নিজস্ব প্রতিবেদক: সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান পদে থাকা ও করোনা টেস্টে প্রতারণার অভিযোগে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের রেজিস্ট্রার কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগের ডা. সাবরিনা শারমিন হুসাইনকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করেছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়।
আজ রবিবার (১২ জুলাই) স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. আব্দুল মান্নান স্বাক্ষরিত এ সংক্রান্ত এক অফিস আদেশ জারি করা হয়।
অফিস আদেশে বলা হয়েছে, ‘সাবরিনা শারমিন সরকারি চাকরিতে কর্মরত অবস্থায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান জেকেজি হেলথকেয়ারের চেয়ারম্যান হিসেবে কর্মরত ছিলেন এবং করোনা টেস্টের ভুয়া রিপোর্ট প্রদান ও অর্থ আত্মসাতের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন বিধায় তিনি আজ সকালে গ্রেফতার হন। সরকারি কর্মকর্তা হয়ে সরকারের অনুমতি ব্যতীত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান পদে অধিষ্ঠিত থাকা এবং অর্থ আত্মসাৎ সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা এবং আপিল) বিধিমালা ২০১৮ অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ, সেহেতু ডা. সাবরিনা শারমিনকে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা ২০১৮ এর ১২(১) অনুযায়ী সাময়িক বরখাস্ত করা হলো।’
তিনি সাময়িক বরখাস্তকালীন সময়ে বিধি মোতাবেক খোরপোষ প্রাপ্ত হবেন বলে অফিস আদেশে উল্লেখ করা হয়।
পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে যা বলেছেন: করোনাভাইরাস টেস্ট নিয়ে প্রতারণার অভিযোগে জেকেজি হেলথকেয়ারের চেয়ারম্যান ও জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের চিকিৎসক ডা. সাবরিনা আরিফকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের পর গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
ডা. সাবরিনাকে গ্রেফতারের পর ডিসি কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে ডিসি মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ জানান প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি সন্তোষজনক কোনো তথ্য দিতে পারেননি।
ডা. সাবরিনাকে জিজ্ঞাসাবাদ ও গ্রেফতার প্রসঙ্গে ডিসি হারুন বলেন, ‘আমরা আজ তাকে যখন জিজ্ঞাসাবাদ করলাম, আপনি কি চেয়ারম্যান কিনা? উনি বলছেন, না আমি কখনই চেয়ারম্যান ছিলাম না। দ্বিতীয় কথা, আপনি তিতুমীর কলেজে (জেকেজির সঙ্গে কলেজ শিক্ষার্থী ও কর্মচারীদের সঙ্গে সংঘর্ষের) সময় আপনি সেখানে দাঁড়িয়ে তাদের পক্ষে কথা বললেন, জেকেজির মুখপাত্র হিসেবে, চেয়ারম্যান হিসেবে কথা বললেন। তখন তিনি (ডা. সাবরিনা) বললেন, আমার হাজব্যান্ড আমাকে এটা বলতে বলছে।’
ডিসি হারুন বলেন, ‘তারপর উনাকে আরও বিভিন্ন প্রশ্ন করা হলো, কিন্তু ওনি কোনো প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারে নাই। যার কারণে ওনাকে আমরা গ্রেফতার দেখিয়েছি। আমরা মনে করি, ওনি কখনই এই কোম্পানির চেয়ারম্যান হিসেবে এই কোম্পানি মানুষকে যে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। যারা নেগেটিভ তাদেরকে পজিটিভ আর যারা পজিটিভ তাদেরকে নেগেটিভ বানাচ্ছে। হাজার হাজার মানুষের মাঝে সংক্রমণ ঘটছে।মানুষকে প্রতারণা করছেন টাকার বিনিময়ে। বিদেশের মাটিতে আমাদের দেশের মানুষেরা গিয়ে (তাদের ভুয়া রিপোর্টের কারণে) যে ফিরে এসেছে। সবকিছু মিলেই আমাদের তদন্তে আসবে।’
ডিসি হারুন বলেন, তাকে গ্রেফতার করতে আমরা সময় নিচ্ছিলাম। কারণ, তিনি একজন ডাক্তার, সরকারি কর্মকর্তা।
এক প্রশ্নের জবাবে ডিসি হারুন সাংবাদিকদের বলেন, আমরা আগামীকাল আদালতে তার জন্য রিমান্ড চাইব। রিমান্ডের প্রেক্ষিতে আরও কিছু তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে তার বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। আপাতত আমরা তাকে একটা মামলায় গ্রেফতার দেখাচ্ছি। ওই মামলায় রিমান্ডে আসবে, আমাদের যদি মনে হয় আরও কোনো অপরাধের সঙ্গে জড়িত, আরও কেউ এসব অপরাধের সঙ্গে জড়িত আরও কেউ আছে সেক্ষেত্রে অন্য ব্যবস্থা নেয়া হবে।
আরেক প্রশ্নের জবাবে ডিসি হারুন বলেন, যেহেতু তিনি একজন সরকারি কর্মকর্তা সেহেতু তিনি আরেকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান থাকতে পারেন না, কিংবা ওই প্রতিষ্ঠানের মুখপাত্র হিসেবে বক্তব্য দিতে পারেন না।
উনি যে একজন সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে জেকেজি গ্রুপের পক্ষে ফেসবুকে প্রচারণা চালিয়েছেন তাও একজন সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে তা করতে পারেন না। আগামীকাল যদি তিনি রিমান্ডে আসেন তাহলে লক্ষ লক্ষ মানুষের নমুনা নিয়ে পরে যে ভুয়া রিপোর্ট দিয়ে প্রতারণা করেছেন তা তদন্তে বেরিয়ে আসবে। রিমান্ডে আসলে আমরা সময় পাব, তখন বাকি তথ্যগুলো জানা সহজ হবে।
জেকেজির বুথে যারা কাজ করেন তারা আমাদের থানায় এসে ভাঙচুর করেছেন, সেটা পুলিশ বাদি হয়ে মামলা হয়েছে। আর উনি জেলহাজতে ঢুকে সিসিটিভি ভাঙচুর করেছেন। এটার আরেকটা মামলা আছে।
সাবরিনার রিমান্ড চাইবে পুলিশ: করোনাভাইরাস টেস্ট নিয়ে প্রতারণার অভিযোগে জেকেজি হেলথকেয়ারের চেয়ারম্যান ও জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের চিকিৎসক ডা. সাবরিনা আরিফের রিমান্ড চাইবে পুলিশ। ডা. সাবরিনাকে গ্রেফতারের পর ডিসি কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে ডিসি মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ এসব তথ্য জানান।
তিনি বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে যেসব প্রশ্ন করা হয়েছে তিনি সেগুলোর সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারেননি। তাই তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মামলার তদন্তের জন্য তাকে অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। সোমবার তাকে আদালতে পাঠিয়ে রিমান্ড চাইবে পুলিশ।
প্রসঙ্গত, জেকেজি হেলথকেয়ারের করোনা টেস্ট নিয়ে প্রতারণার অভিযোগে এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী আরিফ চৌধুরীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সাবরিনা তারই স্ত্রী।
এর আগে গত ৪ জুন স্বামী আরিফুলের বিরুদ্ধে মারধরের অভিযোগ তুলে সাবরিনা তেজগাঁও বিভাগের একটি থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। তবে অন্তত দুই মাস আগে তাদের মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে ডা. সাবরিনা দাবি করেন।
জেকেজির বিরুদ্ধে অভিযোগ, সরকারের কাছ থেকে বিনামূল্যে নমুনা সংগ্রহের অনুমতি নিয়ে বুকিং বিডি ও হেলথকেয়ার নামে দুটি সাইটের মাধ্যমে টাকা নিচ্ছিল এবং নমুনা পরীক্ষা ছাড়াই ভুয়া সনদ দিত।
এ বিষয়ে রাজধানীর কল্যাণপুরের একটি বাড়ির কেয়ারটেকারের অভিযোগের সত্যতা পেয়ে ২২ জুন জেকেজি হেলথকেয়ারের সাবেক গ্র্যাফিকস ডিজাইনার হুমায়ুন কবীর হিরু ও তার স্ত্রী তানজীন পাটোয়ারীকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পরে প্রতিষ্ঠানটির সিইও আরিফকেও গ্রেফতার করা হয়। এ ঘটনার পর ২৪ জুন জেকেজি হেলথকেয়ারের নমুনা সংগ্রহের যে অনুমোদন ছিল তা বাতিল করে স্বাস্থ্য অধিদফতর।
জানা যায়, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় করোনার নমুনা সংগ্রহ করে তা পরীক্ষা না করেই জেকেজি প্রতিষ্ঠানটি ১৫ হাজার ৪৬০ টেস্টের ভুয়া রিপোর্ট সরবরাহ করে।
পুলিশ জানিয়েছে, জেকেজি হেলথকেয়ার থেকে ২৭ হাজার রোগীকে করোনার টেস্টের রিপোর্ট দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১১ হাজার ৫৪০ জনের করোনার নমুনার আইইডিসিআরের মাধ্যমে সঠিক পরীক্ষা করানো হয়েছিল। বাকি ১৫ হাজার ৪৬০ রিপোর্ট প্রতিষ্ঠানটির ল্যাপটপে তৈরি করা হয়। জব্দ করা ল্যাপটপে এর প্রমাণ মিলেছে। আরিফ চৌধুরীকে জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে জানান, জেকেজির ৭-৮ কর্মী ভুয়া রিপোর্ট তৈরি করেন।
জেকেজির মাঠকর্মীরা ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, নরসিংদীসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে করোনা উপসর্গ দেখা দেয়া মানুষের নমুনা সংগ্রহ করতেন। প্রতি রিপোর্টে ৫-১০ হাজার টাকা নেয়া হতো। আর বিদেশিদের কাছ থেকে নেন ১০০ ডলার। সেই হিসাবে করোনা পরীক্ষার ভুয়া রিপোর্টে প্রায় ৮ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে জেকেজি।
২৪ জুন জেকেজির গুলশান কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে প্রতারক আরিফসহ ছয়জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তাদের দুদিনের রিমান্ডে নেয়া হয়। দুজন আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। জেকেজির কার্যালয় থেকে ল্যাপটপসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথি জব্দ করে পুলিশ। এ ঘটনায় তেজগাঁও থানায় চারটি মামলা হয়েছে। এসব মামলার কোনোটিতে এখন পর্যন্ত ডা. সাবরিনার নাম সংযুক্ত করা হয়নি। চারটি মামলার তদন্ত করছে তেজগাঁও থানা পুলিশ।
আরিফ গ্রেফতার হওয়ার পর ডা. সাবরিনা গ্রেফতার-আতঙ্কে গা ঢাকা দেন। আড়ালে ‘অদৃশ্য শক্তির’ ইশারায় দায়মুক্তির চেষ্টায় ছিলেন তিনি।
করোনা মহামারীতে মানুষের জীবন নিয়ে নির্মম প্রতারণায় নাম উঠে আসা ডা. সাবরিনা এ চৌধুরী সরকারি একটি হাসপাতালে চাকরির পাশাপাশি জেকেজির চেয়ারম্যান। তিনি জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চিকিৎসক। পাশাপাশি তিনি জেকেজি হেলথকেয়ারের চেয়ারম্যান।
Discussion about this post