নিজস্ব প্রতিবেদক: বড় জয় নিয়ে আবারো সরকার গঠন করছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট। রবিবার অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভূমিধস জয় পেয়েছে তারা। ফলে টানা তৃতীয় বারের মতো সরকার গঠনের সুযোগ থাকছে আওয়ামী লীগ সভাপতি এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার।
২৯৯ আসনের মধ্যে ২৯৮টির ফল পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ২৬৫ আসনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীরা জয়লাভ করেন। এ রায়ের মধ্য দিয়ে দেশে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখার ম্যান্ডেট পেল আওয়ামী লীগ। অপরদিকে বিএনপি ৭ আসনে বিজয়ী হয়েছে। জাতীয় পার্টি পেয়েছে ২২টি আসন। গণফোরামের উদীয়মান সূর্য নিয়ে নির্বাচন করে একজন বিজয়ী হয়েছেন। জাতীয় পার্টি (জেপি) একটি আসনে জয়লাভ করে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের ফল ঘোষণা করা হয়নি।
স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন ২ জন। রবিবার দেশের ২৯৯টি আসনের ভোট গ্রহণ শেষে সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তারা বেসরকারি এ ফল ঘোষণা করেন। নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয় থেকেও প্রকাশ করা হয়।
এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দল, জাতীয় পার্টি, যুক্তফ্রন্ট নিয়ে মহাজোট গঠিত হয়। মহাজোটভুক্ত হয়ে নির্বাচন করলেও জাতীয় পার্র্টি তাদের নিজস্ব প্রতীক লাঙ্গল এবং জাতীয় পার্টি (জেপি) সাইকেল প্রতীক নিয়ে ভোট করে।
অন্যদিকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোটের শরিকরা ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচন করে। তবে এলডিপির কর্নেল অলি আহমদ তার দলীয় প্রতীক ছাতা প্রতীক নিয়েই মাঠে ছিলেন।
এক যুগ পর জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিয়ে এমন ভরাডুবির মুখে পড়তে হল বিএনপির। নির্বাচনের আগে দেশি বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা তাদের জরিপে মহাজোটের জয়ের আভাস দিয়েছিল। তবে বিএনপির এমন ফলাফল কেউই প্রত্যাশা করেনি। এবার ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করে ঐক্যফ্রন্ট। ধানের শীষ প্রতীকের এত বড় পরাজয় আগে কখনো দেখা যায়নি। এরআগে বিএনপি জোট সবচেয়ে খারাপ ফল করেছিল ২০০৮ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। সেবার তারা ৩০টি আসনে জয়লাভ করেছিল।
রবিবার একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত সারা দেশে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৯টি আসনে ভোট গ্রহণ হয়। এবারের নির্বাচনে নিবন্ধিত সব রাজনৈতিক দল (৩৯টি) অংশ নেয়। গত ৮ নভেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়। এরপর ঘোষিত পুনঃতফসিলে ভোটের তারিখ ২৩ ডিসেম্বর থেকে ৩০ ডিসেম্বর করা হয়।
তবে গাইবান্ধা-৩ (পলাশবাড়ী-সাদুল্যাপুর) আসনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী ড. টি আই এম ফজলে রাব্বী চৌধুরী মারা যাওয়ায় ওই আসনের নির্বাচন স্থগিত করা হয়। পুনঃতফসিল ঘোষণা করে এ নির্বাচনের তারিখ পুনর্নির্ধারণ করা হবে বলে জানায় নির্বাচন কমিশন।
এবারই প্রথমবারের মতো ছয়টি আসনে ইভিএমে ভোট দেন ভোটাররা। আসন ছয়টি হল- ঢাকা-৬, ঢাকা-১৩, চট্টগ্রাম-৯, রংপুর-৩, খুলনা-২ ও সাতক্ষীরা-২ আসনে।
আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার রেকর্ড: শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিয়ে চতুর্থ বারের মতো সরকার গঠন করতে যাচ্ছে। এবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পেলে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের ইতিহাসে নতুন রেকর্ড গড়বেন। এর আগে তিনবার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন খালেদা জিয়া। তৃতীয় বারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন শেখ হাসিনাও। এবার শেখ হাসিনার সুযোগ থাকছে চতুর্থ বারের মতো সরকার প্রধান হওয়ার।
১৯৯১ সালে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৩৪টি আসনে জয়ী হয়ে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সরকার গঠন করে বিএনপি। সেবার ৮৫টি আসনে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ। আর জাতীয় পার্টি পায় ৩৬টি আসন। অন্যান্য রাজনৈতিক দল এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা পান বাকি ৩৬টি আসন। সেবার দুই প্রধান দলের ভোটের ব্যবধান খুবই কম ছিল। গৃহীত ভোটের ৩০.৮ শতাংশ পেয়েছিল আওয়ামী লীগ। আর বিএনপি পেয়েছিল ৩০.৮১ শতাংশ।
১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক তৈরি হয়। অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই ওই নির্বাচন বর্জন করেছিল। সেবার ভোট পড়েছিল মাত্র ২১ শতাংশ। ওই নির্বাচনে ৩০০ আসনেই জয়লাভ করে বিএনপি। পরে ব্যাপক আন্দোলনের মুখে ওই বছরই জুনে নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সপ্তম সংসদ নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৪০ আসনে জয়লাভ করে প্রথমবারের মতো ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। সেবার বিএনপি পায় ১০৪টি আসন। আর ২৯টি আসনে জয়লাভ করে জাতীয় পার্টি।
২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৮৯টি আসনে জয় পায় বিএনপি নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট। সেবার আওয়ামী লীগ ৫৯ এবং জাতীয় পার্টি ১৪ এবং অন্যরা ২৮টি আসনে জয়লাভ করে।
সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। ২০০৮ সালের ওই নির্বাচনে ২৩০টি আসনে জয় পায় তারা। অপরদিকে ভরাডুবি হয় বিএনপির। তারা জয় পায় ৩০টি আসনে। আর জাতীয় পার্টি পায় ২৭টি আসন। ২০১৪ সালের ১০ম সংসদ নির্বাচনে আরো বড় জয় নিয়ে ক্ষমতা ধরে রাখে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট। এবার তারা পায় ২৩৪টি আসন। অপরদিকে জাতীয় পার্টি পায় ৩৪ আসন। নির্দলীয় সরকারের দাবিতে ভোট বর্জন করে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট। ফলে প্রথমবারের মতো সংসদে বিরোধীদল হিসেবে আবির্ভূত হয় জাতীয় পার্টি।
রবিবার অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও সরকারের ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ণই থাকছে। এবার ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ঐক্যফ্রন্টের হয়ে নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি। তবে ভোটে একেবারেই সুবিধা করতে পারেনি তারা।
ভোটের পর ঐক্যফ্রন্টের প্রতিক্রিয়া: নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে পুনর্নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে ঐক্যফ্রন্ট। রোববার (৩০ ডিসেম্বর) রাত ৮টার দিকে রাজধানীর নয়াপল্টনে নির্বাচন পরবর্তী ব্রিফিংয়ে এ দাবি জানান ফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন।
তিনি বলেন, ‘দেশের প্রায় সব আসন থেকেই একই রকম ভোট ডাকাতির খবর এসেছিল। এই পর্যন্ত বিভিন্ন দলের শতাধিক প্রার্থী নির্বাচন বর্জন করেছেন। এই পরিস্থিতিতে আমরা নির্বাচন কমিশনের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি, অবিলম্বে এই প্রহসনের নির্বাচন বাতিল করা হোক। এই নির্বাচনের কথিত ফলাফল আমরা প্রত্যাখ্যান করছি এবং সেই সাথে নির্দলীয় সরকারের অধীনে পুনর্নির্বাচনের দাবি করছি।’
গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার আন্দোলন অব্যাহত থাকবে বলেও জানান ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা। এসময় স্টিয়ারিং কমিটির বৈঠকের পর সোমবার (৩১ ডিসেম্বর) বিস্তারিত প্রতিক্রিয়া জানানো হবে বলে জানায় ঐক্যফ্রন্ট।
এরআগে সন্ধ্যায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন জাতির সঙ্গে নিষ্ঠুর প্রহসন। এ ধরনের নির্বাচন জাতির জন্য ক্ষতিকর। এই ক্ষতি দীর্ঘকালের। এই নির্বাচনে জাতির ক্ষতি হয়ে গেল।
ভোটের পর আওয়ামী লীগের প্রতিক্রিয়া: কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে বলে দাবি করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং নোয়াখালী-৫ আসনে নৌকা প্রতীক নিয়ে বিজয়ী প্রার্থী ওবায়দুল কাদের। রোববার (৩০ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় ফেনীতে নির্বাচন পরবর্তী তিনি বলেন, ‘কিছু কিছু বিচ্ছিন্ন, বিক্ষিপ্ত সংঘাত সংঘর্ষ হয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমরাই আক্রান্ত হয়েছি। নির্বাচনী সহিংসতায়, নাশকতায় যারা মৃত্যুবরণ করেছে এর বেশিরভাগই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী। কাজেই আমাদেরকেই টার্গেট করে হামলা পরিচালিত হয়েছে। তারা আগে থেকেই জানতো এই নির্বাচনে তাদের জয় লাভের সম্ভাবনা নেই। পরাজয় যে নিশ্চিত সেটা ঐক্যফ্রন্টের নেতারা ভালোভাবেই উপলব্ধি করেছে। এটা তাদের ফোনালাপে কিছুটা পরিষ্কার হওয়া যায়। তাদের মধ্যে একটা হতাশার সুর দেশবাসী লক্ষ্য করেছে।’
তিনি বলেন, ‘আজকে সারা দেশে কিছু বিক্ষিপ্ত ঘটনা ছাড়া শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হয়েছে। ভালো একটা নির্বাচন হয়েছে এবং এই নির্বাচনে ভোটারদের অচিন্তনীয় এবং অবিশ্বাস্য উপস্থিতি ছিল লক্ষ্য করার মতো। যে গণজোয়ার ছিল আজকেও তার প্রতিফলন দেখেছি।’
এদিকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের তোলা ২২০টি আসনে অনিয়মের অভিযোগের বিষয়ে কাদের বলেন, ‘এটা তার ব্যক্তিগত মতামত হতে পারে। এখানে দেশি বিদেশি পর্যবেক্ষকরা আছেন, সাংবাদিকরা আছেন, নির্বাচন কমিশন আছে। কাজেই একটা দলের মহাসচিবের বক্তব্য, যার দল নির্বাচনে নিশ্চিতভাবেই পরাজিত হতে যাচ্ছে তিনি এই ধরণের মন্তব্য করবেন এটাই তো স্বাভাবিক।’
বিএনপি প্রার্থীদের ভোট বর্জনের বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘তাদের মহাসচিব নিজেই বলেছেন যে প্রার্থীরা ভোট বর্জন করেছেন এটা তাদের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। এখন তাদের ৫১ জন প্রার্থী দলীয় সিদ্ধান্ত ছাড়া কেন ভোট বর্জন করলেন এটা তাদের নিজেদের ব্যাপার। এটা নিয়ে আমাদের কোনো কিছু মন্তব্য করার নেই।’
এদিকে জনগণ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে বিএনপি-জামায়াত নির্বাচনের ফলাফল বর্জন করেছে দাবি করে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, ‘এটা তাদের পুরনো অভ্যাস।‘
এছাড়া আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, এখন আনন্দ মিছিল করার সময় নয়, দেশ গঠনের সময়। কোনো জায়গায় কাউকে আনন্দ মিছিল করতে নিষেধ করেন তিনি। রবিবার সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা ও নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান এইচ টি ইমাম প্রধানমন্ত্রীর উদ্ধৃতি দিয়ে এই কথা বলেন।
এ/কে
Discussion about this post