সাম্প্রতিক র্যাব প্রকাশিত নিখোঁজ ২৬১ জনের তালিকায় রংপুরের ৯ জন যুবকের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এদের মধ্যে ৬ জনই নিজ নিজ বাড়িতে অবস্থান করছেন। অন্যদিকে কাজের সূত্রে এক যুবক রয়েছেন পাকিস্তানের পাঞ্জাবে শহরে। আর বাকি দু’জনের একজন ৮ মাস ধরে কারাগারে, অন্যজন মানসিক রোগী।
এদিকে তালিকা প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে নিখোঁজের তালিকায় নাম থাকা ব্যক্তিদের পরিবারের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেই নিজের বা পরিবারের সদস্যদের নাম দেখে অবাক হয়েছেন। কেউ কেউ এ নিয়ে উদ্বেগও জানিয়েছেন।
তালিকা প্রণয়নে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ করেছেন একাধিক ‘নিখোঁজ’ ব্যক্তি এবং তাদের স্বজনরা। তালিকায় নাম থাকার খবর জেনে কেউ কেউ নিজেরাই পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। জানিয়েছেন, তারা কোথাও যাননি।
এই কথিত নিখোঁজদের খোঁজ না পেয়ে কারো কারো নামে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হয়েছিল স্থানীয় থানায়। পরে ফিরে আসা বা সন্ধান পাওয়ার পর পুলিশ কর্মকর্তাদেরকে মৌখিক বা লিখিতভাবে জানিয়েছিলেন সব। কিন্তু পুলিশ কর্মকর্তারা তাদের নথিতে তথ্য হালনাগাদ করেননি। আর এ কারণেই তাদের নাম উঠে এসেছে র্যাব প্রকাশিত নিখোঁজের তালিকায়।
এদিকে পুলিশের পক্ষ থেকে র্যাবের দেয়া নিখোঁজ তালিকা যাচাই বাছাই ও নতুন করে তথ্য দেয়ার কাজ চলছে বলে জানা গেছে। চলতি সপ্তাহের মধ্যেই এ তালিকা প্রকাশ করা হবে বলে জানিয়েছে রংপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (এএসপি)।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, তালিকার ১৫৭ নম্বরে থাকা রংপুরের সদর উপজেলার পালিচড়া গ্রামের আবু মিয়ার ছেলে শামীম মিয়ার সন্ধানে তার বাড়িতে গেলে তাকে পাওয়া যায়নি। তিনি ব্যক্তিগত কাজে বাইরে গেছেন বলে পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন। তবে তিনি নিখোঁজ নন, নিজের বাড়িতেই অবস্থান করছেন বলে জানান তারা।
অন্যদিকে তালিকায় ১৫৮ নম্বরে থাকা শায়েস্তা খাঁ রংপুর পুলিশ লাইন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করে কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজে অনার্সে ভর্তি হয়েছে। তার বাবা আব্দুল মনসুর খাঁ এখনো সেনাবাহিনীতে মেস ওয়ারেন্ট অফিসার হিসেবে কর্মরত।
রংপুর নগরীর ভগি বালাপাড়ায় তাদের বাড়িতে গিয়ে শায়েস্তা খাঁর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে তিনি বন্ধুদের সঙ্গে ঢাকায় বেড়াতে গিয়েছিলেন। বাসায় কাউকে না বলে যাওয়ার কারণে বাবা কোতোয়ালি থানায় জিডি করেন। এর চার থেকে পাঁচ দিন পর তিনি বাড়িতে ফেরার পর বিষয়টি কোতোয়ালি থানায় জানানো হয়।
এ ব্যাপারে শায়েস্তা খাঁর বাবা সেনা সদস্য সবুর খান জানান, তার ছেলে বাড়িতে ফেরার পর পুলিশকে জানানো হয়েছে। অথচ ছয় মাস পর তার ছেলেকে নিখোঁজ দেখানো হচ্ছে। এ নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করে সবুর খান বলেন, ‘এ ব্যাপারে পুলিশ তখনই পদক্ষেপ নিলে তাদের এ অবস্থার মধ্যে পড়তে হতো না।’
র্যাবের তালিকায় ১৫৯ নম্বরে থাকা এলজিইডির রোলার চালক মজিবুর রহমানের ছেলে রেজোয়ানুর রহমান। বাড়ি নগরীর বৈরাগিপাড়া মহল্লায়। তিনি রংপুর প্রেসক্লাব কমপ্লেক্সে একটি ফটোকপির দোকানে কাজ করেন।
রেজোয়ানুল জানান, বাসায় না বলে বন্ধুদের নিয়ে ঢাকায় বেড়াতে গিয়েছিলেন। সেখানে বেশ কয়েকদিন ছিলেন। তখন তার পরিবারের পক্ষ থেকে চলতি বছরের ১৬ মার্চ কোতোয়ালি থানায় জিডি করা হয়। তবে বাসায় ফেরার পর থানায় অবহিত করা হয়েছে কি না, তা তিনি জানেন না। তবে র্যাবের দেয়া নিখোঁজ তালিকায় তার নাম থাকায় পুরো পরিবার আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
র্যাবের তালিকায় ১৬০ নম্বরে থাকা ১৫ এমপি ইউনিটের কুক সেনা সদস্য শফিউল আলমের ছেলে সাঈদ হোসেন রংপুরেই তার বাবা-মার সঙ্গে অবস্থান করছেন বলে পুলিশ নিশ্চিত করেছে। অথচ তাকে নিখোঁজ দেখানো হয়েছে গত ৮ জুন।
এ প্রসঙ্গে শায়েস্তা খাঁর বাবা আব্দুস সবুর খাঁ বলেন, সাইদের বাবা আর আমি এক সঙ্গে কাজ করি। সাইদ বাবাকে না জানিয়ে বিয়ে করায় কিছু দিন আত্মগোপনে ছিল। ক’দিন পর বাবা-মা বিয়ে মেনে নেয়ায় সাইদ এখন বাড়িতেই অবস্থান করছে। চাকরিও করছে।
তালিকার ১৬১ নম্বরে থাকা সাব্বির আহাম্মেদ আনন্দ নগরীর ডিসির মোড় এলাকার বাসিন্দা। তার বাবা আলহাজ আশরাফ উদ্দিন। তার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, দ্বিতল বাড়িটি ভাড়া দেয়া হয়েছে মোস্তাফিজার রহমান নামের এক ব্যক্তির কাছে। তিনি আলোর ভুবন নামে একটি মাদক নিরাময় কেন্দ্র খুলেছেন।
ভাড়াটিয়া মোস্তাফিজুর রহমান জানান, আনন্দ এমনিতেই মানসিক রোগী বলে তিনি শুনেছেন। গত বছর এই বাসায় থাকাকালে কাউকে না বলে বাসা থেকে বের হয়ে যায় আনন্দ। অনেক খোঁজাখুজির পর তাকে চার থেকে পাঁচদিন পর খুঁজে বের করেন স্বজনরা। এ ঘটনায় ২০১৫ সালের ৯ নভেম্বর কোতোয়ালি থানায় জিডি করেন তার বাবা।
তিনি আরো জানান, আশরাফ উদ্দিন বেগম রোকেয়া ও কারমাইকেল কলেজের বাংলা বিভাগের প্রভাষক ছিলেন। অবসরে যাওয়ার পর পরিবার পরিজন নিয়ে চুয়াডাঙ্গায় চলে গেছেন। সেখানেই আনন্দ রয়েছে। তারা মাঝে মধ্যে এসে বাড়ির ভাড়া নিয়ে যায়।
অন্যদিকে তালিকায় ১৬২ নম্বরে থাকা নগরীর মাহিগঞ্জ কলাবাড়ি গ্রামের ওসমান আলীর ছেলে রেজাউল করিমের নাম নিখোঁজ তালিকায় থাকলেও, তিনি নিখোঁজ নন। তিনি আসলে মানসিক রোগী। মাঝে মাঝেই বাসা থেকে বের হয়ে যান। ২০১৫ সালে বেশ কিছুদিন খুঁজে পাওয়া না যাওয়ায় পরিবার থানায় জিডি করে। তিনি এখন বাসাতেই থাকেন বলে জানা গেছে। পুলিশও বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
তালিকায় ১৬৩ নম্বরে থাকা নগরীর মনোহরপুর পশ্চিমপাড়া মহল্লার মাহবুবুর রহমানের ছেলে ইকবাল হোসেনও নিখোঁজ নন। তিনি গত বছরের (২০১৫) ২৪ নভেম্বর থেকে রংপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে একটি নারী ও শিশু নির্যাতন মামলায় আটক রয়েছেন। মামলা নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন মামলা নম্বর ৫২০/১৫ইং।
এ ব্যাপারে রংপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিনি কারাগারে আটক আছেন। তার স্বজনরা জানান, তিনি ঢাকায় রডমিস্ত্রির কাজ করতেন। গত বছর ঢাকা থেকে রংপুরে আসার কথা বলে তিনি নিখোঁজ হন।
তার কোনও সন্ধান না পাওয়ায় পরিবার কোতোয়ালি থানায় জিডি করে। কিন্তু পরে তারা জানতে পারেন, রংপুরের দামোদরপুর গ্রামের এক মেয়ের সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক ছিল। তিনি ওই মেয়েকে রংপুর শহরে নিয়ে এসে বিয়ে করেছেন। বিষয়টি ওই মেয়ের পরিবার মেনে না নেয়ায় তারা পুলিশকে দিয়ে ইকবালকে গ্রেপ্তার করিয়ে তার নামে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে মামলা দায়ের করে।
এরপর গত ৮ মাস ধরে তিনি কারাগারে। নিখোঁজ তালিকায় নাম দেখে তারাও অবাক হয়েছেন।
নিখোঁজ তালিকায় ১৬৪ নম্বরে থাকা নগরীর আলম নগর কলোনির ইকবাল আহাম্মেদের ছেলে সাদাফ ইকবাল নিজ বাড়িতে বাবা-মার সঙ্গেই অবস্থান করছেন। তাদের বাসায় গেলে সাদাফ ইকবাল জানান, তিনি নিখোঁজ নন। গত বছর ২০১৫ রাগ করে বাড়ি থেকে ঢাকায় চলে গিয়েছিলেন। এক সপ্তাহ ছিলেন। তার মা তাকে ঢাকা থেকে নিয়ে আসেন।
সাদাফের মা নওশবা জানান, তার ছেলে নিখোঁজ হওয়ার পর তিনি কোতোয়ালি থানায় প্রথমে জিডি করেন এবং পরে একটি মামলা দায়ের করেন। মামলা নম্বর ১০, তারিখ ৩০/৭/২০১৫ইং। পরে ছেলে বাসায় ফিরে আসায়, তিনি মামলা প্রত্যাহার করেন। কিন্তু কেন এতোদিন পরেও তার ছেলের নাম নিখোঁজ তালিকায় রয়ে গেল, তা তিনি বুঝতে পারছেন না।
তালিকায় ১৬৫ নম্বরে থাকা রংপুর মহানগরীর পার্বতীপুর এলাকার আল-আমিনের ছেলে নজরুল ইসলাম (২৪) নিখোঁজ হন ২০১৫ সালের ১০ নভেম্বর। ৬ মাস আগে সে তার ফুপু রেশমি বেগমের সঙ্গে কাজের সন্ধানে পাকিস্তানের পাঞ্জাবে যান। মাস খানেক আগে মায়ের কাছে ফোন করেছিলেন ঈদে বাড়িতে আসবেন। কিন্তু আসেননি।
নজরুলের খালা নাজমিন নাহার জানান, নজরুলের বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করে অন্যত্র চলে যাওয়ার পর নজরুলের মা নার্গিস বেগম দুই ছেলে নিয়ে তাদের বাড়িতেই বসবাস করছেন। তার মা প্রাইম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আয়ার চাকরি করেন। নজরুল পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। তার বাবা রিকশা চালাত।
এদিকে নিখোঁজদের সার্বিক বিষয়ে কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এবিএম জাহিদুল ইসলাম বলেন, রংপুরে যে ৯ জন নিখোঁজ থাকার কথা বলা হয়েছে তাদের স্বজনদের পক্ষে কোতোয়ালি থানাতেই জিডি হয়েছে।
অন্যদিকে নিখোঁজ তালিকা প্রসঙ্গে রংপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (এএসপি) আব্দুল্লাহ আল ফারুক বাংলামেইলকে জানান, তাদের নিখাঁজের তলিকা চূড়ান্ত হয়ে গেছে। তালিকাটি যাচাই বছাই করা হচ্ছে। কেউ যাতে হয়রানি না হয় সেই বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।
তিনি আরো জানান, নিখোঁজদের মধ্যে অনেকে পারিবারিক মামলা মোকদ্দমায় জড়িয়ে গা ঢাকা দিয়েছে। অনেকে আবার প্রণয়সূত্রে বিয়ে করে গা ঢাকা দিয়েছে। আবার কেউ বাবা মাকে না জানিয়ে বাড়ি ছেড়েছে। সব বিষয়গুলো বিবেচনায় আনা হচ্ছে। এদের মধ্যে কারো জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা রয়েছে কি না তা গুরুত্ব সহকারে দেখা হচ্ছে। সুত্র বাংলামেইল
•র্যাব প্রকাশিত নিখোঁজদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা
আরো পড়ুন:




Discussion about this post