গণধর্ষণের বিচার চাইতে গিয়ে নির্মম পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ভুক্তভোগী তরুণী ও তার মামাতো বোন। মামাতো বোনের অভিযোগ, পুলিশ ধর্ষকদের সঙ্গে আপস করতে চাপ দিয়েছে তাদের। রাজি না হওয়ায় দুই বোনের ওপর নেমে আসে নির্মম নির্যাতনের খড়গ। আসামি পক্ষের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের ঘুষ নিয়ে এমন অমানবিক কাজে নেমেছে পুলিশ। ঘটনাটি ঘটেছে নারীদের সেবায় গঠিত ঢাকা মহানগর পুলিশের উইম্যান সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনে। ছোট বোনকে পুলিশের হাত থেকে উদ্ধারে সংশ্লিষ্টদের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন মামাতো বোন।
জানা গেছে, কুপ্রস্তাব দিয়ে যৌন হয়রানি করছে একদল বখাটে যুবক এমন অভিযোগ করে রাজধানীর বনানী থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করার পরদিনই গণধর্ষণের শিকার হন ওই তরুণী (২৩)। ঘটনার কয়েক মাস পরও ধর্ষকরা ধরা না পড়ার বিষয়টি নিয়ে গত ১৪ মে একটি দৈনিক পত্রিকায় ‘জিডির পরদিনই গণধর্ষণ’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়, এলাকায় বীরদর্পে ঘুরলেও ধর্ষকদের গ্রেপ্তার করছে না পুলিশ। ধর্ষকদের হুমকিতে দিশাহারা মেয়েটির পরিবার। তার ভাইয়েরা এলাকায় থাকতে পারছে না। তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেওয়ার পাঁয়তারা করছে ধর্ষকরা।
পরে মামলাটি বনানী থানা থেকে ঢাকা মহানগর পুলিশের উইম্যান সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনে পাঠানো হয়। এরপর মামলার চার আসামির মধ্যে তিনজনকে গত মঙ্গলবার রাজধানীর তেজগাঁও এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এর পরপরই ঘটনা ভিন্ন দিকে মোড় নিতে থাকে।
প্রায় সপ্তাহখানেক আগে ভুক্তভোগী তরুণীকে নিজেদের কার্যালয়ে ডেকে নেন পুলিশের কর্মকর্তারা। এখনো সেখানেই রয়েছেন তিনি। এরপর ভুক্তভোগীর মামাতো বোনকেও ডেকে নেন পুলিশ কর্মকর্তারা।
গতকাল রাতে মামাতো বোন আমাদের সময়কে জানান, বনানী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোবাইল ফোনে তেজগাঁওয়ের উইম্যান সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনে ডেকে নেন। এ সময় তাকে বলা হয়, তিনি গেলে ধর্ষিতাকে ছেড়ে দেবে পুলিশ। কিন্তু গিয়েই বিপাকে পড়েন তিনি। একজন নারী পুলিশ কর্মকর্তা স্কেল দিয়ে তাকে পেটাতে থাকেন। গালিগালাজ করার পাশাপাশি কিল, ঘুষি ও থাপ্পড় মারতে থাকেন। কেড়ে নেওয়া হয় তার মোবাইল ফোন। তাকে তিন বছর বয়সী শিশুসন্তানের কাছেও যেতে দেয়নি পুলিশ। ধর্ষিতার ওপরও পুলিশ নির্যাতন চালাচ্ছে এমন দৃশ্য দেখেছেন তিনি। ধর্ষিতার পা থেকে কোমর পর্যন্ত মারের দাগ রয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। তাদের কোনো চিকিৎসাও দেয়নি পুলিশ। ঘটনার এমন বর্ণনা দেওয়ার সময় মাথায় ব্যান্ডেজ লাগানো ছিল ধর্ষিতার মামাতো বোনের।
ব্যথায় কাতর এই নারী ঠিক মতো কথাও বলতে পারছিলেন না। গতকাল সন্ধ্যায় পুলিশের হাত থেকে ছাড়া পান তিনি। বলেন, ‘আমাকে মেরে ফেলে রাখে তিনদিন। ডিসি আমাকে বারবার বলছিল, তুই সাক্ষী দিবি ধর্ষণের কোনো ঘটনা ঘটেনি। না হলে তোকে ছাড়া হবে না। আমার বোনকে তারা বলছে, সমঝোতা না করলে উল্টো তোর নামে মামলা দেব।’
তিনি দাবি করেন, ধর্ষকদের কাছ থেকে চার লাখ টাকা নিয়েছে পুলিশ। আর এ কারণে ধর্ষকদের বাঁচাতে তাদের ওপর নির্যাতন চালানো হচ্ছে। তার ওপর চালানো নির্যাতনের কথা সাংবাদিকদের বলবেন না এমন লিখিত দিয়ে ছাড়া পান তিনি। পুলিশের ভয়ে এখন নিজের বাসা ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন এই নারী।
তিনি আরও বলেন, আমার বোনটাকে এখন পুলিশের হাত থেকে ফিরিয়ে আনতে চাই। ধর্ষণের বিচার চাইতে গিয়ে এমন বিপদে পড়ব কোনোদিন ভাবিনি।
তবে এর আগে পুলিশ দাবি করেছিল, ধর্ষিতার মানসিক অবস্থা ভালো না থাকায় মেয়েটিকে এখানে রেখে কাউন্সেলিং করা হচ্ছে। তাকে মানসিক সাপোর্ট দিচ্ছে পুলিশ। এ ছাড়া মামলার কপি ও মেডিক্যাল রিপোর্টে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য আদালতে প্রমাণ করা কঠিন। তাই মেয়েটিকে নিজেদের কাছে রেখে সবকিছু প্রস্তুত করছেন তারা এমন দাবি পুলিশের বিশেষায়িত এই বিভাগ করে আসছিল। যদিও পুলিশের উইম্যান সাপোর্ট সেন্টারে যাওয়ার পর থেকেই মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে দেওয়া হচ্ছে না ধর্ষিতাকে। এমনকি তার স্বজনরা দেখা করতে গেলেও অনুমতি দেয়নি পুলিশ।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে গতকাল রাতে যোগাযোগের চেষ্টা করেও পুলিশের উইম্যান সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের ডিসি ফরিদা ইয়াসমিনকে পাওয়া যায়নি। তার মোবাইল নাম্বারে এসএমএস পাঠিয়েও কোনো সাড়া মেলেনি। পরে রাত সাড়ে ১১টার দিকে উইম্যান সাপোর্ট সেন্টারের এসির (প্রশাসন) সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘এটা ভিত্তিহীন খবর। এরকম কেউ আমাদের এখানে নেই।’
ঘটনার শিকার নারী বনানীর কড়াইল বস্তির বাসিন্দা। পোশাক শ্রমিক ওই তরুণীকে অনেক দিন ধরে এলাকার চিহ্নিত চার ক্যাডার কুপ্রস্তাব দিয়ে আসছিল। এক পর্যায়ে অতিষ্ঠ হয়ে গত ৩ মার্চ বনানী থানায় জিডি করেন তরুণী। জিডি করার পরদিনই তাকে জোর করে তুলে নিয়ে গণধর্ষণ করে চার বখাটে। অভিযুক্ত চার ধর্ষক হলো- ক্যাডার জুনায়েদ, আলী হোসেন, সোহাগ ও নাতিব আলী। তারা প্রত্যেকেই অবৈধ গ্যাস-বিদ্যুতের লাইনের কারবার করে। পুলিশকে নিয়মিত মোটা অঙ্কের টাকা ঘুষ দিতেন তারা। এ কারণেই থানা পুলিশ নীরব দর্শক ছিল বলে অভিযোগ করেছিলেন ভুক্তভোগী তরুণী। পরে অবশ্য তাদের মধ্যে জুনায়েদ, নাতিব আলী ও সোহাগকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
ধর্ষণের পরদিন সকালে অচেতন অবস্থায় রাস্তার পাশে ফেলে রাখা হয় তাকে। পরে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) ভর্তি করা হয়। সেখানে আটদিন চিকিৎসা শেষে থানায় মামলা করতে যান ঘটনার শিকার তরুণী। কিন্তু পুলিশ মামলা নেয়নি। ২৯ মার্চ ঢাকার সিএমএম আদালতে আইনজীবীর মাধ্যমে একটি নালিশি মামলা করেন ধর্ষিতা। আদালত গত ১৮ এপ্রিল বনানী থানার পুলিশকে মামলা নিতে নির্দেশ দেন। তবে এরপরও গড়িমসি করে প্রায় ১৪ দিন পর গত ২ মে মামলা নেয় পুলিশ।
এ বিষয়ে গতকাল রাত পৌনে ১২টার দিকে বনানী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আবদুল মতিন গণমাধ্যমকে বলেন, মামলাটি তদন্ত করছে উইম্যান সাপোর্ট সেন্টার। তারা আমাকে ভিকটিমের বোনকে ডেকে দিতে বলেন। আমি সেটিই করেছি। কারণ তিনি মামলার এক নাম্বার সাক্ষী। এরপর কী হয়েছে আমি জানি না।
-আমাদের সময়
Discussion about this post