নির্বাহী বিভাগ (প্রশাসন) থেকে বিচার বিভাগ আলাদা করার পরও সংক্ষিপ্ত বিচারসহ ফৌজদারি কার্যবিধির (সিআরপিসি) ১১টি ধারার ক্ষমতা ফিরে পেতে তৎপর জেলা প্রশাসকরা (ডিসি)। ডিসি সম্মেলন সামনে রেখে তারা সিআরপিসির ১১টি ধারা সংশোধনসহ আইন ও বিচার সম্পর্কিত ২০টি বিষয়ে সমস্যা চিহ্নিত করে তা থেকে উত্তরণের সুপারিশ করেছে। আগামী মাসের ২৬ থেকে ২৮ জুলাই ঢাকায় ডিসিদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা।
ডিসিদের সুপারিশগুলো নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের (মাঠ প্রশাসন সমন্বয় শাখা) সিনিয়র সহকারী সচিব ড. ফারুক আহম্মদ স্বাক্ষরিত একটি চিঠি গত ৩০ মে আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘১৫ কার্যদিবসের মধ্যে আইন মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় মতামত দিতে হবে। এ সময়ের মধ্যে মতামত না দিলে সুপারিশের বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের সম্মতি রয়েছে বলে গণ্য করা হবে।’
এ প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক শনিবার গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সুপারিশের চিঠি এখনও পাইনি। পাওয়ার পর ব্যবস্থা নেব।’ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের সংক্ষিপ্ত বিচারের ক্ষমতা চাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আগাম কিছু বলা ঠিক হবে না।’
সিআরপিসি সংশোধন নিয়ে ডিসিদের সুপারিশে বলা হয়, বিচার বিভাগ পৃথক্করণের পর মাঠ প্রশাসনের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখাসহ বিভিন্ন প্রশাসনিক কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনে বিঘ্ন সৃষ্টি হচ্ছে। এ জন্য নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮-এর ১৫৬ (আমলযোগ্য মামলার তদন্ত), ১৫৯ (তদন্ত বা প্রাথমিক অনুসন্ধান করার ক্ষমতা), ১৯০(১)(এ)(বি)(সি) (ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক অপরাধ আমলে নেওয়া তৎপরবর্তী কিছু ক্ষমতা), ১৯১ (আসামির আবেদনক্রমে মামলা হস্তান্তর), ২০২ (পরোয়ানা দান স্থগিত রাখা), ২৬০-২৬৫ (সংক্ষিপ্ত বিচারসংক্রান্ত বিভিন্ন ক্ষমতা) এবং ৫৩৯(ক) ধারার ক্ষমতা দিতে সংশ্লিষ্ট আইন সংশোধন করা প্রয়োজন।
এ ছাড়া মোবাইল কোর্টের আওতায় পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ ২০১২, পাবলিক পরীক্ষাগুলো (অপরাধ) আইন ১৯৮০, বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশ ১৯৫৯, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৯০সহ আটটি আইনের সংশ্লিষ্ট কয়েকটি ধারা সংশোধন করে মোবাইল কোর্টের কার্যক্রমকে আরও গতিশীল করা এবং ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রমে যুক্ত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও অন্যদের মূল বেতনের ৩০ ভাগ ঝুঁকি-ভাতা দেওয়ারও সুপারিশ করা হয়। ডিসিরা দাবি করেন, এসব ধারার ক্ষমতা না থাকায় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, এ সুপারিশের ভিত্তিতে মোবাইল কোর্ট আইন-২০০৯ সংশোধন করা হবে। এ জন্য নতুন আইনের খসড়া প্রণয়নের কাজ চলছে।
তবে আইনজ্ঞরা বলছেন, সংবিধান অনুসরণ করেই দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক করা হয়েছে। এ পর্যায়ে ফৌজদারি কার্যবিধি সংশোধন করে সংক্ষিপ্ত বিচারসহ অন্য যেসব ক্ষমতা ডিসিদের পক্ষ থেকে চাওয়া হয়েছে, তা অযৌক্তিক। কারণ, সংবিধান ও প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার সঙ্গে তা সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এ ছাড়া মোবাইল কোর্ট আইন-২০০৯-এর ১১টি ধারা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে একাধিক রিট বিচারাধীন রয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে সংশ্লিষ্ট আইন সংশোধন করা হলে নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগের মধ্যে সংকট তৈরি করবে। তারা আরও বলেন, আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ ও জনস্বার্থ রক্ষায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের কিছু ক্ষমতা দেওয়ার বিষয়টি উন্নত দেশগুলোতেও স্বীকৃত। কিন্তু সেই ক্ষমতারও সীমারেখা রয়েছে।
দীর্ঘদিনের দাবির পর ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর উচ্চ আদালতের রায়ে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে আলাদা করা হয়। এরপর সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী স্বাধীন বিচার বিভাগও প্রতিষ্ঠিত হয়। এতে নির্বাহী বিভাগের বিচারিক ক্ষমতা অনেকাংশে হ্রাস পায়। তবে মোবাইল কোর্ট আইন-২০০৯-এর আওতায় নির্বাহী বিভাগের ম্যাজিস্ট্রেটরা এখনও ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার মাধ্যমে ভেজালবিরোধী অভিযান পরিচালনা, ইভ টিজিং নিয়ন্ত্রণসহ কয়েকটি সুনির্দিষ্ট বিষয়ে বিচারিক ক্ষমতা প্রয়োগ করছেন। কিন্তু এর পরও বিচারিক ক্ষমতার প্রয়োগ নিয়ে কয়েক বছর ধরে নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগের মধ্যে প্রকাশ্যে ভিন্ন মত দেখা গেছে। চলতি বছরের ১০ জানুয়ারি নির্বাহী বিভাগ বিচার বিভাগের সব ক্ষমতা কেড়ে নিতে চাইছে বলে অভিযোগ করেছিলেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। এ চেষ্টা রুখতে তিনি আইনজীবীসহ বিচার বিভাগ-সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি আহ্বান জানান।
তবে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম গণমাধ্যমকে বলেন, বিচার বিভাগ-নির্বাহী বিভাগ কেউ কারও প্রতিপক্ষ নয়। এ দুটি বিভাগের সংশ্লিষ্টরা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে জনগণের স্বার্থে কাজ করেন। মোবাইল কোর্টকে আরও কার্যকর করতে আইন সংশোধন প্রয়োজন। তিনি আরও বলেন, জনস্বার্থে বিশ্বব্যাপী মোবাইল কোর্ট পরীক্ষিত। তাৎক্ষণিক বিচারের এ পদ্ধতি সঠিকভাবে প্রয়োগ করা হলে দেশের প্রচলিত আদালতে মামলাজটও অনেকাংশে কমবে।
আইন মন্ত্রণালয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মোবাইল কোর্ট আইন-২০০৯ সংশোধন বা ভ্রাম্যমাণ আদালতকে আরও কার্যকর করতে মন্ত্রণালয়ও একমত। তবে সেটি সংবিধান ও আইনের আলোকেই করা হবে। তাই ডিসিদের সুপারিশগুলো পর্যালোচনা করে দেখা হচ্ছে। তবে রিট বিচারাধীন থাকায় রায় হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা সমীচীন বলেও তারা মনে করেন।
মোবাইল কোর্ট আইন চ্যালেঞ্জ করে রিটকারী আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘বিশেষ ক্ষেত্রে এখনও কিছু ক্ষমতা নির্বাহী বিভাগের হাতে রয়েছে; তবে সেটি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। কারণ, বিচারবহির্ভূতভাবে কোনো ব্যক্তির জেল হওয়া সংবিধান ও আইন সমর্থিত নয়। হাইকোর্টে এ-সংক্রান্ত কয়েকটি রিট বিচারাধীন রয়েছে। উচ্চ আদালতের রায়ে এর চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হবে। এর আগে সংশ্লিষ্ট আইন সংশোধনের বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া ঠিক হবে না।’ সূত্র: আবু সালেহ রনি/সমকাল।




Discussion about this post