‘বাবাকে গিয়ে বলবে জজ সাহেব স্কুলে যেতে বলেছে। আরও বড় হয়ে তারপর কাজ করবে’- খুনি সন্দেহে আদালতে উপস্থিত কামরাঙ্গীরচরের দুই শিশুর উদ্দেশে এভাবেই বলছিলেন হাইকোর্টের বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক।
এ বিষয়ে এক রিট আবেদনের শুনানিকালে গত ১৫ জানুয়ারি এই দুই শিশুকে আদালতে হাজিরের নির্দেশ দিয়েছিলেন বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি মোহাম্মদ উল্লাহর হাইকোর্ট বেঞ্চ। সে অনুযায়ী তাদেরকে আদালতে হাজির করা হলে, শুনানি শেষে আদালত কক্ষ ত্যাগের আগে রবিবার (২৯ জানুয়ারি) দুই শিশুকে একথা বলেন বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি।
একইসঙ্গে আদালত দুই শিশুকে মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত জামিন দিয়েছেন। তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে কামরাঙ্গীর চরের থানা পুলিশকে নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। বয়স নির্ধারণ না করেই দুই শিশুকে গ্রেফতার করে পুলিশ আইনের বরখেলাপ করেছে বলেও আদালত মন্তব্য করেন।
আদালতে এ দুই শিশু উপস্থিত ছিল। শিশুদের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার আব্দুল হালিম। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তাপস কুমার বিশ্বাস।
মামলা শুনানির শুরুতেই দুই শিশুকে উদ্দেশ্য করে আদালত বলেন, ‘বাবুরা এদিকে এসো। তোমাদের কি আদালতে আসতে ভয় লাগে? ভয়ের কিছু নাই। কি নাম তোমাদের? দুজন তাদের নাম ও বয়স জানায়।’ তারা জানায়, তাদের একজনের বয়স ৮ ও অন্যজনের ৯ বছর।
এ সময় রিটকারী আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুল হালিম বলেছেন, ‘ যে ছেলের খুনের অভিযোগে তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে, সেই লাশ বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়েছে। লাশটির বিষয়ে অভিযোগকারী নিজেই সন্তান হিসেবে পরিচয় নিশ্চিত হতে পারেননি। সেদিনই বলেছে, চিনতে পারছে না। অথচ পুলিশ জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি আদায় করেছে।’
এর প্রেক্ষিতে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তাপস কুমার বিশ্বাস বলেছেন, ‘তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগকারীর এফআইআর এর ভিত্তিতে স্বাভাবিক নিয়মে গ্রেফতার করা হয়েছে। ২০১৬ সালের ১১ অক্টোবরে দায়ের করা এফআইআর-এ দুজনেরই নাম ছিল। এদের নামে সরাসরি অভিযোগ ছিল।’
ব্যারিস্টার আবদুল হালিম বলেছেন, ‘২৯ সেপ্টেম্বর নিহত শিশুর নিখোঁজের পর সাধারণ ডায়েরি করা হয়। পরে বুড়িগঙ্গা নদীতে নিহতের ঘটনায় ৮ অক্টোবর একটি অপমৃত্যুর মামলা করা হয় কামরাঙ্গীরচর থানায়। বাদী উজ্জল কীভাবে বুঝল এটা তার সন্তানের লাশ?’
এ সময় শিশু আইনের ৪৪ ধারা বের করে দেখান আইনজীবী আবদুল হালিম। যেখানে বলা হয়েছে, শিশুদের কোনোভাবেই গ্রেফতার করা যাবে না। একান্তই যদি গ্রেফতার করতে হয় তবে বয়স নির্ধারণ করতে হবে।
আদালত তখন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করেন, ‘পুলিশ কেন তাদেরকে গ্রেফতার করল? ’
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বলেছেন, ‘এই ধারার পরবর্তী অংশে শিশু গ্রেফতারের কথা বলা আছে।’
জবাবে আদালত বলেছেন, ‘গ্রেফতার করতে হবে কেন? তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারতো। আগে বয়স নির্ধারণ করে তারপর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিল। শুধু তাই নয়, এসআই মো. আতাহার হোসেন তাকে শুধু গ্রেফতারই করেননি তাকে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দির জন্য ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে পাঠিয়েছেন। এর মাধ্যমে তিনি আইনের বরখেলাফ করেছেন।’
আদালত দুই শিশুকে প্রশ্ন করেন, ‘তোমরা কি কর?’ দুই শিশুর একজন বলে, ‘আমি গাড়িতে কাজ করি। অপরজন কিছু করে না।’ তবে দুজনের কেউই স্কুলে যায় না বলেও আদালতকে জানায়।
আদালত বলেন, ‘এতটুকু বয়স। ওদের তো এখন স্কুলে থাকার কথা। কিন্তু আজ এই শিশুদের কাজ করে খেতে হয়। আমাদের দেশের রাজনীতিবিদরা, সমাজপতিরা অনেক কথা বলেন। কিন্তু এসব বিষয় তাদের চোখে পড়ে না।’
আদালত বলেন, ‘রাষ্ট্রের তো দায়িত্ব ছিল এই শিশুদের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করা। এতটুকু বাচ্চারা কাজ করে এটা আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য লজ্জার। আমাদের সমাজ এর কি জবাব দেবে? সরকার এতো টাকা খরচ করে, এদিকে একটু গুরুত্ব দিলেই তো পারে।’
এ সময় আদালত আরও বলেন, ‘সরকার আইন করুক স্কুল টাইমে শিশুরা বাইরে ঘুরাফেরা করলে পুলিশ তাদের হেফাজতে নেবে। স্কুল টাইমে বাচ্চা শিশুদের ধরে নেওয়ার পর তাদের অভিভাবককে শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। এছাড়া এই শিশুদেরকে যারা কাজে নেবে তাদেরও শাস্তির আওতায় আনতে হবে। বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে এই ধরনের আইন আছে।’
উল্লেখ্য, গত ২৪ নভেম্বর একটি জাতীয় দৈনিকে ‘লাশের পরিচয় মেলেনি, খুনি সন্দেহে ২ শিশু গ্রেপ্তার’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদন যুক্ত করে রিট করা হয়।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রায় দুই মাস আগে পুলিশ অজ্ঞাত–পরিচয় এক শিশুর অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করেছিল। ১০ দিন পর লাশটি নিখোঁজ এক শিশুর দাবি করে শিশুটির পরিবার খুনের মামলা করে। খুনি সন্দেহে পুলিশ দুই শিশুকে গ্রেপ্তার করে।
বিচারিক হাকিম স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নিয়ে তাদের টঙ্গীর কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠান।বিষয়টি নিয়ে রিট করলে আদালতে দুই শিশুকে হাজিরের নির্দেশ দেন। আদালতের নির্দেশে রবিবার দুই শিশুকে হাজির করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।




Discussion about this post