বোমা মারলেও যার মুখ দিয়ে কথা বের হয় না, সেও এখন ফেইসবুক, ব্লগে আগুন ঝরা লেখা পোস্ট করে। তবে, আগুন ঝরা লেখা যেন অন্যকে আঘাত না করে সেই অবশ্য সবার নজর নেই। তাদের নজর না থাকলেও আইনের নজর রয়েছে তাদের উপর। বাস্তব জীবনে বা কোন ইলেক্ট্রনিক বিন্যাসে (ফেইসবুক, ব্লগ, টুইটার) কথা, লিখা অর্থাৎ মনোভাব প্রকাশ করার ক্ষেত্রে আইনে আপনার অধিকার এবং দায়িত্ব উভয় নিয়েই আজকের আলোচনা।
১৯৭১ সালে ৩০ লক্ষ প্রান দিয়ে আমরা স্বাধীন হয়েছি। স্বাধীন দেশে সব ধরনের স্বাধীনতা আমাদের রয়েছে। তেমনি একটি স্বাধীনতা হচ্ছে বাক-স্বাধীনতা। কাউকে কিছু বলতে না দিলে বা মত প্রকাশে বাধা দিলেই এক বাক্যে আমরা এর প্রতিবাদ করি যে, “আমারও বলার অধিকার রয়েছে, এটা আমার বাক-স্বাধীনতা”। কথা হচ্ছে, এই বাক-স্বাধীনতাটা কি, কোথা থেকে আসলো, কেন আসলো, এর শর্তাবলী আছে কি, থাকলে কি কি ইত্যাদির কিছুই কিন্তু আমাদের অধিকাংশেরই জানা নেই। যার কারনে আমরা অনেক সময় সরকারের বদনাম করি, সরকারকে বাকশাল বলে গালি দিই, দেশে স্বৈরশাসন চলছে বলে দাবি করি ইত্যাদি আরও অনেক অভিযোগ রয়েছে। সরকার কতটুকু সঠিক তা আমি মুখস্ত বলতে রাজি নই। আসুন আমরা আগে বাক-স্বাধীনতা সম্বন্ধে বিস্তারিত জানি, তারপর কার অবস্থান কোথায় তা বিবেচনা করব।
প্রথমেই পরিষ্কার করে বলতে চাই, বাক-স্বাধীনতা হচ্ছে আমাদের প্রত্যেক নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। আমাদের পবিত্র গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের তৃতীয় ভাগে অর্থাৎ ২৬ থেকে ৪৭ক অনুচ্ছেদ পর্যন্ত কেবল আমাদের মৌলিক অধিকার নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এখানে একটি কথা বলে রাখতে চাই, মৌলিক অধিকারের সাথে কোন মতেই মৌলিক চাহিদাকে মিলিয়ে ফেলবেন না। অনেক সময়ই দেখা যায়, অনেকেই মৌলিক অধিকারকে মৌলিক চাহিদা (অন্ন, বস্ত্র, খাদ্য, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা এবং বিনোদন) মনে করে, দুইটার মধ্যে ঘোল মিলিয়ে ফেলে, তাই বলছি মৌলিক চাহিদা হচ্ছে একান্তই আপনার নিজের প্রয়োজনগুলোকে বুঝায়। আপনার চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হলে অন্য কেউ এর জন্য দায়ী হবে না। কিন্ত, যখনই অধিকার বলা হবে, তখনই বুঝতে হবে এই অধিকারে উল্লেখিত সুযোগ-সুবিধা আপনি উপভোগ করতে না পারলে অন্য কেউ এর জন্য দায়ী হবে। আর সংবিধান থেকে আপনি যেসব মৌলিক অধিকার পাচ্ছেন, তার কোন একটি যদি আপনি অধিকার হিসেবে উপভোগ করতে না পারেন, তবে এর জন্য সরাসরি সরকার দায়ী হবেন। কারন, সরকার আপনাকে আপনার সাংবিধানিক মৌলিক অধিকারগুলো পূরণ করতে বাধ্য থাকবে। তাছাড়া সরকার যদি এমন কোন আইন পাস করে যা সংবিধানের মৌলিক অধিকারগুলো ভঙ্গ করে, তবে তাৎক্ষনিক ঐ আইনকে অসাংবিধানিক বলে বাতিল করা হবে। এই বিধান সরাসরি সংবিধানের ২৬ নাম্বার অনুচ্ছেদে বলা আছে। ২৬ নাম্বার অনুচ্ছেদে বলা আছে, “এই ভাগের (মৌলিক অধিকার) বিধানাবলীর সহিত অসমঞ্জস সকল প্রচলিত আইন যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, এই সংবিধান-প্রবর্তন হইতে সেই সকল আইনের ততখানি বাতিল হইয়া যাইবে। এবং রাষ্ট্র এই ভাগের কোন বিধানের সহিত অসমঞ্জস কোন আইন প্রণয়ন করিবেন না এবং অনুরূপ কোন আইন প্রণীত হইলে তাহা এই ভাগের কোন বিধানের সহিত যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইয়া যাইবে”। অর্থাৎ, কোন আইন যদি প্রচলিত থাকে বা রাষ্ট্র পাস করে যা, মৌলিক অধিকারের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ, সেই আইন বাতিল হবে, যদি আংশিক অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়, তবে যতটুকু অসামঞ্জস্যপূর্ণ ঠিক ততটুকু বাতিল হয়ে যাবে। এই পর্যন্ত আমরা এতটুকু নিশ্চিত হতে পারলাম যে, সংবিধান যেমন আমাদের মৌলিক অধিকার দিয়েছে, ঠিক তেমনি সংবিধান নিজেই এর রক্ষার দায়িত্বও নিয়েছেন। অতএব, মৌলিক অধিকার নিয়ে এখন আর আমাদের কোন ঝামেলা নেই।
এখন আসা যাক, বাক-স্বাধীনতা। আমাদের সংবিধানের ৩৯(২) নাম্বার অনুচ্ছেদে আমাদের বাক-স্বাধীনতা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। ৩৯(২) অনুচ্ছেদে বলা আছে, “রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে
(ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক্ ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের, এবং
(খ) সংবাদ ক্ষেত্রের স্বাধীনতার,নিশ্চয়তা দান করা হইল।”।
তর্জমা করলে বলা যায়, যে যে পয়েন্ট গুলোতে যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ রয়েছে সেগুলো ছাড়া বাকী কোথাও আপনাকে কেউই কোন প্রকারের বাধা দিতে পারবে না। এমনকি সংবাদ মাধ্যমকেও একই সুবিধা দেওয়া হয়েছে।
এবার আসুন, যে যে বিষয়ে বাধা-নিষেধ তা নিয়ে আলোচনা করা যাক।
রাষ্ট্রের নিরাপত্তাঃ রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ক্ষুণ্ণ হতে পারে এমন কিছু বলে, লিখে বা অন্য কোন ভাবে প্রকাশ করা অবশ্যই রাষ্ট্রের নিরাপত্তা তথা জনগণের নিরাপত্তার জন্য হুমকি স্বরূপ হতে পারে। তাই, বাক-স্বাধীনতা চর্চা করতে গিয়ে কোন মতেই রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ক্ষুণ্ণ হতে পারে এমন কিছু প্রচার বা প্রকাশ করা যাবে না।
বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কঃ ভারত, পাকিস্থান, আমেরিকা ইত্যাদি বিদ্বেষী লোকের অভাব নেই আমাদের দেশে। আমরা এই বিদ্বেষীরা সর্বদা ঐ দেশগুলোর সমালোচনায় ব্যস্ত থাকি। ভারত বাংলাদেশের সাথে কোন চুক্তি বা আলাপ আলোচনা করলেই আমরা সরকারের সাথে ভারতের আঁতাত আছে বলে সমালোচনা করি। তেমনি পাকিস্থান, আমেরিকার ক্ষেত্রেও ঘটে। কিন্তু, পাঠকের একটি কথা মাথায় রাখতে হবে যে, বর্তমান পৃথিবীতে একা বসবাস করা যায় না। সকল দেশের সাথে যোগাযোগ রাখা বাধ্যতামূলক। আর সেই ক্ষেত্রে প্রতিবেশী(ভারত, পাকিস্থান ইত্যাদি) দেশের সাথে একটু বেশীই হতে পারে। তাই বলে বাক-স্বাধীনতা ঊহ্য থাকবে না। তবে, এমন কোন তথ্য, সংবাদ প্রকাশ কিংবা প্রচার করা যাবে না যাতে বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের অবনতি ঘটে।
জনশৃঙ্খলাঃ জনশৃঙ্খলা বলতে গেলে আইনশৃঙ্খলাও চলে আসে। এমন কোন খবর বা উক্তি প্রকাশ কিংবা প্রচার করা যাবে না যার ফলে জনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে। অনেক সময় অনেক সত্যও গোপন রাখতে হয় জনশৃঙ্খলার স্বার্থে। এখন আপনি বলতে পারেন সত্য বলার অধিকার আমার আছে, হ্যাঁ আপনি সঠিক। কিন্তু, আপনার একটি সত্য যদি জনশৃঙ্খলা হুমকির মুখে পড়ে তবে তার দায় ভার কি নিবেন আপনি?
তাছাড়া, ইংরেজিতে একটি কথা আছে, Logic never goes above the law. অর্থাৎ যুক্তি আইনের উর্দ্ধে নয়। যা আইন তা মানতে আপনি বাধ্য। তাই, সত্য হলেও তা চেপে যেতে হবে।
শালীনতাঃ অবশ্যই অশ্লীল কথাবার্তা বলা, লিখা, প্রচার ইত্যাদি সবই সমাজ বিরোধী। তাই, এটাকে আপনার বাক-স্বাধীনতা বলে চর্চা করতে পারবেন না।
নৈতিকতাঃ নৈতিকতার উপর নির্ভর করেই আইন তৈরী করা হয়েছে। কিন্তু, আইন এবং নৈতিকতার মধ্যে বিরাট একটা পার্থক্য রয়েছে। সেটা হচ্ছে, আইন ভঙ্গ করলে শাস্তির বিধান রয়েছে, কিন্তু নৈতিকতা ভঙ্গের জন্য কোন শাস্তির বিধান নেই। কিন্তু, নৈতিকতা বিরোধী কোন কিছু বলা, লিখা বা প্রকাশ করা হবে বাক-স্বাধীনতা অপব্যবহার।
আদালত–অবমাননাঃ আদালতের কোন রায় থেকে শুরু করে চলমান কোন মামলা নিয়ে কোন প্রকার নেতিবাচক মন্তব্য প্রকাশ করলেই তা সাধারণ দৃষ্টিতে অন্যায় হিসেবে বিবেচিত হবে। তাই এই ব্যাপারে কোন প্রকার মন্তব্য করা বাক-স্বাধীনতা চর্চা নয় বরং এর অপব্যবহার। আর এমন কিছু করলে তা অবশ্যই আইনের অধীনে বিচারযোগ্য হবে।
মানহানিঃ মানহানি হচ্ছে বাক-স্বাধীনতার সবচেয়ে বড় নেতিবাচক দিক। কেননা, বাক-স্বাধীনতা চর্চা করতে গিয়ে প্রতিনিয়তই আমরা ভুল পথে পা বাড়াই, যা অন্যের মানহানিকর হয়ে পড়ে। তাই, বাক-স্বাধীনতায় প্রবেশের আগে সংক্ষেপে আসুন মানহানি সম্বন্ধে জেনে নিই।
যার মান আছে, কেবল তারই মানহানি হতে পারে। মান নেই এমন কারো মানহানি হওয়াটা অনেকটাই ঘোড়ার ডিমের মত। যেমন আমি একজন চোর, আপনি আমাকে চোর বলে সম্বোধন করলেন; এখন আমি যদি বলি আপনি আমার মানহানি করেছেন সেটা কেবলই হাস্যকর ছাড়া আর কিছু নয়। চোরকে চোর বলার বাক-স্বাধীনতা আপনার রয়েছে। কিন্তু একজন নির্দোষ ব্যক্তির উপর আপনি কখনও দোষ চাপিয়ে দিতে পারেন না। এটা আপনার বাক-স্বাধীনতা হলেও তা অন্যের মানহানি হচ্ছে। তারপরও আপনি বাক-স্বাধীনতা চর্চা করলে আপনার বিরুদ্ধে মানহানির চার্জ আনা যাবে। প্রমানিত হলে শাস্তিও পেতে পারেন। এই মানহানিটা অনেক ধরনের হতে পারে। যেমন, আপনি একজন সুস্থ লোককে এইডস রোগী বলে সংবাদ মাধ্যমে বা প্রকাশে বলে বেড়ালেন; এতে অবশ্যই তার মানহানি হয়েছে। আবার, একজন মুক্তিযোদ্ধাকে বা রাজাকার নয় এমন কাউকে রাজাকার বলে বেড়ালেন, তাহলেও আপনি ঐ ব্যক্তির মানহানি করেছেন বলে ধরে নেওয়া হবে এবং এটা আপনার বাক-স্বাধীনতা নয় বলে আখ্যায়িত হবে।
অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনাঃ প্ররোচনার সাথে আমরা সবাই পরিচিত। কিন্তু, সেই প্ররোচনা যদি হয় অপরাধ সংঘটনের এবং তা যে কোন মাধ্যমেই হোক না কেন, তা হবে বাক-স্বাধীনতার অপব্যবহার। এমন প্ররোচনা যদি কেউ দিয়ে থাকে তবে তার জন্য তাকে আইনানুগ শাস্তি দেওয়া যাবে। কেননা, বাক-স্বাধীনতার নামে প্ররোচনা দিয়ে অপরাধ সংঘটন রাষ্ট্রের শান্তি নষ্ট করা ছাড়া আর কিছু নয়।
এই হল মূলত সংবিধান থেকে প্রাপ্ত বাক-স্বাধীনতা এবং এর কতিপয় শর্তাবলী। তবে, যে যে গ্রাউণ্ডে বাক-স্বাধীনতার অপব্যবহার করবেন, তাকে স্বীয় স্বীয় আইনের অধীন শাস্তি প্রদান করা হবে। প্রতিটি শাস্তি নিয়ে অন্য একদিন আলোচনা হবে, আজ এখানেই একটি একটি বিধান দিয়ে শেষ করছি। কমন ল’তে একটি বিধান আছে, ইংরেজিতে একে বলে Where there is a right, there is a duty/responsibility. অর্থাৎ, আইন যখনই আপনাকে একটি অধিকার দিচ্ছে সাথে সাথে আপনাকে কিছু দায়িত্বও দিয়ে দিবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আমাদের দেশে সবাইকে না দিলেও আমেরিকাতে ব্যক্তিগত আত্নরক্ষার জন্য সবার অস্ত্র রাখার আইনত অধিকার রয়েছে। আমেরিকায় এই অধিকার দেওয়ার সাথে সাথে একটি দায়িত্বও দিয়ে দিয়েছে যে, যাতে কোন নির্দোষ ব্যক্তির উপর এই অস্ত্র ব্যবহার করা না হয়। কোন নির্দোষ ব্যক্তি এর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হলে, তাকে অবশ্যই আইনের অধীন বিচার করা হবে। অর্থাৎ, এর অপব্যবহার যেন না হয়। ঠিক তেমনি, সংবিধান বাক-স্বাধীনতাকে আপনার একটি অধিকার হিসেবে দিয়েছে, সাথে সাথে আপনাকে দায়িত্বও দিচ্ছে। আপনি কেবল রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা ইত্যাদিতে বাধা নিষেধ গুলো মাথায় রেখে আপনার বাক-স্বাধীনতা চর্চা করুন কেউই আপনাকে কোন প্রকারের বাধা প্রদান করবে না, এমনকি সরকারও না। আর যদি বাধা দেওয়া হয় কেবল তখনই আপনি সরকারকে বাকশাল বলতে পারবেন, অন্যথায় নয়। তাই বলছি, শুধু শুধু সরকার বা অন্য কাউকে মুখস্ত দোষ না দিয়ে আসুন আপনিই নিজেই এখন বিবেচনা করুন বাক-স্বাধীনতা আর বাকশালে কার অবস্থান কোথায়?
লেখকঃ তানভীর চৌধুরী, আইনের ছাত্র
Discussion about this post