জমির ক্রেতা বলতেই আগে সাধারণত উচ্চবিত্তদের বোঝা হতো। কিন্তু হাউজিং, রিয়েল এস্টেট ও এগ্রো বিজনেসের প্রসার ও বিশেষত শহর এবং বাণিজ্যিক এলাকাগুলোতে সহজ কিস্তিতে জমি ক্রয় বিক্রয়ের পদ্ধতি চালু হওয়ায় বিগত দিনগুলোর তুলনায় আজকাল জমি ক্রয়ের দিকে মানুষের আগ্রহ বেড়েছে বহুলাংশে। এখন আর শুধু উচ্চবিত্ত নয়, মধ্যবিত্ত এমনকি সাধারণ চাকুরীজীবীরাও চেষ্টা করেন শহরের বুকে একখণ্ড জমি ক্রয়ের জন্যে।
কিন্তু অনেকেই জানেননা জমি ক্রয়ের পূর্বে যাচাই করে নেয়া কাগজপত্রগুলো সম্পর্কে। ফলে জমি ক্রয়-বিক্রয়ের পাশাপাশি সাধারণ ক্রেতাদের প্রতারিত হওয়ার সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে। চলুন দেখে নেয়া যাক একটি জমি ক্রয়ের পূর্বে কী কী স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে তারপর জমি ক্রয় করবেন।
নকশা ও মৌজাঃ
সরাসরি জমি পরিদর্শন করার ফলে নকশা ও মৌজা সম্পর্কে গুরুত্ব দেননা অনেকেই। ফলে যেটা হয়, এক জায়গা দেখে জমি কিনে হয়ত দখল বুঝে নেয়ার সময় পান অন্য জমি। ক্রেতা ক্ষমতার দিক থেকে দুর্বল হলে কিছুই করার থাকেনা অপরদিকে ক্রেতার আর্থিক সঙ্গতি ও সাহস থাকলে বিষয়গুলো গড়ায় মামলা পর্যন্ত। অথচ নকশা ও মৌজা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে নিলে এই বিড়ম্বনায় পড়তে হয়না। নকশা হচ্ছে কোন মৌজাভূক্ত জমির বাস্তব চিত্র। অভিজ্ঞ না হলে নকশা দেখে ক্রেতা সাধারণত বুঝবেন না কিছুই। তাই উচিত হচ্ছে জমি পরিদর্শনের সময় সংশ্লিষ্ট এলাকার একজন অভিজ্ঞ সার্ভেয়ার সাথে নিয়ে যাওয়া। মৌজা হচ্ছে জরিপের একটি ভৌগলিক ভাগ। অর্থাৎ একটি ইউনিয়নকে বা সিটি কর্পোরেশনের এলাকাগুলোকে কয়েকটি মৌজায় ভাগ করা হয়। প্রথম অবস্থায়ই আপনি যেই জমিটি দেখছেন সেটি আপনাকে যে মৌজায় বলা হয়েছে সেই মৌজারই জমি কী না এবং নকশা অনুযায়ী ঠিক জমিটিই দেখছেন কী না তা নিশ্চিত হয়ে নিতে হবে।
জেএল নাম্বারঃ
উপজেলার অন্তর্গত মৌজাসমূহের ক্রমিক নম্বরকে “জুরিসডিকশন লিস্ট নম্বর” বা জেএল নং বলে। মৌজা সম্পর্কে সুনিশ্চিত হতে এটি মিলিয়ে নিতে হবে।
খতিয়ানঃ
দখল স্বত্বের প্রমাণ হচ্ছে খতিয়ান। একটি খতিয়ানে এক বা একাধিক দাগের সম্পূর্ণ বা আংশিক জমি এবং এক বা একাধিক ব্যক্তির নাম থাকে। প্রতিটি খতিয়ানের আলাদা আলাদা নাম্বার থাকে। খতিয়ানে তৌজি নম্বর, জেএল নম্বর্, মালিকানার বিবরণ, মালিকের নাম ও পিতার নাম, ঠিকানা থাকে। খতিয়ানের অপর পৃষ্ঠায় দাগ নম্বর, প্রত্যেক দাগের উত্তর সীমা, জমির শ্রেণী, দখলকারের নাম, জমির পরিমাণ, হিস্যা ও সেমতে পরিমাণ উল্লেখ থাকে।
দাগ নাম্বারঃ
এক বা একাধিক মালিকের বিভিন্ন জমিকে সংশ্লিষ্ট মৌজার নকশায় যে আলাদা আলাদা পরিচিতি নাম্বার দ্বারা চিহ্নিত করা থাকে তাকে দাগ নাম্বার বলে।
পর্চাঃ
জরিপ চলাকালীন সময়ে জমির মালিককে প্রস্তুতকৃত খসড়া খতিয়ানের যে কপি দেয়া হয় তাকে পর্চা বলে। এতে জরিপ কর্মচারীর স্বাক্ষর থাকে।
দাখিলাঃ
দাখিলা হচ্ছে জমির মালিকানার একপ্রকার প্রাথমিক দলিল। কেননা, দাখিলা নামক রসিদের বিপরীতেই জমির মালিক ভূমী উন্নয়ন কর প্রদান করে থাকেন।
সাকসেশন সার্টিফিকেট ও ভায়া দলিলঃ
সাকসেশন সার্টিফিকেট দেওয়ানী আদালত কর্তৃক কোন মরহুম/মরহুমা ব্যক্তির উত্তরাধিকারদের দেয়া হয়ে থাকে। এতে আদালত কর্তৃক উত্তরাধিকারদের প্রাপ্য সম্পদের পরিমাণ বা হিস্যা নির্দিষ্ট করে দেয়া থাকে। ওয়ারিশান সম্পদ ক্রয়ের ক্ষেত্রে সাকসেশন সার্টিফিকেট দেখে নিলে অন্য উত্তরাধিকারের হিস্যা ক্রয় করে প্রতারিত হতে হবেনা। আর ভায়া দলিল হচ্ছে সংশ্লিষ্ট জমি যদি একাধিক মালিকের হাত বদল হয়ে থাকে তবে যতবার জমিটি বিক্রয় হয়েছিল ততটি দলিল থাকবে। এগুলোকে ভায়া দলিল বলে। ভায়া দলিল পরীক্ষা করে নিলে জমির বর্তমান মালিকানার অবস্থা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাবে।
সিএস খতিয়ানঃ
জমিদারী আমলে প্রত্যেক জমিদারের এলাকায় কোন জমি কোন চাষী কী পরিমাণ জমি এবং তা কোন শ্রেণীর জমি তা রেকর্ড করে সেমতে বাস্তবভিত্তিক নকশা করে সংশ্লিষ্ট দখলকারের নাম উল্লেখপূর্বক খতিয়ান প্রণয়ন করা হতো। এটিই সিএস খতিয়ান। জমিদারী আমল হতে নিরবিচ্ছিন্ন মালিকানার মৌরাশি জমি ক্রয়ের ক্ষেত্রে এবং ভায়া দলিলের জমি ক্রয়ের ক্ষেত্রেও মালিকানা ক্রমের স্বচ্ছতা নিশ্চিত হতে একদম শুরুর দিকের সিএস খতিয়ান দেখে নেয়া উচিত। মৌরাশি মানে পুরুষানুক্রমে কোন জমি ভোগ দখল করা।
এসএ খতিয়ানঃ জমিদারী প্রথা বিলুপ্তির পর জমিদারদের ক্ষতিপূরণ প্রদান ও রায়তি চাষীদের সরকারের অধীন মালিকানার স্বীকৃতি প্রদানে পূর্বের সিএস জরিপের ভিত্তিতে এসএ খতিয়ান তৈরি করা হয় যার এক কপি করে জেলা রেকর্ডরুম, উপজেলা রাজস্ব অফিস ও তহসিল অফিসে রাখা হয়। তবে স্বল্প সময়ে প্রস্তুত করায় এতে ত্রুটি বিচ্যুতি পরিলক্ষিত হতে পারে।
আরএস খতিয়ানঃ এসএ খতিয়ানের ত্রুটি বা ভুল সমূহ সংশোধনের লক্ষ্যে পাকিস্তান আমলে সংশোধনী জরিপ বা আরএস খতিয়ান করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
বিএস খতিয়ান বা সিটি জরিপঃ ১৯৯৮-৯৯ থেকে শুরু হয়ে বর্তমানে চলমান জরিপকে বিএস বা সিটি জরিপ বলে। এই জরিপ এখনও চলমান।
নামজারি বা মিউটেশনঃ জমির মালিকানা পরিবর্তন হলে নতুন মালিকের নামে নামজারি হয়ে থাকে।
উপরেল্লিখিত দলীলদস্তাবেজ পরীক্ষা করার পরও কোন জমি ক্রয় করার পূর্বে ক্রেতার উচিত বিক্রেতার সাথে কথা বলে “জমির উপর ভিন্ন কোন দাবীদার থাকলে তার দৃষ্টি আকর্ষণ পূর্বক নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ক্রেতার নিকট আপত্তি জানানো” সংশ্লিষ্ট একটি বিজ্ঞপ্তি জমিটিতে টাঙানো এবং জাতীয় দৈনিকেও এই মর্মে একটি বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা। কাগজপত্র ঠিক থাকলে এবং বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখিত সময়ের মধ্যে কেউ আপত্তি না জানালে জমিটি ক্রয় করা যেতে পারে।
তথ্যগুলো সম্মানিত পাঠকদের উপকারে আসলে আমার পরিশ্রম সার্থক হবে।
লেখকঃ মসনদ বিন তৈফুর (নিলয় ভূঁইয়া)
সদস্যঃ ঢাকা ট্যাক্সেস বার এ্যাসোসিয়েশন
বাংলাদেশ কোম্পানি ল’ প্র্যাক্টিশনার’স সোসাইটি।।
Discussion about this post