ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার রাজনৈতিক টানাপোড়নের কারণে অদ্ভুত ১৭ দিন স্থায়ী ‘তাসখন্দ যুদ্ধ’ স্বাধীন বাংলাদেশে জন্ম দিয়েছে ‘অর্পিত সম্পত্তি’ নামক ‘বিষফোড়া’। প্রায় ৫৩ বছর ধরে লালিত ‘বিষফোড়া’কে প্রশাসনিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে প্রণয়ন ও জারি করতে হয়েছে অধ্যাদেশ, আইন, বিধিমালা এবং সরকারি আদেশ।আবার প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণকে বিচারিক পর্যবেক্ষণে রাখার নিমিত্তে তার সঙ্গে যোগ হয়েছে মহামান্য উচ্চ আদালতের দিকনির্দেশনামূলক প্রশংসনীয় ভূমিকা। তবে বিদ্যমান আইনি অ-স্পষ্টীকরণ ‘অর্পিত সম্পত্তি’র প্রকৃতিগত অবস্থান প্রয়োগে দ্বিধাবিভক্তির সৃষ্টি করেছে।
তাসখন্দ চুক্তির পর তৎকালীন ভারত সরকার শত্রু সম্পত্তি অধ্যাদেশ রহিত করলেও তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের যে সকল নাগরিক ১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বরের আগে থেকে ভারতে ছিল এবং ১৯৬৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ভারতে চলে গিয়েছিল, পাকিস্তান সরকার তাদেরকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করতঃ তাদের বাড়িঘর ও জমিজমা ‘শত্রু সম্পত্তি’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করে যা ‘সেনসাস লিস্ট’ নামে পরিচিত।
অন্যদিকে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর আইন প্রণয়নের মাধ্যমে ‘শত্রু সম্পত্তি’কে ‘অর্পিত সম্পত্তি’ নামে এর ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা এবং ব্যবস্থাপনা ও বন্দোবস্তির জন্য সরকার অথবা সরকার নির্দেশিত কর্মকর্তা বা কর্তৃপক্ষের ওপর ন্যস্ত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।
তাছাড়া বিভিন্ন সময়ে পূর্ব পাকিস্তান এবং বর্তমান বাংলাদেশে প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। যেমন- ‘উপ তত্ত্বাবধায়ক (পরিচালক, ভূমি রেকর্ড ও জরিপ) শত্রু সম্পত্তির (জমি ইমারত) দখল গ্রহণ ও ব্যবস্থাপনা, শত্রু সম্পত্তি (জমি ও ইমারত) চিহ্নিতকরণ, দখল গ্রহণ এবং অনধিক এক বছরের জন্য ইজারা প্রদান, অর্পিত সম্পত্তির (জমি ও ইমারত) ব্যবস্থাপনা, প্রশাসন ও বিলিবণ্টন সংক্রান্ত বিস্তারিত নির্দেশাবলী (চার খণ্ড), লুক্কায়িত অর্পিত সম্পত্তি’ ইত্যাদি।
বাংলাদেশ সংবিধানের সম্পত্তির অধিকার ‘অর্পিত সম্পত্তি’কে চূড়ান্তভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ১৯৬৯ সালের অধ্যাদেশ রহিতের সঙ্গে সঙ্গেই আইনটি বাতিল ও মৃত এবং ১৯৭৪ সালের পর নতুন কোনো সম্পত্তি অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে গণ্য করা যাবে না মর্মে উচ্চ আদালতের মত প্রকাশের পর সাংবিধানিক প্রশ্নটি স্পষ্ট হয়েছে। এ প্রসঙ্গে সাজু হোসেন বনাম বাংলাদেশ, আরতি রাণী পাল বনাম সুদর্শন কুমার পাল এবং অন্যান্য (যথাক্রমে ৫৮ ও ৫৬ ডিএলআর) উল্লেখযোগ্য।
বর্তমানে ২০০১ সালে ‘অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন’ ও ২০১২ সালের অবমুক্তি বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। আইনে ‘অর্পিত সম্পত্তি’কে প্রত্যার্পণযোগ্য সম্পত্তি, অধিগ্রহণকৃত সম্পত্তি এবং প্রত্যার্পণযোগ্য জনহিতকর সম্পত্তি নামে তিন শ্রেণীতে ভাগ করে মূল মালিক বা উত্তরাধিকারী বা স্বার্থাধিকারী বা ইজারা বা অন্য কোনোভাবে দখলদার সহ-অংশীদার বরাবরে ফেরত দেওয়ার বিধান করা হয়েছে।
সম্প্রতি ১৯৭৪ ও ১৯৭৬ সালের অধ্যাদেশ, অধ্যাদেশ অনুবলে গৃহীত কার্যক্রম, ১৯৭৪ সালের আইনের পরবর্তী সময়ে অন্তর্ভুক্তিকরণ এবং ২০০১ সালের আইনের ৬ (গ)(ঘ) ধারাকে চ্যালেঞ্জ (রিট নং ৮৯৩২/১৮) করা হলে উচ্চ আদালত চ্যালেঞ্জকৃত আইনটি বাতিল না করে ‘ঐতিহাসিক ভুল’ হিসেবে বিবেচনা করে ৯ দফা নির্দেশনাসহ সিদ্ধান্ত দেন। যেমন- ১৯৭৪ সালের পর অন্তর্ভুক্তিকরণে দায়ী ব্যক্তি আদালত অবমাননায় দোষী হবেন; আইনগত দাবিদারবিহীন অর্পিত সম্পত্তি শুধু মানবিক উন্নয়নকাজে ব্যবহার করতে হবে; সরকারের অনুকূলে অর্পিত সম্পত্তি ব্যবহারের জন্য আইন করতে হবে; আইনগত দাবিদারকে ফেরত দেওয়া না হলে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দিতে আইন করতে হবে ইত্যাদি।
এই রায়ের নির্দেশনা অনুসারে আইন মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন মূলে ভবিষ্যতে অর্পিত সম্পত্তি নিয়ে হাইকোর্টে রিট আবেদন না করার বিষয়ে জেলা প্রশাসকদের প্রতি নির্দেশনা জারির নিমিত্তে মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও ভূমি সচিবকে চিঠি দিয়েছেন।
তবে নতুন আইন প্রয়োগ করতে গিয়ে বিজ্ঞ ট্রাব্যুনালকে কিছু সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় যার সমাধান আইনে নেই। যেমন-
প্রথমত, অ্যাবেটেড মামলার বাদীর নাম যদি ২০১২ সালের তালিকাতে অন্তর্ভুক্ত না হয়ে নালিশি সম্পত্তি তালিকাভুক্ত হয়, তৎক্ষেত্রে বাদীর কী প্রতিকার তা আইনে বলা নেই।
দ্বিতীয়ত, প্রকাশিত তালিকায় যদি কোন ভুল থাকে সেই ভুল সংশোধনের বিষয়ে নতুন আইনে কোনো ব্যবস্থা নেই।
তৃতীয়ত, নতুন আইনে দরখাস্ত মনজুর হওয়ার পর প্রার্থীদের নামে লেটেস্ট রেকর্ড বা খতিয়ান সংশোধনী বিষয়ে সুনির্দিষ্ট বিধান না থাকায় সংশ্লিষ্ট ভূমি অফিস ও প্রার্থী উভয়ে বিভ্রান্তিতে পতিত হয়ে সংশোধন বা নামজারী প্রক্রিয়ায় জটিলতা সৃষ্টি করছে। এ বিষয়ে ভূমি মন্ত্রণায়ের প্রজ্ঞাপন মূলে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকলেও অনেক ক্ষেত্রেই তা মানা হচ্ছে না।
চতুর্থত, একই দাগের তালিকাভুক্ত সম্পত্তি দুইজন আলাদা আলাদাভাবে ট্রাইব্যুনালে আবেদন করলে একটি আবেদন ইতোমধ্যে মঞ্জুর হলে অপর বিচারাধীন আবেদনটি অবমুক্ত নাকি খারিজ হবে নতুন আইনে কিছু বলা নেই।
পঞ্চমত, সংশ্লিষ্ট ভূমি অফিস যদি একাধিক দাগ বিশিষ্ট খতিয়ানের একটি দাগ তালিকাভুক্ত হওয়ার কারণে খাজনা গ্রহণ না করে নতুন আইনে সমাধানমূলক নির্দেশনা নেই।
ষষ্ঠত, অর্পিত আইনে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আবেদন করতে না পারলে ফলাফল কী হবে তা বলা নেই। কিন্তু আইন বিজ্ঞানের মৌলিক নীতি অনুসারে আইনগত ফলাফলের অনুপস্থিতি প্রতিকারবিহীন অবস্থায় থাকবে না। পক্ষান্তরে ‘প্রত্যার্পণযোগ্য সম্পত্তির দাবিতে নতুন মামলা দায়ের বা দাবী উত্থাপন নিষিদ্ধ’ বিধানটি নির্দিষ্ট সময়ের পর নতুন মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে নয়।
এ অবস্থায় নির্ধারিত সময়ের পর প্রার্থীর বাদী হিসেবে এখতিয়ারসম্পন্ন আদালতে ঘোষণামূলক মামলা আনয়ন করতে কোনো আইনগত বাধা নেই। সেক্ষেত্রে বিজ্ঞ বিচারিক আদালত কিছু আইন, নির্বাহী আদেশ ও উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত অনুসরণ করে উক্ত মামলা নিষ্পত্তি করতে পারবেন। যেমন- পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশ-১৯৬৫ (১৯৬৫ সনের ২৩ নম্বর অর্ডিন্যান্স); পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধিমালা-১৯৬৫ এবং উক্ত নিয়মের অধীন প্রদত্ত আদেশের যতটুকু দফা (উ) তে উল্লিখিত আইন বলে হেফাজতকৃত; এ্যানিমি প্রপার্টি (কন্টিনিউএ্যান্স অব ইমারজেন্সি) অর্ডিন্যান্স-১৯৬৯ (যা ১৯৭৪ সনের এক্স এল ভি রহিত); বাংলাদেশ ভেস্টিং অব প্রপার্টি অ্যান্ড অ্যাসেট, ১৯৭২; এ্যানিমি প্রপার্টি (কন্টিনিউএ্যান্স অব ইমারজেন্সি প্রভিশনস্ (রিপিল) আইন- ১৯৭৪,ভ্যাস্টেড অ্যান্ড নন-রেসিডেন্ট প্রপার্টি (অ্যামেন্ডমেন্ট) আইন-১৯৭৪ এবং ১৯৬৫ সন হতে ১৯৬৯ সন পর্যন্ত সময়ে প্রকাশিত বিভিন্ন গেজেট প্রকাশিত নির্বাহী বিভাগের আদেশ।
আবার বিজ্ঞ বিচারিক আদালত বাদী পক্ষের ডিফেন্সের কারণগুলোর আলোকে ঘোষণামূলক মামলাসমূহ নিষ্পত্তি করতে পারবেন। যেমন- প্রথমত, বিধিবদ্ধ পদ্ধতি অনুসরণ না করে নালিশি সম্পত্তি অর্পিত তালিকায় অন্তর্ভুক্তি করা হলে; দ্বিতীয়ত, সরকার বিবাদী যদি অর্পিত সম্পত্তির সেনসাস লিস্ট প্রমাণে ব্যর্থ হন; তৃতীয়ত, ১৯৭১ সাল হতে ঘোষণামূলক মামলা দায়েরের আগ পর্যন্ত সময়ে বাদী বা তার পূর্বসূরি যদি বাংলাদেশে অবস্থান করেন; চতুর্থত, নালিশি সম্পত্তি যদি দেবোত্তর সম্পত্তি হয়ে থাকে; পঞ্চমত, অর্পিত সম্পত্তির ক্ষেত্রে ইস্টোপেল নীতি প্রযোজ্য হবে না। তবে বিশেষভাবে উল্লেখ্য ঘোষণামূলক মামলায় ডিফেন্সের কারণ বিবেচনা করা হলেও অর্পিত মামলায় এই সুযোগ নেই।
পরিশেষে বর্তমান আইনি কাঠামোতে ‘বিষফোড়া’ দূরীকরণ অনেকটা আইনি গতি পেয়েছে। তবে প্রশাসনিক জটিলতা যেন আইনের মূল উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে বাধাগ্রস্ত করতে না পারে তা রক্ষা করাই বড় চ্যালেঞ্জ।
লেখকঃ
রাজীব কুমার দেব
সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট
চকরিয়া চৌকি আদালত, কক্সবাজার।
Discussion about this post