মাজহারুল ইসলাম*
আমরা প্রায়শই বলে থাকি যে প্রযুক্তি বিশ্বকে ছোট করেছে, কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম পৃথিবীকে আরো ছোট করে তুলেছে। সাধারণত আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে থাকি মতামত প্রদানের ক্ষেত্রে, আর তা নাগরিক সাংবাদিকতা সম্পাদনের জন্য একটি জনপ্রিয় মাধ্যম হিসেবে পরিণত হয়েছে। গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে, সামাজিক অংশগ্রহণমূলক শাসনব্যবস্থা উৎসাহিত করার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কে অন্যতম প্রধান হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।
একটি গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে বাক স্বাধীনতার বিষয়টি বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৯ ও ৪৩ দ্বারা স্বীকৃত। সংবিধানে বাকস্বাধীনতা সুরক্ষা থাকা সত্ত্বেও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫, ২৮, ২৯, ৩১ ও ৩২ ধারা বর্তমান সময়ে উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। উপরন্তু মাত্রাতিরিক্ত বিবেচনা মূলক ক্ষমতা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন ও বাংলাদেশের উচ্চ আদালতের বাক স্বাধীনতার উপর সকল সিদ্ধান্তসমূহের পরিপন্থী।
যদিও আন্তর্জাতিক আইনে স্পষ্ট আকারে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে বাকস্বাধীনতা প্রকাশের কথা উল্লেখ নেই, তথাপি আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক কনভেনশন গুলোতে পরোক্ষভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাকস্বাধীনতা প্রকাশের বিষয়টি বিদ্যমান। অনুচ্ছেদ ১৯ মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্র মতে ‘ব্যক্তি তার পছন্দ অনুযায়ী স্থানে বাকস্বাধীনতা প্রকাশের অধিকার রাখে’। আইসিসিপিয়ারের অনুচ্ছেদ ১৯(২) অনুযায়ী ‘বাকস্বাধীনতা প্রকাশের ক্ষেত্রে কোন মাধ্যম বা সীমানা বিবেচ্য বিষয় হতে পারে না, বা বাকস্বাধীনতা প্রকাশের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে না’।অনুচ্ছেদ ১০ ইসি এইচ আর মতে ‘বাকস্বাধীনতা প্রকাশের ক্ষেত্রে সরকার বাধা সৃষ্টি করবে না এবং তা হবে যেকোন মাধ্যমে ও সীমানা নির্বিশেষে’। অনুচ্ছেদ ১০ এসি এইচ আর অনুযায়ী ‘বাকস্বাধীনতা প্রকাশ হতে পারে মৌখিকভাবে, লিখিত বা মুদ্রন আকারে বা অন্য কোনো মাধ্যমের মধ্যে দিয়ে’। অতএব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাকস্বাধীনতার প্রকাশ ব্যক্তির অন্যতম অধিকার যা আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক কনভেনশনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত, এবং তা সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ ও তার বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে গঠনমূলক সমালোচনার অন্যতম প্রধান মাধ্যম।
সরকারের গঠনমূলক সমালোচনার ক্ষেত্রে বাকস্বাধীনতার প্রয়োজন যেমন জরুরী, ঠিক তেমনি ভাবে যৌক্তিক বিষয়ের উপর তার নিয়ন্ত্রণ আরো বেশি প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কঠোর নজরদারি রাখতে হবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের উপর, যাতে করে কোন দুষ্কৃতিকারী বাকস্বাধীনতার নামে জাতীয় স্বার্থ বিরোধী কাজ ও ধর্মীয় উগ্রবাদ বা জঙ্গিবাদে লিপ্ত হতে না পারে। সর্বোপরি বাংলাদেশের সংবিধান, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক আইনসমূহের প্রণীত বিধানসমূহের মধ্যে সামাঞ্জস্যতা অতীব জরুরী।
সুতরাং একটি সুন্দর, সামাঞ্জস্যপূর্ণ নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থা অতীব প্রয়োজনীয় বর্তমান সামাজিক ব্যবস্থা ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ব্যাপক বিস্তার ও এর যুক্তিযুক্ত নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে। এক কথায় একটি নিজস্ব বৈশিষ্ট্যমন্ডিত আইন প্রয়োজন (হতে পারে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধনের মাধ্যমে), যা নাগরিক সাংবাদিকতাকে উৎসাহ প্রদানের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে আরো শক্তিশালীকরন ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যুগান্তকারী ভূমিকা পালনের মাধ্যমে বাক স্বাধীনতার নিশ্চয়তা প্রদান ও এর অপব্যবহার রোধকল্পে কাজ করবে।
*পিএইচডি গবেষক সাউথ এশিয়ান ইউনিভার্সিটি, নয়াদিল্লি, ভারত। ইমেইল: talukderlaw@gmail.com
Discussion about this post