কথায় আছে, ‘একটি জাতির সড়কের শৃংখলা দেখলে সে জাতির সভ্যতা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়’। আমাদের সড়কের বিশৃংখলার দিকে তাকালে আমার অস্বস্তি লাগে। মাঝে মাঝে ভীষণ রাগ হয়। মাঝে মাঝে, না প্রায়শ:ই, এর সাথেই তাল মিলিয়ে চলি। সবচেয়ে বেশী বিরক্তিকর ব্যাপার হয় রাতে, অর্থাৎ একটু বেশী রাতে, সড়কে গাড়ী চালানোর সময় লাল বাতিতে থেমে দাঁড়িয়ে থাকলে পেছন থেকে অন্য গাড়ী যখন হর্ণ বাজায় তখন। মনে হয় নেমে গিয়ে একটু জিজ্ঞাসা করি, সে কি অন্ধ? নাকি কালার ব্লাইন্ড? নাকি তাড়া বেশী? কিন্তু সেটা করা হয় না। যেটা করা হয়, তা হলো আমিও লালবাতির আইন ভেঙে গাড়ী নিয়ে এগিয়ে যাই। ব্যাপারটা ভীষণ পীড়াদায়ক। সে অবস্থায় গাড়ী চালিয়ে সামনে এগিয়ে না গেলে আশপাশের গাড়ীগুলোতে বসে থাকা মানুষগুলো যেভাবে তাকায়, তাতে মনে হয় সবাই ভাবছে আমিই বিশ্বের সেরা বোকা। আইন মানার কারণে নিজেকে বোকা ভাবতে হয়, ব্যাপারটাই হাস্যকর। জানিনা সবার বেলায় এমন হয় কিনা!
এ দৃশ্য সমাজের সর্বস্তরে বিরাজমান। উপরে শুধু ট্রাফিক আইনের একটা উদাহরণ দিলাম। সবাই যেন নিয়ম মানতে নারাজ।আরেকভাবে দেখা যায়। যেমন, পোস্ট অফিসে বা ট্রেনের টি-কেট কাউন্টারে গেলেই দেখবেন সবাই একইসাথে কাউন্টারের নীচে ছোট্ট ফাঁকা জায়গার ভেতরে হাত ঢুকিয়ে রেখেছে। কার আগে কে সার্ভিস পাবে তার একটি উম্মুক্ত প্রতিযোগিতা। কিছুক্ষণ পর দুই ব্যক্তির মাঝে কথা কাটাকাটি। তারপর উচ্চস্বরে গালাগালি, হাতাহাতি। তারপর সার্ভিস ঘন্টা খানেকের জন্য বন্ধ। এই হলো অবস্থা।
কিন্তু কেন বেশীরভাগ মানুষ আইন মানতে চায় না? প্রশ্নটা কিন্তু খুবই গুরত্বপুর্ণ। আমি সবসময় একথা বলি যে, উন্নত দেশগুলোর ক্ষমতাসীন ব্যক্তিবর্গ আসলে ফেরেশতা নয়। সুযোগ পেলে নয় ছয় করতে তারাও ছাড়বে না। সুযোগের অভাবে তারা চরিত্রবান। আর জনগণের আইন মানার প্রবণতা একটি অভ্যাসে পরিণত হয়েছে সেসব দেশে। অর্থাৎ, আইন মেনে চলার বিষয়টি একটি সিস্টেমে পরিণত হয়েছে এবং উন্নত দেশগুলোর ক্ষমতাসীন ব্যক্তিবর্গ বা জনগণ সেই ছক বা সিস্টেমের বাইরে চিন্তা করার ক্ষমতা রাখেনা।
হাতিকে ছোটবেলায় টুলের সাথে চেইন দিয়ে বেঁধে রাখলে তার ধারণা জন্মায় যে সে সেই শেকল ভাঙার ক্ষমতা রাখেনা। বড় হওয়ার পরও সেই হাতিকে একই টুলের সাথে বেঁধে রাখলেও একই চিন্তা ধারা হাতির ভেতর কাজ করে। অর্থাৎ, শারীরিকভাবে সেই একই হাতি শতগুণ শক্তিশালী হয়েও মানসিকভাব সে শৃংখলিত। সুতরাং দেখা যায়, চাইলেই বন্যপ্রাণীর মাঝেও শৃংখলা আনা যায় যদি নিয়মতান্ত্রিকভাবে তাকে অনেক কম বয়স থেকে শেখানো যায়। তাহলে অবচেতন মনেই সে আইন মানবে এবং আইন না মানার বা ভঙ্গের ব্যাপারটি তার চিন্তা বা ধারণারও বাইরে থাকবে। এভাবেই, সময়ের পরিক্রমায়, দু’একটি ব্যাতিক্রম ছাড়া, উন্নত বিশ্বে আইন মেনে চলাটাই নিয়মে পরিণত হয়েছে। না মানাটা অভাবনীয়।
আমাদের দেশেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমরা এ ধারার প্রয়োগ দেখতে পাই। তবে বেশীরভাগই তা বেসরকারী ক্ষেত্রে। যেমন, বেসরকারী বাসগুলো যখন চালু হলো, তখন আমরা শিখলাম লাইনে দাঁড়িয়ে সুশৃংখলভাবে কিভাবে টি-কেট কাটতে হয় বা বাসে উঠতে হয়। প্রথম প্রথম বারবার শেখাতে হলেও এখন আর শেখাতে হয়না। তেমনি ভাবেই, বেসরকারী ব্যাংকগুলোতেও লাইনে দাঁড়িয়ে টাকা তোলার সংস্কৃতি আমাদের দেশে ইতিমধ্যেই চালু হয়ে গেছে। সরকারী কিছু ব্যাংকেও তা চালু হয়ে গেছে। আমরা যখন গাড়ী নিয়ে ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় প্রবেশ করি, তখন সকলেই আপনা থেকেই আইন মেনে চলতে সজাগ হয়ে যাই।
এর কারণ হলো, অবচেতন মনে আমরা বিশ্বাস করি এ সকল ক্ষেত্রে নিয়ম বা আইন না মানলে আমাদের ভীষণ রকমের ঝামেলায় পড়তে হবে বা আমরা দরকারি সার্ভিস পাওয়া থেকে বন্চিত হবো। সুতরাং সে সকল ঝামেলা থেকে দুরে থাকার সর্বোত্তম উপায় হলো আইন বা নিয়মগুলো মেনে চলা।
এর উল্টোটা দেখলে দেখবেন ক্যান্টনমেন্ট এলাকার বাইরে আসার সাথে সাথেই আমাদের আচরণে আমুল পরিবর্তন চলে আসে। কারণ তখন আমরা জানি যে এখানে আইন বা নিয়ম না মানলেও তেমন কোন ঝামেলা হবেনা। পুলিশ ধরলে কিছু টাকা পয়সা খরচ করলেই ঝামেলা চুকে যাবে। সুতরাং, দেখা যাচ্ছে সব কিছুই নিয়ন্ত্রণ করছে আমরা কি বিশ্বাস করি তার উপর। অতএব এই বিশ্বাস করার বিষয়টির উপর জোড় দিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করলেই আমরা দ্রুত সমাধান লাভ করতে সক্ষম হবো বলে আশা করি। অবচেতন মনেই তখন সবাই আইন মানতে আগ্রহী হবে।
সরকারিভাবে এ কাজ কখন শুরু করবে তা সরকারি সিদ্ধান্তের বিষয়। স্বল্প মাত্রায় হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে সরকার বা দুর্নীতি দমন কমিশন এ ব্যাপারে কাজ শুরু করেছে বলে জানতে পেরেছি। তবে সবার আগে প্রয়োজন পারিবারিক শিক্ষা। আপনার সন্তানকে আপনি যদি সুশিক্ষিত আইন মান্যকারী নাগরিক হিসেবে দেখতে চান, তবে তাকে পারিবারিকভাবেই আগে শিক্ষা দিন। মনে রাখবেন, আপনি যা যা করবেন আপনার সন্তানও সেগুলোই শিখবে এবং অবিকল আপনাকে অনুসরণ করবে।
যেমন ধরুন, গাড়িতে চিপস খেয়ে চিপসের প্যাকেটটি যদি আপনি জানালা খুলে বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দেন, আপনার সন্তানও সেটিই শিখবে। চিপসের প্যাকেটটি কিন্তু পরিবেশের জন্য বড় ধরণের বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। এই প্লাস্টিকের বা পলিথিনের প্যাকেট সহজে মাটির সাথে মিশে না। বছরের পর বছর এটা পরে থাকে। সেই একটি প্যাকেটের কারণে ড্রেনের মুখ বন্ধ হয়ে বন্যার সৃষ্টি হতে পারে। তা থেকে জমে থাকা পানিতে মশার প্রজনন বাড়তে পারে। এমন কি শেষমেষ ডেঙ্গু জ্বর হয়ে এতে কারও মৃত্যুও হতে পারে। শুনতে অনেকটা অসম্ভব ব্যাপার মনে হলেও এমনটা ঘটে যাওয়া খুব সহজেই সম্ভব।
অথচ আপনি যদি একটু সচেতন হয়ে চিপসের প্যাকেটটি গাড়ীতে জমা করে পরে তা ময়লা ফেলার নির্দিষ্ট স্থানে ফেলে দেন, তাহলে সিটি করপোরেশন তা যথাযথ নিয়মে বর্জ্য ব্যবস্খাপনা নীতিমালা অনুসরণ করে নষ্ট করে ফেলার ব্যবস্থা করবে। এতে পরিবেশের ক্ষতি হওয়া থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে, রাস্তাঘাট পরিষ্কার থাকবে এবং সর্বোপরি আপনার সন্তান একজন সুশিক্ষিত সচেতন নাগরিক হিসেবে বেরে উঠবে। তাই আপনার প্রতিটি কার্যক্রমই আপনার সন্তানের সুষ্ঠভাব বেরে ওঠার সাথে সরাসরি সম্পর্কিত।
আপনি যে কোন ভাল কাজ করার পর যদি আপনার সন্তানকে ভাল কাজটি কেন করলেন এবং এর ফলে দেশ ও সমাজের কি লাভ হলো তা সহজভাবে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে বলেন, তা কোমলমতি শিশুদের হৃদয়ে সারাজীবনের জন্য গেঁথে যাবে এবং জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে সে আপনার দেয়া উপদেশ শতগুণ আন্তরিকতার সাথে পালণে সচেষ্ট থাকবে। আপনি আপনার সন্তানের চোখে সবসময় একজন মহাপুরুষ । সে আপনাকে খুব কাছ থেকে দেখে দেখে বেরে উঠবে। তার সুষ্ঠভাবে বেরে ওঠার সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করা আপনার দায়িত্বের মধ্যেই পরে।
আজ আমি আপনাদেরও অনুরোধ করছি এবং নিজেকেও বলছি, আসুন আমাদের প্রত্যেকের সন্তানেরা যেন আইন মান্যকারি সুনাগরিক হিসেবে বেরে উঠতে পারে তা আমরা পারিবারিকভাবেই নিশ্চিত করি। স্কুল কলেজে কোমলমতি শিশুদের পাঠ্যক্রমে নীতি-নৈতিকতার বিষয়ে শিক্ষা দেয়া সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত করলে বেশ ভালো হতো এবং এটাই কাম্য। তবে ব্যাপারটি যেহেতু আমাদের হাতে নেই, সেহেতু নীতি-নৈতিকতার বিষয়ে আমাদের সন্তানদের ঘর থেকেই শিক্ষা দিতে পারি। দুর্নীতি দেশে ও সমাজে কি অভিশাপ বয়ে আনে তা তাদের সামনে তুলে ধরতে পারি। বিভিন্ন মহামানবেরা কিভাবে যুগে যুগে সততার সাথে জীবনযাপন করেছেন সে গল্পগুলো তাদের সামনে তুলে ধরতে পারি। তারা নিজ নিজ দেশের জন্য কি কি ধরনের ত্যাগ স্বীকার করেছেন তা তাদের সামনে গল্পের মতো করে বলতে পারি। নিজে না জানলে, তা জেনে নিয়ে তাদের সাথে তা গল্পের মত করে উপভোগ করতে পারি। মোদ্যা কথা, এই কলুষিত পৃথিবীর পংকিলতা আমাদের কোমলমতি শিশুদের স্পর্শ করার আগেই আমরা তাদের দুর্ভেদ্য পরিচ্ছন্নতার আবরণে ঢেকে দিতে পারি। এতে শুধু আপনার সন্তান একজন সুনাগরিক হিসেবে বেরে উঠবে তা নয়, আপনার সাথে আপনার সন্তানের সম্পর্কের গভীরতা বহুগুন বেরে যাবে এবং তার দৃষ্টিতে আপনার প্রতি স্রদ্ধা ও ভালবাসা হাজারগুনে বৃদ্ধি পাবে।
এখন থেকে আমি বেশী রাতে বা অন্য যে কোন সময় সড়কে গাড়ী চালানোর সময় লাল বাতি জ্বললে থেমে দাঁড়িয়ে থাকবো সবুজ বাতি জ্বলার অপেক্ষায়। পেছন থেকে অন্য গাড়ী হর্ণ বাজালেও তা অগ্রাহ্য করবো। আশপাশের গাড়ীগুলোতে বসে থাকা মানুষগুলো যদি তাকায়, নিজেকে আর বোকা ভাববোনা। গর্বের সাথে ইশারায় তাদের লালবাতিটাকে দেখিয়ে দেব। তারপর আমার সন্তানদের সাথে নিয়ে একটা ভাল কাজ করার খুশীতে আওয়াজ করে হাসবো। আমার সন্তান একদিন গর্ব করে যেন বলতে পারে, ‘আমার বাবা আমাকে আইন মানতে শিখিয়েছেন, ভাঙতে নয়। আমি একজন আইন মান্যকারী গর্বিত নাগরিক।’
সবাই ভালো থাকবেন। সুস্থ ও নিরাপদে থাকবেন। আর একটি উন্নত, সমৃদ্ধ, সচেতন বাংলাদেশ গড়ার জন্য নীরবে কাজ করে যাবেন এই অনুরোধ রইল।
নিবেদক – হাসান আজীম (ব্যারিস্টার-এট-ল এবং এডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট)।
**********
Discussion about this post