সম্প্রতি ভারতের গুজরাট জাতীয় আইন বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘দ্য রুল অব জুডিশিয়ারি ইন এনশিওরিং অ্যা রুল অব ল সোসাইটি শেয়ারিং এক্সপেরিয়েন্স অব দ্য জুডিশিয়ারি অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক নিবন্ধটি তিনি উপস্থাপন করেন। উপস্থাপিত ইংরেজি নিবন্ধের সংক্ষিপ্ত নিরপেক্ষ পাঠকদের জন্য পুনঃ প্রকাশ করা হলো।<br /> স্মরণীয় এ অনুষ্ঠানে আপনাদের মাঝে উপস্থিত হওয়ার সুযোগ পাওয়া আমার জন্য পরম আনন্দের ব্যাপার। আজ আমার আইন নিয়ে পড়ার সেই ছাত্রজীবনের কথা মনে পড়ছে এবং আমাকে স্মৃতিকাতর করে দিচ্ছে। বক্তব্য দান শুরুর আগে আমি গভীর কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই গুজরাট জাতীয় আইন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে। তারা এই স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে আমন্ত্রণ জানিয়ে প্রতিষ্ঠানটির উজ্জ্বল, মেধাবী আইনের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আমাকে মতবিনিময়ের সুযোগ করে দিয়েছে। আর এই শিক্ষার্থীরা শুধু ভারত নয়, এ অঞ্চলের ভবিষ্যৎ নেতা।<br /> বাংলাদেশ ১৬ কোটি মানুষের এক গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র। সংবিধানের আওতায় এখানে বিচারব্যবস্থাকে যেকোনো রকমের ভয় বা পক্ষপাতিত্বমুক্ত থেকে ন্যায়বিচার করার দায়িত্ব পালন করতে হয়, বিচারব্যবস্থার উচ্চ পর্যায়ে সুপ্রিম কোর্ট ও জেলা পর্যায়ে দায়রা ও ফৌজদারি আদালত নিয়ে আছেন নিম্ন আদালত। সুপ্রিম কোর্ট হাইকোর্ট বিভাগ ও আপিল বিভাগ এ কয়টি বিভাগ নিয়ে গঠিত। এই আপিল বিভাগ ওই প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আদালত এবং তা প্রধান বিচারপতিসহ ১১ জন বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত।<br /> স্বাধীনতার মহান আন্দোলনের চেতনার ভিত্তিতে গঠিত সংবিধান বিচারব্যবস্থার, সেই সঙ্গে বিচারক ও ম্যাজিস্ট্রেটদের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দিয়ে থাকে (অনুচ্ছেদ ৯৪(৪) ও অনুচ্ছেদ ১১৬(ক)। প্রধানমন্ত্রী সরকারের প্রধান নির্বাহী ও রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের প্রধান। রাষ্ট্রপতি প্রধানত প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে দায়িত্ব সম্পাদন করে থাকেন (অনুচ্ছেদ ৪৮(৩)। সংবিধান অনুসারে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শের ভিত্তিতে নিয়োগ পাবেন [অনুচ্ছেদ ৯৫(১)]। একইভাবে নিম্ন বিচারিক আদালত ও বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটদের পদোন্নতি, বদলি, ছুটি ও শৃঙ্খলা সম্পর্কিত বিষয়াদি রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত এবং রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শমতে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন।<br /> এক হাজারেরও বেশি আইন আছে বাংলাদেশে। অপরাধীদের আঘাত থেকে মানুষকে রক্ষার জন্য আমাদের এসব আইন যথেষ্ট। আইনি ও সাংবিধানিক রায় দেওয়ার পাশাপাশি সুপ্রিম কোর্ট প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে মানুষের অধিকার রক্ষায় ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকেন। বলা যায়, এই বিচার বিভাগীয় ভূমিকা অনেক ক্ষেত্রে আইনি শূন্যতা পূরণ করে। বিচার বিভাগীয় ভূমিকা গণতন্ত্রকেও শক্তিশালী করে এবং আইনের শাসনের ওপর গণমানুষের আস্থার স্থানটির পুনর্নিশ্চয়তা দেয়। তবে বিচার বিভাগ অ্যালার্ম ঘড়ি হিসেবেই কাজ করতে পারে; টাইমকিপার তথা পাহারাদারের ভূমিকাটি তার নয়। সতর্কসংকেত দেওয়ার পর তাকে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হয় যে নির্বাহী বিভাগ সংবিধানের আলোকে তার দায়িত্বগুলো পালন করছে এবং এ ক্ষেত্রে তারা এও খেয়াল রাখছে যে বিচার বিভাগীয় ভূমিকাটি কোনো আনগাইডেড মিসাইল তথা অনির্দেশিত ক্ষেপণাস্ত্র নয়।<br /> দেশের বর্তমান বিচারব্যবস্থায় মামলা ব্যবস্থাপনাটি খুবই ধীরগতির, ব্যয়বহুল। মামলা নিষ্পত্তিতে অনেক সময় লেগে যায় বলে কেউ কেউ আদালতে গিয়ে মামলা রুজু করা ও কোনো অভিযোগের মুখোমুখি হওয়াকে হয়রানি ও বোঝা মনে করে। বাংলাদেশে সুপ্রিম কোর্টের প্রায় ১০০ বিচারকের বিপরীতে তিন লাখ ৮০ হাজার মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। দায়রা আদালতের এক হাজার ৪০০ বিচারকের বিপরীতে শুনানি ও নিষ্পত্তির বাকি ২৭ লাখ মামলা। এক কথায় এত বেশিসংখ্যক মামলার বিচারের জন্য বর্তমান বিচারকের সংখ্যাটি একেবারেই পর্যাপ্ত নয়। এ ছাড়া সিভিল মামলা, বিশেষ করে স্থাবর সম্পত্তির মালিকানা দাবির ক্ষেত্রে বিবাদ এত জটিল হয়ে পড়ে যে বর্তমান ব্যবস্থায় একজন বিচারক দ্রুত নিষ্পত্তি কৌশল নিতে পারেন না।</p> মলাজট বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার জন্য সবচেয়ে বড় বাধা। সুপ্রিম কোর্ট ও নিম্ন আদালত মিলিয়ে বর্তমানে ৩০ লাখ মামলা বিচারের অপেক্ষায় ঝুলে আছে। বিপুলসংখ্যক মামলার এই জট ধীরে ধীরে বিচারব্যবস্থাকেই গ্রাস করতে বসেছে; এর ফলে মামলার নিষ্পত্তিতে আরো বেশি সময় লাগছে এবং মানুষের বিচারপ্রাপ্তির অধিকারটি ক্ষুণ্ন হচ্ছে।<br /> অনেক সময় মানুষ প্রথাগত সালিসি বিচারব্যবস্থারও (গ্রামীণ মাতব্বর, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক নেতাদের নেতৃত্বে) শরণাপন্ন হচ্ছে। এ ব্যবস্থাটি ঐতিহ্যগতভাবেই বিভিন্ন সিভিল ও ফৌজদারি বিরোধ ও বিবাদ নিরসনে ভূমিকা রেখে এসেছে।<br /> উন্নয়নশীল আরো অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও সুরক্ষিত নয় এমন বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর (যেমন নারী, শিশু, জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু, দরিদ্র, প্রতিবন্ধী) প্রায়ই প্রচলিত বিচারব্যবস্থার পুরো সুযোগ পায় না বলে মনে করা হয় বা অভিযোগ ওঠে। তারা বিশেষ করে সঠিক সময়ে ও সীমিত সাধ্যের মধ্যে বিচার লাভে সমস্যার মুখোমুখি হয়। বিচার বিভাগ সংশ্লিষ্ট এজেন্সিগুলোর (যেমন পুলিশ, কারগার ও আদালত) মধ্যে সমন্বয় ও সহযোগিতার অভাব আইনি প্রক্রিয়াগুলোকে ধীর করে। এর ফলে কারাগারগুলোতে ঠাঁইহীন অবস্থা তৈরি হচ্ছে ও মামলার জট বাড়ছে। চাপ বাড়ছে আদালত প্রশাসনের ওপরও।<br /> বাংলাদেশের সংবিধান অনুসারে সুপ্রিম কোর্ট গোটা বিচারব্যবস্থার অভিভাবক। এ ব্যবস্থার বাধাগুলো অপসারণে সুপ্রিম কোর্ট কিছু সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নিয়েছেন। এর মধ্যে আছে মামলা ব্যবস্থাপনা সংস্কার কমিটি ও নজরদারি কমিটি। ৩০ লাখ মামলার সব কয়টিকেই বয়স ও প্রকৃতির ভিত্তিতে শ্রেণি বিন্যাস করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। শ্রেণি বিন্যাসের পর সম্ভব হলে একই ধরনের অনেক মামলা একসঙ্গে নিষ্পত্তির চেষ্টা করা হবে। বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের পদায়ন, পদোন্নতি ও শৃঙ্খলার বিষয় দেখার জন্য বিভিন্ন কমিটি গঠিত হয়েছে। রেজিস্ট্রি ব্যবস্থার মাধ্যমে বিচারকদের আদালতে আসা ও যাওয়ার সময়, তাঁদের কাজের মান, সহকর্মী ও আইনজীবীদের সঙ্গে আচরণ—এসব খতিয়ে দেখা হচ্ছে। জজ আদালতের বিচারিক কর্মকর্তারা ঠুনকো অজুহাতে ছুটি নিচ্ছেন কি না তার খোঁজখবর রেখে প্রধান বিচারপতিকে অবহিত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে। প্রত্যন্ত এলাকার জেলা আদালতগুলোতে তথ্যপ্রযুক্তি নেটওয়ার্কের আওতায় আনা হচ্ছে।<br /> জমে যাওয়া মামলার পাহাড় থেকে মুক্তির জন্যই আদালত প্রশাসন ও মামলা ব্যবস্থাপনায় উন্নয়ন প্রয়োজন। এটি নিশ্চিত করা গেলে আশা করা যায়, মোট মামলার ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ পাঁচ বছরের মধ্যে নিষ্পত্তি হয়ে যাবে। আদালত, বিশেষ করে সিভিল আদালত যেন নিশ্চিত করেন যে পাঁচ বছর কিংবা তার চেয়ে বেশি পুরনো মামলা, বিশেষ করে ভাগবাটোয়ারাসংক্রান্ত বা অন্যান্য জটিল মামলা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিষ্পত্তি করা হচ্ছে। বিচারিক কর্মকর্তাদের দীর্ঘ রায় না লেখাও উচিত হবে। প্রতিটি মামলার নিষ্পত্তির একটি সময় বেঁধে দিয়ে বিচারপ্রক্রিয়ার অগ্রগতি যাতে কম্পিউটারাইজড সিগনালিং সিস্টেমের মাধ্যমে অনুসরণ করা যায় সেদিকে মনোযোগ দিতে হবে। সুপ্রিম কোর্ট একটি সফটওয়্যার তৈরির লক্ষ্যে ইউএনডিপির সঙ্গে কাজও করছেন। বিচারপ্রক্রিয়ায় আধুনিকায়নের মাধ্যমে পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে হবে বিচারকদের। অবকাশকালীন ছুটিও তিনবারের বেশি হওয়া উচিত নয়।<br /> মামলা ব্যবস্থাপনায় সংস্কার ও দক্ষ সেবাদান চাইলে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির কোনো বিকল্প নেই। সফটওয়্যারের সহায়তায় কোনো মামলার তথ্য এখন সার্চ কমান্ড দিয়ে বের করা সম্ভব। তথ্যপ্রযুক্তির সর্বশেষ সুবিধাগুলো ব্যবহার করে নাগরিকদের কাছে তাদের পছন্দের ডিভাইসে মামলার তথ্য পাঠানোর কাজটিও নিশ্চিত করা কঠিন হবে না। সুপ্রিম কোর্টে আমরা তথ্যপ্রযুক্তির সুুবিধা নেওয়ার প্রয়োজনীয়তাটি অনেক আগেই উপলব্ধি করি। কারণ তথ্যপ্রযুক্তি দিয়েই কাজের গতি কয়েক গুণ বৃদ্ধি ও সেবার জন্য অপেক্ষমাণ সর্বশেষ ব্যক্তির কাছে পৌঁছানো সম্ভব। বিচারব্যবস্থার ডিজিটাইজেশনের পথে এরই মধ্যে আমরা কিছু এগিয়েও গেছি। আমাদের জন্য ইউএনডিপির তৈরি আইসিটি ব্যবস্থার মাধ্যমে একদিন আমরা কারাগার ও পুলিশসহ সব আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে সঙ্গে নিয়ে সমন্বিত একটি সমাধানে পৌঁছতে পারব বলে আশা করছি।<br /> আমরা আনন্দের সঙ্গে জানাতে পারি যে সুপ্রিম কোর্ট ও এর অধীন আদালতে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার সেবার মান বৃদ্ধিতে কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। মানুষ এখন তাদের মামলার তথ্য ইন্টারনেট, মোবাইল অ্যাপস ও এসএমএসের মাধ্যমে লাভ করতে পারছে।<br /> বিচারব্যবস্থায় আমরা যেসব আইসিটি সুবিধা যুক্ত করেছি তার মধ্যে আছে সুপ্রিম কোর্ট ও পরীক্ষামূলক তিন জেলায় মামলা ব্যবস্থাপনা সফটওয়্যার চালু, কজলিস্ট ও মামলার তথ্য অনলাইন ও এসএমএসের মাধ্যমে সরবরাহ, সুপ্রিম কোর্ট ও এর অধীনস্থ কোর্টের মামলার তথ্য খোঁজার জন্য মোবাইল অ্যাপস তৈরি ও আদালত প্রশাসন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা বৃদ্ধির জন্য ওয়েবভিত্তিক জুডিশিয়াল অফিসার্স ডাটাবেইস ম্যানেজমেন্ট অ্যাপলিকেশন তৈরি।</p> প্রিম কোর্ট ই-জুডিশিয়ারি পুরোপুরি বাস্তবায়নের অপেক্ষায় রয়েছেন এবং সরকার সাড়ে ছয় কোটি মার্কিন ডলার ব্যয়ে পাঁচ বছরমেয়াদি ই-জুডিশিয়ারি প্রকল্প গ্রহণ করতে যাচ্ছে। এর লক্ষ্য হচ্ছে, সাত বিভাগের অধীন আদালতগুলোতে সাক্ষ্যগ্রহণ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন, ৬৪টি জেলা আদালতে ইন্টারনেট সংযোগ ও ওয়াই-ফাই সুবিধা এবং অনলাইনে কজলিস্ট দেওয়া, উচ্চ ও নিম্ন আদালতে ই-কোর্ট ব্যবস্থা চালু, রেকর্ড কক্ষ অটোমেশন ও ডিজিটাল পদ্ধতিতে রেকর্ড ধারণ ও সংরক্ষণ, সব জেলাভিত্তিক ও কেন্দ্রীয় কারাগারের মধ্যে ভিডিও কনফারেন্সের সুবিধা চালু, দেশের বিচারব্যবস্থায় ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমের প্রচলন ও বিচারিক কর্মকর্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি।<br /> বিচারব্যবস্থায় মানুষের আস্থার অভাব আইনের শাসন ও সার্বিক উন্নয়নের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনে। তখন প্রভাবশালী মহল কিংবা অপরাধীরা বিচারবহির্ভূত পন্থায় বিরোধ নিষ্পত্তি করে এবং সাধারণ মানুষও তা মেনে নিতে বাধ্য হয়। মানুষ এমনকি সত্যিকারের প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রেও আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার বিষয়ে নিরুৎসাহী হয়। ফলে আইনের শাসন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং দরিদ্র, নারী, শিশুসহ অন্যান্য তুলনামূলক অসহায় জনগোষ্ঠীর স্বার্থের হানি ঘটে। সমাজে তাদের অবস্থানটিও হয়ে যায় আরো নড়বড়ে।<br /> একটি জাতির বিচারব্যবস্থায় গণমানুষের আস্থা কতখানি তা দিয়েই ব্যবস্থাটির ব্যারোমিটার পাঠ করা যায়, স্পষ্ট হয় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আস্থার জায়গাটিও। আমরা এখন বৈশ্বিক সমাজে বাস করি। আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্যই শুধু নয়, মানবাধিকার পরিস্থিতি, সুশাসন ও আইনের প্রয়োগের দিকেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নজর থাকে। একটি দেশের আইনিব্যবস্থায় আন্তর্জাতিক আস্থা দেশটির উন্নয়ন ও বৈদেশিক সম্পর্কের ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রেখে থাকে। একইভাবে কোনো দেশে নৈরাজ্য ও পশ্চাত্পদতা থাকলে অন্য সব রাষ্ট্র, বিশেষত প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর ওপর এর প্রভাবটি হয় নেতিবাচক। এটি ওই অঞ্চলের বাণিজ্য, অর্থনৈতিক বিকাশসহ সার্বিক উন্নয়নের জন্যও বন্ধ্যত্ব তৈরি করে। তাই বিচারব্যবস্থাকে অবশ্যই মানুষের অধিকার, মুক্তি ও স্বাধীনতা রক্ষায় সক্ষম হতে হয়।<br /> ২০১৪ সালের গ্যালপ জরিপ অনুসারে, বিশ্বে এশিয়াতেই আইনের শাসনের ওপর গণমানুষের আস্থার হারটি সর্বোচ্চ। প্রতি তিনজন বয়স্ক মানুষের মধ্যে প্রায় দুজন (৬৫ শতাংশ) তাদের বিচারব্যবস্থা ও আদালতের ওপর আস্থা পোষণ করে থাকে। অর্ধেকেরও বেশি মানুষের এমন আস্থা রয়েছে, পৃথিবীর আর কোথাও এমন অঞ্চল নেই। লাতিন আমেরিকায় এ হারটি গড়ে ৩৫ শতাংশ এবং তা সর্বনিম্ন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের দেশগুলোয় মাত্র ২৮ শতাংশ।</p> আবার এশিয়ায় জরিপের ফলাফলে বড় মাপের ব্যবধান দৃশ্যমান। আস্থার হার ভুটানে সর্বোচ্চ ৯৫ শতাংশ এবং তাইওয়ানে সর্বনিম্ন ২৩ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশেই মানুষ ব্যবস্থাটিতে আস্থা রেখে থাকে। ভুটান ছাড়াও দেশগুলোর মধ্যে আছে বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা ও নেপাল।<br /> ‘হ্যাঁ’ ও ‘না’ বিচারে আস্থার হারটি দক্ষিণ এশিয়ায় যথাক্রমে এ রকম : ভুটান ৯৫ শতাংশ ও ৪ শতাংশ, বাংলাদেশ ৭৫ শতাংশ ও ২২ শতাংশ, ভারত ৭১ শতাংশ ও ১৮ শতাংশ, শ্রীলঙ্কা ৬৯ শতাংশ ও ১৫ শতাংশ, নেপাল ৬৬ শতাংশ ও ২৬ শতাংশ, পাকিস্তান ৬৫ শতাংশ ও ৩২ শতাংশ এবং আফগানিস্তান ২৫ শতাংশ ও ৬৯ শতাংশ।<br /> বাংলাদেশ ও ভারতে বিচারব্যবস্থায় মানুষের দৃঢ় আস্থা থেকে খুব সম্ভব এ বিষয়টি স্পষ্ট হয় যে দেশ দুটিতে আইনের শাসন জোরদারকরণে দৃশ্যমান প্রচেষ্টা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও তারকা ব্যক্তিত্বদের বিরুদ্ধে চাঞ্চল্যকর মামলায় রায় দান ও অপরাধী সাব্যস্ত করার বিষয়টি উল্লেখ্য। তথ্য অধিকার আইন ও দ্রুত বিচার আদালতের পাশাপাশি খুব সম্ভবত উচ্চ আদালতের এসব রায়ও গণমানুষের আস্থা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে।<br /> আসলে মানসম্মত ন্যায়বিচার (কোয়ালিটি জাস্টিস) প্রদানে বিচারব্যবস্থার সক্ষমতা বিচারব্যবস্থায় মানুষের আস্থা অনেক বাড়িয়ে দেয়। আর মানসম্মত ন্যায়বিচার হচ্ছে আদালতে মানুষের অবাধ প্রবেশাধিকার, যেখানে অবিলম্বে ও কম ব্যয়ে ন্যায়বিচার লাভ হয়, আইন অনুসারে রায় ও আদেশ পাওয়া যায়, বিচারপ্রক্রিয়াটি হয় স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও প্রকাশ্য এবং রায় তাত্ক্ষণিকভাবে বাস্তবায়ন করা হয়।<br /> ডাচ্ জুুডিশিয়ারি কাউন্সিল একটি জুডিশিয়াল কোয়ালিটি ইমপ্রুভমেন্ট সিস্টেমের প্রচলন ঘটিয়েছে। তাদের এই কাঠামোয় পাঁচটি মৌলপন্থা অনুসৃত হয়েছে। এগুলো হচ্ছে বিচারকদের নিরপেক্ষতা ও দৃঢ়তা, মামলার প্রস্তুতি ও নিষ্পত্তিতে বিচারকদের অভিজ্ঞতা, বিচারকদের আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গি, আইনের সর্বজনীনতা ও বৈষম্যহীনতা এবং মামলার সংখ্যা ও সময় বিচারে দ্রুত রায় প্রদান।<br /> এ বিষয়ে জাতিসংঘের আইনি শাসনের সূচকটিও উল্লেখ করা যায়। এ সূচকে বিচার খাতে অপরাধের বিচার ও দণ্ডবিষয়ক আইনের ওপর জোর দেওয়া হয়। আদালত ব্যবস্থাপনায় আইসিটির ব্যবহারও সবার জন্য মানসম্মত ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণে সহায়ক হয়।<br /> <span style="color: #0000ff;"><strong>লেখক : বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি< ভাষান্তর গাউস রহমান পিয়াস। সূত্র-কালের কণ্ঠ।</p>




Discussion about this post