রীনা পারভীন মিমি
আমাদের দেশে আইনগত বিবাহের চেয়ে শরীয়তসম্মত বিবাহের প্রবণতা বেশী। অথচ ১৯৬১ সালের মুসলিম বিবাহ ও পরিবার আইন অর্ডিন্যান্স এর বিধানমতে প্রতিটি মুসলিম বিবাহ রেজিস্ট্রি করা আবশ্যকীয়। রেজিস্ট্রেশন হচ্ছে তালিকাভূক্তি। আইনের দ্বারা নির্ধারিত তথ্যাবলী দিয়ে নির্দিষ্ট ফরম পূরণ করে সরকারিভাবে বিবাহ তালিকাভূক্তি করাই হচ্ছে বিবাহ রেজিস্ট্রেশন।
বিয়ের সময় আমাদের নজর থাকে সঠিকভাবে উচ্চারণ- কবুল, কবুল, কবুল বলা হয়েছে কিনা? অথচ আমরা রেজিস্টার নিয়ে সচেতন নই, কিন্তু এ সচেতনতা খুব প্রয়োজন। কাবিননামায় নির্ধারিত দেনমোহর ঠিকমত লিখা হলো কিনা তা লক্ষ্য রাখা উচিত। প্রতিটি মেয়ের তার কাবিননামাটি নিজ সংগ্রহে রাখা উচিত। এখন আসা যাক কাবিননামা নিজ সংগহে কেন রাখা উচিত? ক) বিয়ের পক্ষদ্বয় বিয়ে অস্বীকার করতে পারেনা এবং পরস্পর পরস্পরের প্রতি কিছু দায়-দায়িত্ব পালনে বাধ্য হয়। খ) স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করলে বা স্ত্রীর বিনা অনুমতিতে বিয়ে করলে বা করার উদ্যোগ নিলে স্ত্রী আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারেন। গ) স্বামীর কাছ থেকে স্ত্রী দেনমোহর ও ভরণপোষণ আদায় করতে পারেন। ঘ) স্বামী/স্ত্রী উভয়ে উভয়ের সম্পত্তির বৈধ উত্তরাধিকার হতে পারেন। ঙ) বিয়ের সময় দেনমোহর ধার্য্য না হলেও স্ত্রী ন্যায্য দেনমোহর আদায় করতে পারেন।
বিয়ে রেজিস্ট্রেশনের সময় বিয়ের কাজীর কতকগুলি বিষয় সাবধানতার সাথে খেয়াল রাখতে হয়। বিষয়গুলো হলো: বরের বয়স কমপক্ষে ২১ এবং কনের বয়স কমপক্ষে ১৮ হয়েছে কিনা এবং বর ও কনের বিয়েতে পূর্ণ সম্মতি আছে কিনা। এছাড়াও বিয়ের প্রকৃত সাক্ষী এবং আশু ও বিলম্বিত দেনমোহর। বিয়েতে উল্লেখিত শর্তসমূহ পূরণ হলেই কেবলমাত্র কাজী (নিকাহ রেজিষ্টার) বিয়ে রেজিস্ট্রি করবেন। তবে তিনি কাবিননামার ১৮ নং ঘরে স্ত্রীকে তালাক প্রদানের (তালাক-ই- তৌফিজের) ক্ষমতা দেয়া হয়েছে কি না সেই বিষয়টিও গুরুত্বের সাথে খেয়াল করবেন।
রেজিস্ট্রি করতে যা দরকার-
(১) জাতীয় আইডি কার্ড (২) স্কুলের সার্টিফিকেট যেমন জেএসসি/জিডিসি/এসএসসি/এইচএসসি (৩) পাসপোর্ট বা জন্মনিবন্ধন সার্টিফিকেট (৪) ন্যূনতম দুজন সাক্ষী (৫) এ ছাড়া পাত্র বা পাত্রীর একজন অভিভাবক থাকবেন, যিনি উকিল বাবা হবেন।
বিয়ে নিবন্ধন ফি-
বিয়ের নিবন্ধন ফি মোহরানার ওপর নির্ভর করে। মোহরানা প্রতি লাখে ১২৫০ টাকা দিতে হয়। এ ছাড়া চার লাখের বেশি হলে প্রতি লাখে আরো ১০০ টাকা যোগ করতে হবে।
বিয়ে রেজিস্ট্রি না করার শাস্তি-
১৯৭৪ সালের মুসলিম বিবাহ ও তালাক (রেজিস্ট্রেশন) আইনটি ২০০৫ সালে সংশোধনী আনা হয় এবং বিবাহ রেজিস্ট্রেশন না করাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। ওই সংশোধনীতে বলা হয়েছে, নিকাহ্ রেজিস্ট্রার বা কাজী বিবাহ সম্পন্ন হবার সঙ্গে সঙ্গেই বিবাহ রেজিস্ট্রেশন করবেন অথবা তিনি ছাড়া অন্য কেউ বিবাহ সম্পন্ন করলে ৩০ দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট নিকাহ্ রেজিস্ট্রার বা কাজীর নিকট বিবাহের তথ্য প্রদান করতে হবে এবং কাজী উক্ত তথ্য প্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে বিবাহ রেজিস্ট্রি করবেন। যদি কেউ বিবাহ রেজিস্ট্রেশনের এসব বিধান লঙ্ঘন করেন তাহলে তার ২ (দুই) বছর বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা ৩০০০ (তিন হাজার) টাকা জরিমানা বা উভয়দণ্ড হতে পারে। আইন অনুযায়ী কেউ যদি রেজিস্ট্রেশন বিষয়ে ভুক্তভোগী হয়ে থাকেন তবে প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট অভিযোগ দায়ের করতে পারেন। উল্লেখ্য যে, রেজিস্ট্রেশন না হলে বিবাহ বাতিল হয় না তবে আইনগত অধিকার থেকে বঞ্চিত হবার সম্ভাবনা থাকে।
রেজিস্ট্রির বাড়তি সুবিধা-
সন্তানের অভিভাবকত্ব নির্ণয় করতে সহজ হয় এবং স্বামী দ্বিতীয় বিবাহের জন্য উদ্যোগী হলে স্ত্রী আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারেন। তাছাড়া রেজিস্ট্রেশনের ফলে বাল্য বিবাহ রোধ সম্ভব হয়।
লেখকঃ আইনজীবী।
Discussion about this post