয়ে তারা বাড়িওয়ালাকে প্রদর্শন করে। সেই পরিচয়পত্রে যে মোবাইল নম্বর লেখা ছিল সেটি ছিল বন্ধ। কিন্তু বাড়িওয়ালা কখনও সেই মোবাইল নম্বরটিও যাচাই করে দেখেননি।
নগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ কমিশনার (উত্তর-দক্ষিণ) বাবুল আক্তার বাংলানিউজকে বলেন, চট্টগ্রামে সংগঠিত হওয়ার জন্য জেএমবি সদস্যরা নগরীর বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে প্রবেশপথসহ পাহাড়ি এলাকায় একাধিক বাসা ভাড়া নিয়েছিল। সেখানে তারা বিভিন্ন ধরনের জঙ্গি কর্মকান্ড করেছে। অথচ কোন বাড়ির মালিক এ বিষয়ে কিছুই জানেন না।
বিভিন্ন সময় মেস এবং ব্যাচেলর বাসায় অভিযান চালিয়ে জামায়াত-শিবিরের সদস্যদের গ্রেপ্তার করেছেন বাকলিয়া থানার ওসি মোহাম্মদ মহসিন। তিনি বলেন, ব্যাচেলরদের বাসা ভাড়া দেয়ার ক্ষেত্রে বাড়িওয়ালাদের সতর্ক হওয়া উচিৎ। অথচ তারা এ ব্যাপারে উদাসিন। ভাড়াটিয়াদের আচরণ সন্দেহজনক মনে হলেও থানাকে পর্যন্ত তারা অবহিত করেনা।
এর আগে নগরীর হালিশহরে ভাড়া বাসায় জঙ্গি সংগঠন শহীদ হামজা ব্রিগেডের অস্ত্র-বিস্ফোরকের গুদাম ও আস্তানা পেয়েছিল র্যাব। সেখান থেকে বিপুল পরিমাণ ফ্লাক্স বোমা ও বোমা তৈরির সরঞ্জামসহ সংগঠনটির কয়েকজন সংগঠককে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এছাড়া পাঁচলাইশে একটি ভাড়া বাসায়ও সংগঠনটির গোপন আস্তানা থেকে অস্ত্র উদ্ধার করেছিল র্যাব।
সূত্রমতে, মূল শহরের বাইরে শিল্প এলাকা, ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার বাসাগুলো অপহরণ, প্রতারণাসহ বিভিন্ন অপরাধ সংঘটনের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হচ্ছে। নগরীতে সংঘটিত এ ধরনের অপরাধের ৫০ শতাংশই ঘটে ভাড়া বাসায়।
মাসখানেক আগে নগরীর পতেঙ্গায় স্ত্রীকে খুন করে বাসার ভেতরে রেখে পালিয়ে যায় স্বামী। নগর গোয়েন্দা পুলিশের টিম তদন্তে গিয়ে জানতে পারে, বাড়িওয়ালার ভাড়াটিয়ার নাম পর্যন্ত জানেনা। একই ঘটনা বিপুল পরিমাণ পোশাক শ্রমিক অধ্যুষিত নগরীর কলসী দিঘীর পাড় এলাকায় বেশ কয়েকটি ঘটেছে বলে সূত্র জানিয়েছে।
নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ কমিশনার (পশ্চিম-বন্দর) এস এম তানভির আরাফাত বলেন, চট্টগ্রাম নগরীতে এখন অপহরণের ঘটনা বেড়েছে। অপহরণকারীরা তাদের আস্তানা হিসেবে ভাড়া বাসাকে ব্যবহার করছে। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে-নিজেদের বাড়ির ভেতরে এতবড় অপরাধ হচ্ছে, অথচ অধিকাংশ বাড়ির মালিকই সেটা জানতে পারেন না। অথবা ভাড়াটিয়া সম্পর্কে তার কাছে কোন তথ্যই থাকেনা।
ভাড়া বাসাকে জঙ্গি আস্তানা হিসেবে ব্যবহার ঠেকাতে ২০০৯ সালে ব্যতিক্রমধর্মী এক কর্মসূচী শুরু করেছিলেন সিএমপি’র তৎকালীন উপ কমিশনার (উত্তর) বনজ কুমার মজুমদার। নগরীর বিভিন্ন এলাকায় বাসায় বাসায় গিয়ে পুলিশ বাসা ভাড়া দেয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বনের স্টিকার সেঁটে দেন। ব্যাপক প্রচারণার কারণে সেসময় বাড়িওয়ালারা সতর্ক হয়ে গিয়েছিলেন।
পরবর্তীতে সিএমপির তৎকালীন উপ-কমিশনার (সদর) আমেনা বেগম সেই কার্যক্রমকে এগিয়ে নিয়েছিলেন। তিনি বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটিয়াদের জন্য ফরম চালু করেছিলেন। সেই ফরমে ভাড়াটিয়ার পূর্ণাঙ্গ তথ্য লিখে নিকটস্থ থানায় জমা দেয়া বাধ্যতামূলক করেছিলেন।
তবে সময়ের ব্যবধানে সিএমপি’র সেই জনমুখী উদ্যোগে ভাটা পড়েছে। এর ফলে ভাড়া বাসাকে ব্যবহার করে জঙ্গি কার্যক্রমসহ অপরাধ বেড়েছে বলে মনে করছেন খোদ পুলিশ কর্মকর্তারাই।
Discussion about this post