নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ জঙ্গি হামলা বহুল আলোচিত গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে জঙ্গি হামলা মামলার রায় ঘোষণা করা হয়েছে। রায়ে সাত আসাসির ফাঁসির দণ্ড প্রদান করেছে আদালত। এবং আসামি মিজানকে খালাস দিয়েছে বিজ্ঞ বিচারক।
ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত ৭ আসামি হলেন-জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধী, রাকিবুল হাসান রিগান, রাশেদুল ইসলাম ওরফে র্যাশ, সোহেল মাহফুজ, হাদিসুর রহমান সাগর, শহীদুল ইসলাম খালেদ ও মামুনুর রশিদ রিপন। এদের মধ্যে কেউ পলাতক নেই।
বুধবার (২৭ নভেম্বর) চাঞ্চল্যকর এই হামলার রায় ঘোষণা করেন ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মজিবুর রহমান।
এর আগে সকাল ১০ টা ২৫ মিনিটের দিকের আসামিদের কারাগারে থেকে আদালতে হাজির করা হয়। তাদের মহানগর দায়রা জজ আদালতের হাজতখানায় রাখা হয়। বেলা ১২ টার কিছু আগে আসামিদের হাজতখানা থেকে এজলাসে তোলা হয়।
১২ টা ৪ মিনিটে বিচারক এজলাসে ওঠেন। ১২ টা ৬ মিনিটে বিচারক রায় পড়া শুরু করেন। রায় পড়ার সময় জঙ্গিরা চুপই ছিলেন। তবে তাদের চোখে মুখে কিছুটা ভয় বা আতঙ্ক দেখা যায়। কিন্তু রায় ঘোষণার পর আসামিরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন। তারা সেখানে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করেন। তারা নির্দোষ বলে বার বার চিৎকার করতে থাকেন। রায় শোনার পর ‘আল্লাহু আকবর’ বলে চিৎকার দিয়ে জঙ্গিরা বলেন দ্বীন ইসলামের জয় হোক।
আসামিদের মধ্যে বড় মিজান দণ্ড হয়েছে ভেবে সবচেয়ে বেশি চিৎকার করেন। পরে তাকে জানানো হয়, তিনি খালাস পেয়েছেন। একথা শোনার পর তিনি বলেন, আমি কোন অন্যায় করিনি। আল্লাহ আমাকে খালাস দিয়েছেন।
হাদিসুর রহমান বলেন , আমি তো ছিলামই না। কোন কিছুই জানি না। রায় দিলো আর হয়ে গেল।
রিগান নামে এক জঙ্গি বলেন, সব ভুয়া, আমি নাকি আইএসের সদস্য। শুনে হাসি পায়। আমি নির্দোষ কিন্তু আমাকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। আমি আইএস এর সদস্য না। অন্যান্য আসামিরা ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করতে থাকেন।
রায় ঘোষণা শেষে এজলাস থেকে বের করে আসামিদের প্রিজন ভ্যানে করে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
গত ১৭ নভেম্বর রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক শেষ হয়। এরপর ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মজিবুর রহমান রায় ঘোষণার এদিন ধার্য করেন।
চার্জ (অভিযোগ) গঠনের পর থেকে মোট ৫২ কার্যদিবসে সাক্ষ্যগ্রহণ ও যুক্তিতর্কসহ সব কার্যক্রম শেষে মামলাটি রায়ের পর্যায়ে পৌঁছে। জঙ্গি হামলার তিন বছর চার মাস ২৬ দিন পর চাঞ্চল্যকর এ মামলার রায় ঘোষণা করা হলো।
এবিষয়ে ট্রাইব্যুনালের সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর মো. গোলাম ছারোয়ার খান (জাকির) বলেন, চাঞ্চল্যকর এ মামলার রায়ের দিকে শুধু দেশবাসীই নয়, সারা বিশ্ব তাকিয়ে ছিলো। রাষ্ট্রপক্ষ আসামিদের বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ প্রমাণে সক্ষম হয়েছে। তাই সব আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। আসামিদের অভিন্ন উদ্দেশ্য ছিল কূটনৈতিক এলাকায় হামলা করে বিদেশিদের হত্যা করা।
আসামিপক্ষের আইনজীবী মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ থেকে আদালতে যেসব সাক্ষী উপস্থাপন করা হয়েছে, তাতে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হয়নি। প্রতিটি সাক্ষীর বৈসাদৃশ্য রয়েছে। যা আদালতে তুলে ধরা হয়েছে। এমতাবস্থায় আদালতের কাছে আমরা ‘ন্যায়বিচার’ প্রত্যাশা করেছিলাম কিন্তু পাইনি। আমরা রায়ের বিরুদ্ধে ইচ্চ আদালতে আপিল করবো। আশা করছি সেখানে ন্যায় বিচার পাবো।
হলি আর্টিজানে হামলা মামলা ও বিচার: ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা চালিয়ে দুই পুলিশসহ দেশি-বিদেশি ২২ জনকে হত্যা করে জঙ্গিরা। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও দু’জনের মৃত্যু হয়।
এছাড়া হামলায় অন্তত ৩০ জন পুলিশ সদস্য আহত হন। ওই সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যৌথ অভিযান ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ডে’ পাঁচ জঙ্গি নিহত হয়। অভিযানে এক জাপানি ও দুই শ্রীলংকানসহ ১৩ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়।
জঙ্গি হামলার ঘটনায় ওই বছরের ৪ জুলাই গুলশান থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা করে পুলিশ। তদন্ত শেষে ২০১৭ সালের ২৩ জুলাই হামলায় জড়িত ২১ জনকে চিহ্নিত করে জীবিত আটজনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দাখিল করা হয়।
পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) পরিদর্শক হুমায়ুন কবীর এ চার্জশিট দাখিল করেন। ঘটনায় জড়িত ‘চিহ্নিত’ বাকি ১৩ জন এরই মধ্যে বিভিন্ন অভিযানে নিহত হওয়ায় তাদের নাম চার্জশিট থেকে বাদ দেয়া হয়।
এরপর গত বছরের ২৬ নভেম্বর এ মামলায় আট আসামির বিরুদ্ধে চার্জ (অভিযোগ) গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল। গত বছরের ৩ ডিসেম্বর এ মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়ে চলতি বছরের ২৭ অক্টোবর শেষ হয়।
গত ৩০ অক্টোবর আত্মপক্ষ সমর্থনে আদালতের কাছে আট আসামি নিজেদের নির্দোষ দাবি করেন। এরপর চলতি মাসের ৬ নভেম্বর এ মামলায় যুক্তিতর্ক শুরু হয়।
৭ নভেম্বর রাষ্ট্রপক্ষ যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে সব আসামির মৃত্যুদণ্ড চান। আর ১৭ নভেম্বর এ মামলায় উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষ হয়। মামলায় চার্জশিটভুক্ত ২১১ জন সাক্ষীর মধ্যে ১১৩ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ হয়েছে।
হামলায় নিহত ও আহত যারা: হলি আর্টিজান বেকারিতে সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে দেশি-বিদেশি ২২ জনকে হত্যা করে জঙ্গিরা।
এদের মধ্যে নয়জন ইতালির নাগরিক, সাতজন জাপানের নাগরিক, একজন ভারতীয় নাগরিক, একজন বাংলাদেশ-আমেরিকার দ্বৈত নাগরিক, দু’জন বাংলাদেশি নাগরিক ও দু’জন পুলিশ কর্মকর্তা রয়েছেন।
এছাড়া পরবর্তীকালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টের দু’জন স্টাফ মারা যান। নিহত ইতালির নয় নাগরিক হলেন- মার্কো টোনডাট, ভিনজেনজো ডি’অ্যালেস্ট্রো, সিমোনা মন্টি, মারিয়া রিবোলি, নাদিয়া বেনেভেট্ট, অ্যাডেলে পুগলিসি, ক্লদিও ক্যাপেলি, ক্রিশ্চিয়ান রসি ও ক্লদিয়া মারিয়া ডি’অ্যান্টোনা।
জাপানের সাত নাগরিক হলেন- হিডেকি হাশিমোটা, কোয়া ওগাসাওয়ারা, মাকোটো ওকামুরা, হেরোশি তানাকা, ইয়োকি সাকাই, নোবুহিরো কোরুসাকি ও রুই শিমোডাইরা।
ভারতীয় নাগরিক তারিশি জৈন, বাংলাদেশ-আমেরিকার দ্বৈত নাগরিক অবিন্তা কবির, বাংলাদেশি দুই নাগরিক ইশরাত জাহান আখন্দ ও ফারাজ আইয়াজ হোসেন এবং দুই পুলিশ কর্মকর্তা সহকারী পুলিশ কমিশনার মো. রবিউল করিম ও পুলিশ পরিদর্শক সালাউদ্দিন আহম্মেদ খান ভয়াবহ ওই হামলায় নিহত হন। পরে হলি আর্টিজানের দু’জন স্টাফ সাইফুল চৌকিদার ও জাকির হোসেন শাওন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এছাড়া ওই হামলায় ৩০ থেকে ৩৫ জন পুলিশ সদস্য গুরুতর আহত হন।
হামলায় জড়িত নিহত ১৩ জঙ্গি: গুলশান হামলায় জড়িতদের মধ্যে নিহত ১৩ জনের পাঁচজন নিহত হয় হলি আর্টিজান হামলায় অভিযানের সময়ই।
এরা হচ্ছে- রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, মীর সামেহ মোবাশ্বের, নিবরাস ইসলাম, শফিকুল ইসলাম ওরফে উজ্জ্বল ও খায়রুল ইসলাম ওরফে পায়েল।
বাকি আটজন বিভিন্ন জঙ্গি আস্তানায় অভিযানে নিহত হয়। এরা হচ্ছে- আহমেদ চৌধুরী, নুরুল ইসলাম মারজান, তানভীর কাদেরী, মেজর (অব.) জাহিদুল ইসলাম ওরফে মুরাদ, রায়হান কবির তারেক, সারোয়ার জাহান মানিক, বাশারুজ্জামান ওরফে চকলেট ও মিজানুর রহমান ওরফে ছোট মিজান।
কারাগারে থাকা আট আসামি: মামলায় চার্জশিটভুক্ত আট আসামিই কারাগারে রয়েছে। এরা হচ্ছে- জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধী, রাকিবুল হাসান রিগান, রাশেদুল ইসলাম ওরফে র্যাশ, সোহেল মাহফুজ, মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান, হাদিসুর রহমান সাগর, শহীদুল ইসলাম খালেদ ও মামুনুর রশিদ রিপন।




Discussion about this post