প্রতিদিনই অজশ্র ঘটনার সম্মুক্ষীন হই আমরা । আমরা এখন আমাদেরকে অনেকটাই গুটিয়ে নিয়েছি । অনেক ঘটনাই শুনি না বা শুনতে চাই না । এর পেছনেও নিজেকে ভালো রাখারই প্রয়াস । কিন্তু এ রকম বৈশিষ্ট্য অর্জন করতে গিয়ে যে আমরা আমাদের অধিকারগুলোকেই হারাচ্ছি তা কি অনুভব করছি কখনও ? কিছু কিছু ব্যপার এড়িয়ে যাওয়া যায় না । এটা একটা দায়বদ্ধতারই জায়গা ।
খুব কাছের একজন মানুষের আত্নীয়র একটি সমস্যার কথা শুনতে গিয়ে হাহাকার মিশ্রিত নিঃশ্বাস ফেলতে হল আবার । সুন্দর একটি সংসারে সুন্দর ফুটফুটে একটি মেয়ে সন্তন আছে এই দম্পত্তির । যেদিন বিয়ে হয়েছিল এই দম্পত্তির সেদিন সারা গ্রামের মানুষকে দাওয়াত দেয়া হয়েছে । ধুমধাম বিয়ের পর সংসার করার শুরু তারপর সুন্দর একটি কন্যা সন্তান । আস্তে আস্তে যখন বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে দম্পত্তির মধ্যে কলহ সৃষ্টি হল তখনই কেবল মানুষ জানলো ছেলেটি নেশায় আসক্ত । ঘরে কন্যা সন্তান আর প্রতিদিনই সে বাবার নেশা করে ঘরে ফেরা । স্ত্রী বিষয়টি মেনে নিতে পারেনি । এক সময় ডিভোর্স দিতেও বাধ্য হয় সে । মেয়েকে নিয়ে নিজে ডিভোর্স দিয়ে চলে আসার পর একজন নারীর যে অপ্রাপ্যতা যদি সে আইনের দ্বারস্থ না হয় সে ক্ষেত্রে কতটা করুণ তা আমরা বুঝতেই পারি । মেয়েটিকে নিয়ে শুরু হয় এই নারীর কষ্টের পথচলা ।
আইন আছে ভরণ পোষনের কিন্তু কতজন মানুষ তা পেয়ে থাকে সেটা দেখার বিষয় । আইনের দ্বারস্থ হলেই কেবল আইনের সুবিধা আর না হলে তা চাপা পড়ে যাওয়া । নারীর জীবনে একা চলতে গিয়ে বাচ্চা মেয়েটিকে সে যখন হোঁচট খেতে থাকে তখনও সে প্রচন্ড রকম ধৈয্য নিয়ে পথ চলে । শিশুটি ততদিনে তৃতীয় শ্রেণীতে উঠে যায় । ফুটফুটে বাচ্চাটি বাবার অভাব বোধ করে মায়ের বুকে মুখ লুকিয়ে ঘুমিয়ে দিন কাটাতে থাকে । সময়গুলো বিষাদে ভরে থাকলেও যেন দাঁতে দাঁত লেগেই সময় কাটাতে হবে ।
নারীরা আমাদের সমাজে তথাকথিত অসহায় বলেই পরিবারের চাপে আবার বিয়ে করতে বাধ্য হয় অনেক সময়! এ নারীর বেলায়ও ব্রতিক্রম ঘটেনি । আবার বিয়ে হল ধুমধাম করে । সংসার শুরু হল নতুন স্বপ্ন নিয়ে । নতুন স্বামীর ঘরে নতুন নতুন সব মানুষ । নারীর আগে বিয়ে হয়েছিলো বলে এমনিতেই কিছু মানুষের চোখ বাঁকা চাহুনী প্রথম দিন থেকেই শরু ! বিশেষ করে পাড়া পড়শি নারীরাই নারীদের বেশী কটাক্ষ করে থাকে এ বিষয়গুলোতে । এখানেও ব্যতিক্রম হয়নি । আস্তে আস্তে বোঝায় পরিনত হয়ে উঠতে থাকলো বাচ্চা মেয়েটি । কি নিস্পাপ মেয়েটিকে শশুর বাড়ির সবাই আড় চোখে দেখতে লাগলো । মায়ের কাছে ছোট্ট মেয়েটিই যেন এখন সবচেয়ে দূরের মানুষ !
এই অসহায় মা গুলোর আসলে কিইবা করার থাকে । অসহনীয় যন্ত্রনায় এক সময় মায়ের বিছানা থেকেও শিশুটিকে সরে আসতে হয় । তারপর নতুন শাশুরির বার বার একটি কথাই মনে করিয়ে দেয়ায় এক সময় মা নিজেই সিদ্ধান্ত নেয় শিশুটিকে আর তার কাছে রাখবে না । শিশুটিকে একদিন তার নানু বাড়িতে নিয়ে রেখে আসে আর বলে আসে মা তুই কয়েকদিন বেড়িয়ে তারপর আবার আমার কাছে আসিস । মেয়েটিও বুঝতে পারে আর তার মায়ের বুকে ঘুমানো হবে না কখনও । ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে শিশুটি মাকে বিদায় দেয় । শিশুটির বাবা নেশা করে করে জীবনের সব হারিয়ে শিশুটির খরচ দেওয়ার ক্ষমতাও হারিয়ে নিঃশ্ব বলে শোনা যায় আর এদিকে মায়ের আদরও বঞ্চিত শিশুটি পড়াশোনা করে যেতে থাকে নিভৃতে ।
এরকম শিশুদের সংখ্যা কিন্তু দিন দিনই বাড়ছে । ঢাকাতে ব্রেক আপের সংখ্যা আরও বেশী । সিঙ্গেল মাদার অথবা সিঙ্গেল ফাদার শব্দটি যেদিন থেকে অভিধানে ঢুকেছে সেদিন থেকেই আরও একটা সমস্যার নামও সৃষ্টি হয়েছে তা হল “লোনলি চিলড্রেন” । যে বিষয়টি এখনও না জানা তবুও লোনলি চিলড্রেনের দায়িত্বও একদিন এ সমাজকে বইতে হবে !
আইনগত অধিকার বলে শিশুটি বাবার কাছ থেকে ভরণ পোষন পাওয়ার অধিকার রাখলেও তা থেকে যেমন সে বঞ্চিত তেমনি সে বঞ্চিত মায়ের নতুন শশুর বাড়ির অধিকার পাওয়া থেকেও । শিশুটির মায়ের নতুন শিশু এসেছে আবার । মায়ের বুকে আবার শিশুতে পরিপূর্ণ কিন্তু এই শিশুটি ?
মায়ের আদর পাওয়ার অধিকার এ শিশুটিও রাখে । যদি অধিকার রেখেই থাকে তবে শিশুটির মায়ের কাছে থাকার অধিকার আইনগতভাবেই থাকা উচিৎ বলে মনে করি । আইন সংশোধন করে হলেও নতুনভাবে এ বিষয়টি আইনে সংযুক্ত করা প্রয়োজন । দ্বিতীয় বিবাহের পর কোন নারী চাইলে তার আগের সন্তানকেও সে সাথে রাখতে পারবে এবং এটা তার অন্যান্য অধিকারের মতই অধিকার ।
যখন একটি সংসারের সৃষ্টি হয় তখন সব কিছু মেনেই দুজন সিদ্ধান্ত নেয় তারা একসাথে থাকবে । তবে কেন শিশুগুলোর এ বঞ্চনা ?
যদি এই শিশুগুলো এভাবে বঞ্চিত হতে থাকে তবে হতাশ মানুষের সংখ্যা বাড়বে, পরিবার বিচ্ছিন্নতা বাড়বে, বাড়বে অস্থিরতাও । এক সময় এ শিশুটি পরিবার প্রথাকে ঘৃণা করতে করতে ভাবতেই পারে একাকী জীবনই ভালো এবং তখনইতো পরিবার প্রথা বিলীনের প্রশ্ন এসে যাবে আর তখনই সামাজিক অস্থিরতা আরও বাড়তে থাকেব !
প্রতিটি অধিকার বঞ্চনাই একেকটা অপরাধ প্রবনতা বাড়ার কারণ । শিশুদের অধিকার রক্ষায় এই আইনটি কিভাবে করলে আরও সুরক্ষিত আইন হবে তা ভাববার সময় এসেছে বুঝি । আমি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টি আশা করছি এ বিষয়ে ।
সাঈদ চৌধুরী
সদস্য, উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি
ও রসায়নবিদ
শ্রীপুর, গাজীপুর
Discussion about this post