চার মাসে কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পাওয়া ২৮ জঙ্গি ও রাষ্ট্রবিরোধী মামলার আসামির বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। গত ২৮ জুলাই এ ব্যাপারে পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয়। কারা মহাপরিদর্শকের কাছেও একই নির্দেশনা গেছে। ওই নির্দেশনার সঙ্গে জামিনপ্রাপ্ত জঙ্গি ও উগ্রপন্থিদের একটি তালিকা এবং এ সংক্রান্ত একটি গোপন প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। গত ফেব্রুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত ৪ মাসে ওই ২৮ জন গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পায়। মুক্তিপ্রাপ্ত জঙ্গি ও রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডের আসামিরা নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, জেএমবি এবং হিযবুত তাহরীরের সদস্য।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে বলা হয়েছে, জামিনে কারাগার থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত জঙ্গিরা পুনরায় সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদসহ রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে নেটওয়ার্ক বিস্তার ও পরিকল্পনায় লিপ্ত রয়েছে। তারা আরও সতর্ক হয়ে কিংবা নতুন কৌশলে নেটওয়ার্ক তৈরি ও সমন্বয়ের কাজটি করতে পারে মর্মে আশঙ্কাও ব্যক্ত করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই নির্দেশনা পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স থেকে পুলিশের বিশেষ শাখা, সব রেঞ্জ ডিআইজি এবং সব পুলিশ কমিশনারের কাছে পাঠানো হয়েছে। ২৮ জনের জামিনে মুক্তির বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দাখিল করা এক গোপন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, জঙ্গি আসামিদের সঙ্গে তাদের আত্মীয়স্বজন কিংবা ওই পরিচয়ে অন্য কেউ সাক্ষাৎ করছে কিনা তা কোনো কারাগারেই ঠিকমতো যাচাই করা হচ্ছে না। শুধু সাক্ষাতের সময় পরিচয়পত্রের কপি রাখা হয়। যার দ্বারা সাক্ষাৎকারীর সঙ্গে আসামির সম্পর্কের কতটুকু সত্যতা রয়েছে তা যাচাই করা সম্ভব নয় মর্মে প্রতীয়মান।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দাখিল করা গোপন প্রতিবেদনে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের পাশাপাশি সারা দেশের সব কারাগারে আটকাধীন জঙ্গি সদস্য, শীর্ষ সন্ত্রাসী, জামায়াত-শিবির ও রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডে অভিযুক্ত আসামিদের জামিন, সাক্ষাৎকার, কোর্টে প্রেরণ ও হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণকালে কড়াকড়ি আরোপ এবং নজরদারি বাড়ানোর জন্য সুপারিশ করা হয়। সুপারিশ অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পুলিশ ও কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম বিভাগের এক কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেন, জামিন দিয়ে থাকেন আদালত। জঙ্গিদের জামিনের বিষয়ে আমরা আইনি লড়াইয়ের উদ্যোগ নিয়েছি। এ ছাড়া জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর তারা কী করছে, এ বিষয়েও খোঁজখবর করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী এলিনা খান গণমাধ্যমকে বলেন, গ্রেপ্তারের সংখ্যা বাড়লে জামিনের সংখ্যা বাড়বে, এটা অনেকটাই স্বাভাবিক বিষয়। কারণ দুর্ধর্ষ অপরাধীদের সঙ্গে অনেক সময় নিরপরাধ মানুষকেও গ্রেপ্তার হতে দেখা যায়। তা ছাড়া যে কোনো আসামির জামিনের শুনানিতে অভিযুক্তের পক্ষের আইনজীবীর সঙ্গে উপস্থিত থাকেন সরকারি কৌঁসুলিরা। তাদের বিশ্লেষণে পাওয়া তথ্য প্রমাণের ওপর ভিত্তি করেই আদালত জামিন প্রদান করেন অভিযুক্তকে। তাই সন্দেহভাজন এসব দুর্ধর্ষ অপরাধীর ক্ষেত্রে সরকারপক্ষের আইনজীবীর আরও সচেষ্ট হওয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি অপরাধ নিয়ন্ত্রণে জামিনপ্রাপ্তদের ওপর বাড়তি নজরদারি রাখতে হবে প্রশাসনকেও।
জানা গেছে, কাশিমপুর কারাগার থেকে ফেব্রুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত ৪ মাসে জামিন নিয়ে বেরিয়ে গেছেন- নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য সিকান্দার আলী নকি। তার বিরুদ্ধে বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে মামলা রয়েছে রাজধানীর তুরাগ থানায়, নম্বর ১২ ও ১৩ (৯)১৪। হিযবুত তাহরীরের অন্যতম সদস্য মো. ওমর শরীফ জামিন পান ৮ মে। আদাবর থানায় তার বিরুদ্ধে রয়েছে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা, নম্বর ২৩(৯)১৫। একই সংগঠনের সদস্য আবু বকর সিদ্দিকী ও মো. রাকীব হোসেন জামিন নিয়ে কাশিমপুর কারাগার থেকে বেরিয়ে যান ২ মে। হাজারীবাগ থানায় তাদের বিরুদ্ধে রয়েছে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলা, নম্বর ১১(১১)১৪। জেএমবির সদস্য মো. আহসান উল্লাহ জামিন পেয়েছেন ২৪ এপ্রিল। তিনি হাজারীবাগ ও রামপুরা থানার সন্ত্রাসবিরোধী এবং বিস্ফোরক দ্রব্য মামলার আসামি, নম্বরÑ ২৯(৯)১৪ ও ২৮(৯)১৪। হিযবুত তাহরীরের সদস্য মো. আনিসের বিরুদ্ধে সবুজবাগ থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা রয়েছে। তিনি জামিন পান গত ১৫ এপ্রিল। খিলগাঁও থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে করা মামলার (১৮(৩)১৫) আসামি ও হিযবুত তাহরীরের সদস্য মো. মমিনুর রহমান জামিন লাভ করেন ১৫ এপ্রিল। একই সংগঠনের সদস্য মো. সানি জামিন পেয়েছেন এর একদিন আগে অর্থাৎ ১৪ এপ্রিল। তার বিরুদ্ধে সবুজবাগ থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা রয়েছে। মামলা, নম্বর ১৯(৮)১৪। জেএমবির সদস্য মো. শফিকুল ইসলাম শফিক জামিন নিয়েছেন গত ৯ এপ্রিল। তার বিরুদ্ধে হাজারীবাগ ও রামপুরা থানায় রয়েছে বিস্ফোরক এবং সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা। নম্বর- ২৯(৯)১৪ ও ২৮(৯)১৪। হিযবুত তাহরীরের সদস্য রাউফুর রশীদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা (৭৪(৯)১৫) রয়েছে মোহাম্মদপুর থানায়। তিনি জামিন পেয়েছেন ৭ এপ্রিল। গত ৩১ মার্চ জামিন নিয়েছেন হিযবুত তাহরীরের তমিজ আহম্মেদ ও জেএমবির সাফায়েত জামিল। তাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে কলাবাগান, ধানমণ্ডি ও পল্টন থানায় রয়েছে একাধিক মামলা, নম্বর- ৭(১২)১৪, ১১(১২)১৪ ও ২৩(১০)১১। জেএমবির সদস্য নুরুল আমিন পল্টন থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে করা মামলার অন্যতম আসামি। মামলা নম্বর- ২৬(১২)১৩। তিনি জামিন লাভ করেন ২৯ মার্চ। হিযবুত তাহরীর সদস্য সাদিক সজীব বর্মন জামিন পেয়েছেন গত ২৯ মার্চ। তার বিরুদ্ধে উত্তরা থানায় রয়েছে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলা, নম্বর- ৩(১২)১৪। নুসরাত জাহান নামে হিযবুত তাহরীরের এক সদস্য জামিন নিয়েছেন গত ৯ ফেব্রুয়ারি। তার বিরুদ্ধে ডিএমপির ক্যান্টনমেন্ট থানায় রয়েছে সন্ত্রাবিরোধী আইনে মামলা, নম্বর- ৪(১০)১৫।
জানা গেছে, কারাগার থেকে জামিনের পর তাদের জঙ্গিসংশ্লিষ্ট মনোভাব ও উগ্রবাদিতার পক্ষে পরিবর্তন না হওয়ায় পুনরায় আরও কৌশলে জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ বিস্তারে জড়িয়ে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হতে পারে বলে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে আশঙ্কা করা হয়েছে।
আরও উল্লেখ করা হয়েছে, দীর্ঘ সময় কারাগারে থাকায় জামিনপ্রাপ্ত ওইসব আসামির সঙ্গে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান মুফতি জসীমউদ্দিন রাহমানী, জেএমবির প্রধান মাওলানা সাইদুর রহমান, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার আসামিসহ নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গিদের দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে এবং বিভিন্নভাবে মতবাদ পরিকল্পনা বিনিময়, শলাপরামর্শ ও বোঝাপড়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে জামিনে থাকায় তারা জঙ্গি সংগঠনের নেটওয়ার্ক বিস্তার পরিকল্পনা প্রণয়ন, অর্থ সংগ্রহ, প্রশিক্ষণ, রিক্রুটিং, আটককৃতদের জামিনের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি কাজগুলোর সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তারা ভূমিকা রাখছে কিনা, তা খতিয়ে দেখার পাশাপাশি কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। সূত্র: আমাদের সময়।
Discussion about this post