সাঈদ চৌধুরী:
বাংলাদেশে নব্বই দশকের পর হঠাৎ নতুন করে শিল্পায়নে উন্নয়ন ঘটতে থাকে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, বিদ্যুতের অপর্যাপ্ততা, অনুকুল পরিবেশ না পাওয়ার কারণে শিল্পায়ন মাঝখানে কিছুটা ব্যহত হলেও বর্তমান বিশ্বে বাংলাদেশে শিল্পায়নের অবস্থা ঈর্ষনীয় । আমরা শিল্পে যে উন্নতি করেছি তা কিন্তু একদিনে নয় । শুনলে অবাক হবেন ৫০০ খ্রিস্টাব্দের পূর্বেও বস্ত্র, চিনি, লবণ ও অলঙ্কার রপ্তানিতে বাংলার অনন্য অবদান ছিল । মুঘল আমলে এসে বাংলার রপ্তানি খাতের আরও প্রাচুর্যতা বাড়তে থাকে ।তারপর ব্রিটিস আমলে ১৭৭৬ সালের দিকে তাঁত শিল্পে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল যথেষ্ঠ উন্নত । তখনকার সময়ে ঢাকা জেলায় বস্ত্রশিল্পে ১৪৬৭৫১ জন তাঁতি কর্মরত ছিলেন । সাধারনত কিছু অঞ্চল এই তাঁত শিল্পের জন্য বিখ্যাত ছিলো । তারমধ্যে রাজশাহীর মালদহ, হরিপল ও শ্রীপুর, ময়মনসিংহের বালিকুশি ও কাগমারি উল্ল্যেখযোগ্য । যদিও উপনিবেশিক আমলে এই শিল্পের কিছুটা হ্রাস হয় তবে পরবর্তিতে বৃটিশ আমলেই সরকারের বাণিজ্যিক নীতিমালার অধীনে বহিঃবিশ্বের সাথে বাংলার বস্ত্রশিল্পের বাণিজ্য চলতে থাকে এবং বিদেশি বণিকদের বাণিজ্যের অনুমতি দেওয়া হয়। ব্রিটিস শাসন আমলেই বাংলা চিনি রপ্তানি করতে সক্ষম হয় । তারপর পাকিস্তান আমলে এসে শিল্পের উন্নয়ন হলেও বাংলাদেশকে পেছনে ফেলার জন্য বেশিরভাগ শিল্প স্থাপন করা হয় পশ্চিম পাকিস্তানে । কিছু পরিসংখ্যানে এগুলো স্পষ্ট হয়ে যায় । যখন পশ্চিম পাকিস্তানে সিমেন্ট শিল্প গড়ে উঠেছিল ১৯ টি তখন বাংলায় গড়ে তোলা হয়েছিল মাত্র ৩ টি ।
স্বাধীনতা পরবর্তিতে এই অবস্থা পরিবর্তন শুরু হয় আস্তে আস্তে । ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর ২২৩ মিলিয়ন টাকা খরচ করা হয় রাষ্ট্রায়ত্ব শিল্প কারখানার পেছনে । এর মধ্যে ৭২টি পাটকল (৭৯,২০০ টন উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন), ৪৪টি বস্ত্রকল (১৩.৪ মিলিয়ন পাউন্ড), ১৫টি চিনি কল (১,৬৯,০০০ টন), ২টি সার কারখানা (৪,৪৬,০০০ টন), একটি ইস্পাত কল (৩,৫০,০০০ টন), একটি ডিজেল ইঞ্জিন ইউনিট (৩,০০০) এবং একটি জাহাজনির্মাণ কারখানা নিয়ে ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পখাতের কার্যক্রম আরম্ভ হয়।(সূত্রঃ উইকিপিডিয়া)
মূলত সেই থেকেই শুরু । এখন বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বড় একটি অংশ আসে পোষাক রপ্তানির মত প্রধানতম শিল্প খাত থেকে । গত দুটি অর্থ বছরে যখন অর্থনৈতিক মন্দা ছিল সারা বিশ্বের অর্থনীতিতে তখনও বাংলাদেশের অর্থনীতি আলাদাভাবে চাঙ্গা ছিল শুধুমাত্র মানুষের প্রধনতম অধিকারের একটি বস্ত্রখাত রপ্তানি করে ।
বাংলাদেশের এ সফলতা সত্যিই বিস্ময়কর । কিন্তু শিল্পায়নের ক্ষেত্রে আমাদের এ অগ্রযাত্রার সাথে সাথে প্রতিযোগীতায় টিকে থাকার মত শক্তিও অর্জন করা বড় চ্যালেজ্ঞ হয়ে যাচ্ছে দিন দিনই । অ্যাকর্ড অ্যালায়েন্সের মত সংস্থারা চাপ দিয়ে শ্রমিক অধিকার রক্ষার নামে অনেক ফ্যাক্টরীই তাদের কালো তালিকা ভুক্তির মধ্যে রেখেছে । প্রচুর পরিমান পোষাক শিল্প স্থাপনের কারণে এর সহযোগী অনেক কেমিকেল শিল্পও বাংলাদেশে দিন দিন বেড়ে চলেছে । পরিবেশ দুষনের স্বীকার হয়ে যাচ্ছে এদেশের শিল্প উন্নত এলাকার মানুষগুলো । ভূগর্ভস্থ্য পানি যেনতেনভাবে ব্যবহারের ফলে প্রচুর পানির অপচয় হচ্ছে যা পরিবেশকে অসহনীয় করে তোলার জন্য যথেষ্ঠ । ইতমধ্যেই এই পানির অভাব চৈত্র মাসে পুরোপুরি দৃশ্যমান হয়ে যায় । শুধু তাই নয় বাতাসে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সালফার ডাই অক্সাইড জাতীয় ভারী গ্যাসগুলোর আধিক্য !
সামনের দিনগুলোতে মানুষের স্বাস্থ্য ঠিক রেখে কাজ করানোর ব্যপারটি চ্যালেজ্ঞ হয়ে দাঁড়াতে পারে । পরিবেশ দুষনের কারণে বেড়ে যাচ্ছে বড় ধরনের অসুখের প্রবণতা, গ্রীন হাউজ গ্যাসের আধিক্যের কারণে বেড়ে যাচ্ছে পরিবেশ বিপর্যয়ের মত বড় ধরনের ধ্বংসাত্বক ব্যপারগুলো ।
একদিকে শিল্পকে রক্ষা করা অন্যদিকে বিভিন্ন ধরনের সমস্যাকে উতরে যাওয়া দুটো ব্যপারই চ্যালেজ্ঞের । পরিবেশ দুষন ও মানুষের স্বাস্থ্যের ব্যপারগুলো লক্ষ করে এক্ষনই যেটা করতে হবে সেটা হল সবুজ শিল্পায়ন সৃষ্টি । অর্থাৎ যে পানি ভূগর্ভ থেকে তোলা হচ্ছে তার অনেকবার ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে, গ্রিন হাউজ গ্যাস নিঃসরন করে এমন যন্ত্রের ব্যবহার কমিয়ে আনতে হবে, এনার্জি ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রতি বছর নির্দিষ্ট টার্গেট সেট পূর্বক তা কমিয়ে আনার ব্যপারে সচেতন হতে হবে, সোলার এনার্জি সিস্টেমের ব্যবহার বাড়াতে হবে, সকল বিশাক্ত বর্জ্যের সঠিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করন প্রক্রিয়া ঢালাওভাবে সাজাতে হবে ।
বাংলাদেশে কলাম্বিয়া ওয়াশিং প্লান্ট ও প্লামি ফ্যাশনের মত অনেকগুলো সবুজ ফ্যাক্টরী তৈরী হয়ে গেছে যা বিশ্বের বুকেও অন্যতম এবং এটা আমাদের জন্য একটি সবুজ সংকেত অবশ্যই ।
সবুজ শিল্পায়ন এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে শিল্পের বিকাশের সূত্র নিয়েই এখন সামনে এগুতে হবে । সফ্টওয়ার শিল্পের বিকাশ, ইল্ট্রেনিক শিল্পগুলোর প্রসারে অগ্রযাত্রা এবং গত কয়েক বছরে পোষাক খাতে উন্নয়ন সত্যিই আমাদের স্বপ্ন দেখায় । তবে এ উন্নয়নকে টেকশই উন্নয়নে নিয়ে যেতে হলে পরিবেশকে বাঁচাতে হবে, শিল্প কারখানা নির্মানের ক্ষেত্রে দুষন এড়িয়ে চলে যেভাবে সম্ভব সেভাবে শিল্প কারখানা নির্মানে এগিয়ে আসতে হবে ।
যদি গ্রিন ফ্যাক্টরী বেশি পরিমানে নির্মান করা যায় এবং নতুন নতুন শিল্প স্থাপনে এগিয়ে আসা যায় তবে বাংলাদেশ শিল্পউন্নত দেশ হতে খুব কম সময় নেবে এবং আমরাই হব বিশ্বের বুকে শিল্প উন্নয়নে আলাদা ধরনের সবুজ শিল্প সমৃদ্ধ দেশের সবচেয়ে বড় উদাহরন ।
Discussion about this post