মিজানুর রহমান খান
আমাদের অধস্তন আদালতের বিচারকেরা মামলার ভারে জর্জরিত। তাঁদের বেতন-ভাতা কম। এমনকি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তুলনায়ও তাঁরা বঞ্চনার শিকার। তাঁদের সহায়ক লোকবল কম। একজন মধ্যম পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা যতটা সহায়ক লোকবল নিয়ে কাজ করেন, তার থেকে বিচারকেরা অনেক কম লোকবলের সহায়তায় বেশি কাজ করেন। বলা যায়, রাষ্ট্র তাঁদের সঙ্গে বিমাতাসুলভ আচরণ করছে। তাঁদের দালানকোঠা কম। বসার জায়গা পর্যন্ত নেই। একটি কর্মদিবসে তাঁরা এজলাস ভাগাভাগি করেন। অতিরিক্ত জেলা জজ, যাঁরা অতিরিক্ত সচিবদের সমমর্যাদাসম্পন্ন, তাঁদের গাড়ি নেই। কিন্তু একই সঙ্গে এটাই বাস্তবতা যে এই দুরবস্থা দ্রুত বদলে ফেলা যাবে না। কিন্তু একই সঙ্গে বিদ্যমান অবস্থায় কষ্টকর হলেও দেশ ও বিচারপ্রার্থী মানুষের দিকে তাকিয়ে মামলার বোঝা কমাতে হবে।
২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত আপিল বিভাগসহ সব ধরনের আদালতে অনিষ্পন্ন মামলার সংখ্যা ৩১ লাখ ৫৬ হাজার ৮৭৮। যে বছরটি সবে শুরু হলো, সেটি যখন শেষ হবে, তখন এর সঙ্গে আরও প্রায় ১০ ভাগ মামলা যুক্ত হবে। মোট মামলা দায়ের থেকে মোট মামলা নিষ্পত্তির হার কমেই চলছে। এই অবস্থার পরিত্রাণ চাইলে বিচারক ও তাঁদের সহায়ক লোকবল বাড়ানোর আগে ব্যবস্থাপনায় একটা বড় ধরনের পরিবর্তন আনা দরকার। এ ক্ষেত্রে সংবিধান হাইকোর্ট বিভাগকে যে দায়িত্ব নির্দিষ্ট করে দিয়েছে, তা যে সর্বতোভাবে পালিত হচ্ছে, সেটা প্রতীয়মান হওয়া দরকার। হয়তো এখানে আগের থেকে গতিময়তা এসেছে। কিন্তু সেটা আমাদের কাছে প্রতীয়মান হচ্ছে না। কারণ, হাইকোর্ট বিভাগে বর্তমানে ৯০ জন বিচারপতি আছেন। অধস্তন আদালতে সক্রিয় বিচারক আছেন ১ হাজার ৪০০। হাইকোর্টের বিচারপতিগণ গড়ে প্রায় ১৫ জন বিচারকের কার্যক্রম তদারক ও নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। এই তদারকটা পূর্ণমাত্রায় ক্রিয়াশীল হলে কী ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে, সে বিষয়ে আমজনতার তেমন কোনো ধারণা নেই। তবে ইউএনডিপির পূর্বাভাস সত্যি হলে তা গভীর উদ্বেগজনক। ২০২০ সালের মধ্যে মামলার জট ৫০ লাখে দাঁড়াবে। ২০২১ সালে বাংলাদেশ যখন মধ্যম আয়ের দেশ হবে, মামলার জটে আক্রান্ত জাতি বর্ধিত আয়ের সুখ কী করে বিনা উপদ্রবে ভোগ করবে?
প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা দুই বছর আগে যখন দায়িত্ব নিয়েছিলেন, তখন তিনি মামলার জট কমাতে তড়িঘড়ি কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। তবে ২০১৫ সাল একটি ব্যতিক্রম বছর। ওই বছরে যত মামলা করা হয়েছিল, সেই তুলনায় নিষ্পত্তির হারটাও কাছাকাছি ছিল। কিন্তু সেই প্রবণতা ধরে রাখা যায়নি। এখন দুটো বিষয় নিয়ন্ত্রণযোগ্য। একটি হলো অফিস সময় এবং অন্যটি হলো অযথা মামলার শুনানি মুলতবিকরণের লাগাম টানা। কোনো বিনিয়োগ বা নতুন আইনকানুন ছাড়াই এখানে বড় সাফল্য আনা কষ্টসাধ্য হলেও অসম্ভব নয়। এই অফিস সময় নিয়ে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা বিচারকদের জাতীয় সম্মেলনে উষ্মা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু তাতে অবস্থার খুব পরিবর্তন ঘটেছে বলে প্রতীয়মান হয় না। বার থেকে সহযোগিতা না করা হলে শুধু বিচারকেরা চাইলেই এই অবস্থা বদলাতে পারবেন না। মফস্বলে ১১টার আগে যদি পথের দূরত্বের কারণে কোর্ট কাজ শুরু করতে না পারেন, তাহলে আদালত–ব্যবস্থা থানা সদরে নিতে হবে।
মামলা নিষ্পত্তিতে বিলম্বের কারণ চিহ্নিত করতে অন্তত ২৮ বছর ধরে প্রধান বিচারপতিরা চেষ্টা চালিয়ে আসছেন। কিন্তু হাইকোর্ট বিভাগের এতে নেতৃত্ব দেওয়ার কথা। আমরা আমীর-উল ইসলামের সঙ্গে একমত যে এ জন্য হাইকোর্ট বিভাগকে একটি পৃথক সচিবালয় করে দিতে হবে। কিন্তু হাইকোর্ট বিভাগ সেই রকম দায়িত্ব পালনে অত্যন্ত উদ্গ্রীব, এমন তথ্য আমরা জানতে পারি না। সাবেক আইন ও বিচারমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু অবশ্য ১৬ কোটি মানুষের দেশে হাইকোর্টের আরও ১০০ বিচারক নিয়োগদানের পক্ষে। অবশ্য তিনি আমাদের বলেছেন, হাইকোর্টের দুজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারককে সার্বক্ষণিক তদারকিতে নিয়োজিত করা চলে। আমরা বলি, হাইকোর্টের বিচারক কত হবেন, সেটা প্রস্তাবিত কোনো নিয়োগের আগে নির্দিষ্ট করতে হবে। হাইকোর্ট বিভাগ সচিবালয় নিয়ে কত দূর কী করতে পারেন, সেটা বিচারপ্রার্থীরা প্রত্যক্ষ করতে উদ্গ্রীব।
১৯৮৯ সালে প্রধান বিচারপতির করা কমিটি অধস্তন আদালতের এই চিত্র এঁকেছিলেন: ‘বিচারকগণ একতরফা মামলাগুলো নির্দিষ্ট দিনে শুনানি না করে কোনো কারণ ছাড়াই অথবা “কোর্ট অন্য কাজে ব্যস্ত” এরূপ আদেশ লিখে দিনের পর দিন ফেলে রাখেন। যদিও ডায়েরি পরীক্ষা করে দেখা গেছে, কোর্টে আসলে ওই দিন উল্লেখযোগ্য কাজ হয়নি। এমনও দেখা গেছে যে বাদী একতরফা শুনানির তারিখে দিনের পর দিন এমনকি বছর ধরে সাক্ষীসহ উপস্থিত হন। কিন্তু কোর্টের ওই মামলার শুনানি হয় না। কখনো–বা একতরফা মামলা সাক্ষ্য গ্রহণ করা হলেও আদেশের জন্য তা মাসের পর মাস এমনকি বছর ধরে পড়ে থাকে। জেলা জজগণও একতরফা মামলাগুলো যাতে দিনের পর দিন স্তূপকৃত না হয়, তা রোধে কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেননি।’
টেলিফোনে এই অংশটি পড়ে শোনানোর পর আওয়ামী লীগের আইনবিষয়ক সম্পাদক আবদুল মতিন খসরু একে সাম্প্রতিক প্রতিবেদন ভেবেই মন্তব্য করেন। ২৮ বছর আগের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার পরও তিনি তাঁর মনোভাব বদলাননি। বলেছেন, ‘এটা বহু পুরোনো বাস্তবতা। যদি তা-ই হয়, তাহলে আমরা কেন এসব বিষয় আগে সুরাহা না করে বিচারকের সংখ্যা বাড়িয়ে সহজ সমাধানের দিকে হাঁটব।’
২০০৮ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৭৫ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ জন্য পুলিশ নিশ্চয় বহু ক্ষেত্রে দায়ী। তাই বিষয়টি নিয়ে সরকারের সঙ্গে হাইকোর্ট বিভাগের নিরবচ্ছিন্ন সংলাপ দরকার। সাম্প্রতিক কালে আমরা হাইকোর্ট বিভাগের এখতিয়ার অনুশীলন প্রশ্নে সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদের প্রতি দৃষ্টি করে চলছি। কারণ, ওই ৩১ লাখের মধ্যে বিচারাধীন মামলার জট সব থেকে বেশি লেগেছে জেলা জজ আদালতগুলোতে। সেখানেই মামলাজটের শতকরা বৃদ্ধি ১৩৫ ভাগ।
সংবিধানের এই অনুচ্ছেদ বলেছে, অধস্তন আদালতের বিচারকদের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ হাইকোর্ট বিভাগের ওপর ন্যস্ত থাকবে। আমরা বিস্মিত যে আমীর-উল ইসলাম এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে চললেও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা নীরবতা পালন করছেন বলে প্রতীয়মান হয়। ১৯৭২ সালের ১১ অক্টোবর পর্যন্ত ১০৯ অনুচ্ছেদটির খসড়া ছিল এ রকম, ‘হাইকোর্ট বিভাগের অধস্তন সকল আদালত ও ন্যায়পীঠের ওপর উক্ত বিভাগের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা থাকবে।’ তার অর্থ দাঁড়ায়, সংবিধানের প্রণেতারা এমন একটি হাইকোর্ট বিভাগ কল্পনা করেছিলেন, যাঁরা রিটসহ অন্যান্য বিচারিক দায়িত্বই নন, প্রশাসনিকভাবে জেলা জজদের নিয়ন্ত্রণও করবেন। যদিও ৪ নভেম্বরে ন্যায়পীঠ শব্দটি তুলে নেওয়া হয়। আবার ৭২ সালের ১০ জুন পর্যন্ত ১০৯ অনুচ্ছেদের খসড়ায় এই তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণের ভার ‘সুপ্রিম কোর্টের’ কাছে রাখা ছিল। সে কারণেই আমরা বলি, জেলা জজদের নিয়ন্ত্রণে ১১৬ অনুচ্ছেদ দ্বৈত শাসন তৈরি করলেও ১০৯ করেনি। অথচ তার কার্যকারিতা আমাদের কাছে প্রতীয়মান হয় না।
১৯৮৯ সালের ২২ নভেম্বর প্রধান বিচারপতির গঠিত কমিটির আরও একটি পর্যবেক্ষণ আজও প্রাসঙ্গিক। সেখানে আছে, ‘দু তরফা মামলার ক্ষেত্রে প্রথম শুনানির তারিখেই শুনানির ঘটনা বিরল। মামলা শুনানির জন্য তৈরি থাকলেও রুটিন হিসেবে বিচারকগণ প্রায় মামলা মুলতবি করে থাকেন।’ সেখানে সব সাক্ষীকে সময়মতো কোর্টে হাজির করতে ডিসি ও এসপিদের প্রতি নির্দেশনাও ছিল। বলা হয়েছিল যে ‘মামলা একটানা শুনানি করে নিষ্পত্তি করতে হবে এবং আংশিকভাবে শুনানি করার প্রবণতা পরিহার করতে হবে।’ অথচ আজও মামলাজটের এটাও অন্যতম কারণ। আমরা এসব সমস্যার অপনোদনে হাইকোর্টের কার্যক্রমের বিষয়ে রেকর্ড পেতে চাই। উদাহরণ দিই। সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদের আওতায় রিট মামলার রায় আমরা বিভিন্ন রিপোর্ট থেকে দেখতে পাই। অথচ একই সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদের আওতায় হাইকোর্ট বিভাগ কী সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন, তার কোনো বিবরণ কোথাও পাওয়া যায় না। এটা স্বচ্ছতার নীতির সঙ্গে যায় না।
প্রধান বিচারপতিকে ধন্যবাদ, তিনি এবারে হাইকোর্টের পরিপত্রগুলো এই প্রথম প্রকাশ করেছেন। ২০০৩ সালে হাইকোর্টের এক পরিপত্রে দেখি, একাধিকবার তাগিদপত্র প্রেরণ করা সত্ত্বেও নিম্ন আদালত হাইকোর্টকে নথি দেন না, এমনকি উত্তরও দেন না। ফলে সংশ্লিষ্ট মামলাগুলো শুনানির জন্য প্রস্তুত করা সম্ভব হয় না এবং মামলার শুনানিতে বিলম্ব ঘটে।
২০১১ সালের এক পরিপত্রও সাক্ষ্য দিচ্ছে, জেলা আদালতে আকস্মিক শুনানি মুলতবি একটি মস্ত ব্যাধি। প্রচলিত আইন ও বিধিবিধান নিম্ন আদালতের বিচারকেরা বেশ বড় মাপেই লঙ্ঘন করে চলেছেন। এতে বলা হয়, আদালত তাঁর নিজ উদ্যোগে বা পক্ষগণের আবেদনক্রমে যুক্তিসংগত কারণ ছাড়াই সাক্ষ্য গ্রহণ পর্যায়ে শুনানি মুলতবি করছেন। সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হলেও অধিকাংশ সময় ক্রমাগতভাবে সাক্ষ্য গ্রহণ না করে শুনানি মুলতবি করা হয় এবং কিছু ক্ষেত্রে একই সাক্ষীর সাক্ষ্য নিতে একাধিক তারিখ ধার্য করা হয়। যে বিচারক সাক্ষ্য নেন, তিনি রায় দিতে পারেন না। এর ফলে বিচারপ্রার্থী জনগণ দুর্ভোগের শিকার হন। হাইকোর্ট স্বীকারও করেছেন যে এর ফলে ন্যায়বিচার বাধাগ্রস্ত হয়।
২০১৫ সালের ২৯ জুলাই সুপ্রিম কোর্টের বর্তমান রেজিস্ট্রার জেনারেল সৈয়দ আমিনুল ইসলাম উল্লেখ করেছিলেন, বর্তমানে প্রায় ২৮ লাখ মামলা বিচারাধীন। এবং ক্রমান্বয়ে এ মামলার জট বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনার উন্নতি ঘটিয়ে এই অবস্থা যে কিছুটা সামাল দেওয়া সম্ভব, তা-ও তাঁর পরিপত্রে স্বীকৃত হয়। কারণ, কোথাও অতিরিক্ত মামলার বোঝা আবার কিছুসংখ্যক আদালতে মামলার সংখ্যা কম। এমনকি অল্পসংখ্যক মামলা থাকায় অনেক আদালত তাঁর মূল্যবান কর্মঘণ্টার সদ্ব্যবহার করতে পারেন না।
আমরা বিশ্বাস করি, আমীর-উল ইসলামের সুপারিশমতে মামলাজট নিরসনের বিষয়টিকে প্রধান বিচারপতি বনাম সরকার হিসেবে না দেখে হাইকোর্ট বিভাগ যদি ১০৯ অনুচ্ছেদে তার ওপর অর্পিত একচ্ছত্র এখতিয়ারের অনুশীলন শুরু করে, তাহলে মামলার জট হ্রাস ও চলমান টানাপোড়েন ঘোচাতেও তা সহায়ক হতে পারে।
লেখক: সাংবাদিক৷
Discussion about this post