সরকার ও বিচার বিভাগের বিভিন্ন কার্যকর উদ্যোগের ফলে আদালতগুলোতে গত দুই বছরে মামলা নিষ্পত্তিতে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। তার পরও মামলাজটে হিমশিম খেতে হচ্ছে আদালত, বিচারক ও ভুক্তভোগীদের। মামলাজট নিরসনে সরকার ও বিচার বিভাগ থেকে বিভিন্ন ধরনের প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে। বিচার বিভাগ-সংশ্লিষ্ট আইনজ্ঞরা প্রস্তাব করেছেন, বিচারকের সংখ্যা ও সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে মামলার জট দূর করা সম্ভব। আবার সরকার-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, বিদ্যমান আইনের সঠিক ও নিরপেক্ষ প্রয়োগের মাধ্যমেই সম্ভব মামলার জট নিরসন করা। ফলে মামলাজট থেকে উত্তরণ ঘটছে না কিছুতেই।
গত দুই বছরের মামলাজট পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সরকার ও বিচার বিভাগের কার্যকর পদক্ষেপের ফলে আদালতগুলোতে মামলা দায়েরের চেয়ে নিষ্পত্তিতে দৃষ্টিগ্রাহ্য অগ্রগতি হয়েছে। গত বছর দেশের সব আদালতে মামলা হয় মোট তিন লাখ ৭৬ হাজার ৮২০টি। একই সময়ে নিষ্পত্তি হয়েছে তিন লাখ ৫১ হাজার ৫৬৪টি। এর পরেও ২০১৫ সালের তুলনায় বিদায়ী বছরে (২০১৬) মামলাজট বেড়েছে ৪৬ হাজার ৯১১টি। পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৭ সালের পর মামলাজট বৃদ্ধির হার গত বছর সবচেয়ে কম। তবে পুরনো মামলা নিষ্পত্তির হার আশানুরূপ না হওয়ায় উচ্চ ও অধস্তন আদালতে বর্তমানে সাড়ে ৩১ লাখ মামলাজট রয়েছে। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা একে আখ্যায়িত করেছেন ‘দুরারোগ্য ব্যাধি’ বলে।
সুপ্রিম কোর্টের তথ্যানুসারে, ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর বিচার বিভাগ পৃথক্করণের সময় দেশের সব আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ছিল ১৫ লাখ ৭০ হাজার। বর্তমানে দেশের সব আদালতে মামলার সংখ্যা ৩১ লাখ ৫৬ হাজার ৮৭৮টি। এর মধ্যে ২০১৫ এবং ২০১৬ সালে দেশের সব আদালতে নিষ্পত্তি হয়েছে ২৭ লাখ ৬০ হাজার ২৪০টি মামলা । অন্যদিকে ২০১৩ ও ২০১৪ সালে দেশের সব আদালতে মামলা নিষ্পত্তির পরিমাণ ছিল ২৪ লাখ ২৩ হাজার ৮৩৮টি। ফলে নিষ্পত্তির হার শতকরা প্রায় ১৪ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে।
পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক অধস্তন আদালতের প্রায় দুই ডজন বিচারকের সঙ্গে আলাপচারিতায় জানা যায়, ১৮৭২ সালে প্রণীত সাক্ষ্য আইন সংশোধনের মাধ্যমে যুগোপযোগী করলে এবং বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি ব্যবস্থা (এডিআর) কার্যকর হলে মামলাজট নিরসনে সরকার ও বিচার বিভাগের স্বপ্ন বাস্তব রূপ পেতে পারে। না হলে মামলাজটের এ বোঝা যুগের পর যুগ চলতেই থাকবে।
অবশ্য আইনমন্ত্রীও মামলাজট নিরসনে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি এডিআর কার্যকর এবং বিদ্যমান আইন সংশোধনের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। এ প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আদালতের মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তি হতে গেলে কিছু ক্ষেত্রে সময় লাগে। বিকল্প হিসেবে বিরোধ নিষ্পত্তি প্রক্রিয়াকে জনপ্রিয় করতে হলে বাদী ও বিবাদী উভয়ের এর ওপর বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপন করতে হবে। এভাবে আমাদের সক্ষমতা বাড়বে এবং অর্থ ও সময় বাঁচবে। এতে দেশও উপকৃত হবে।’
উচ্চ আদালত: ২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত আপিল বিভাগে বিচারাধীন মামলা ১৩ হাজার ৬৭২টি। এর মধ্যে দেওয়ানি ৯ হাজার ৯৭৫২টি, ফৌজদারি তিন হাজার ৮৩৬টি ও অন্যান্য ৮৪টি মামলা। এর আগে ২০১৫ সালে আপিল বিভাগে বিচারাধীন মামলা ছিল ১২ হাজার ৭৯২টি। দুই বছরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী আপিল বিভাগে মামলাজট বেড়েছে ৮৮০টি। অন্যদিকে হাইকোর্টে ২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিচারাধীন চার লাখ ২৪ হাজার ৯৯৪টি মামলা। এর মধ্যে দেওয়ানি ৯০ হাজার ২৪৮ ও ফৌজদারি ২ লাখ ৫৭ হাজার ৪৮১ টি মামলা। এ ছাড়া রিট ৬৯ হাজার ৩২৬টি, আদিম মামলা (অন্যান্য) সাত হাজার ৯৩৯টি। আগের বছর ২০১৫ সালে হাইকোর্টে বিচারাধীন মামলা ছিল তিন লাখ ৯৯ হাজার ৩০৩টি। দুই বছরে হাইকোর্টে মামলাজট বেড়েছে ২৫ হাজার ৬৯১টি।
অধস্তন আদালত: ২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের জেলা ও দায়রা জজসহ সব ধরনের ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন মামলা রয়েছে ২৭ লাখ ১৮ হাজার ২১২টি। এর মধ্যে দেওয়ানি মামলা ১২ লাখ পাঁচ হাজার ২৫৪ ও ফৌজদারি ছয় লাখ ৪৭ হাজার ৪২২টি। অন্যদিকে একই সময় পর্যন্ত সব ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে (সিএমএম/সিজেএম) বিচারাধীন ফৌজদারি মামলা রয়েছে আট লাখ ৬৫ হাজার ৫৩৬টি। এর আগের বছর ২০১৫ সালে দেশের সব অধস্তন আদালতে বিচারাধীন ছিল ২৬ লাখ ৯৭ হাজার ৮৭২টি মামলা। দুই বছরের পরিসংখ্যান বলছে, মামলাজট বেড়েছে ২০ হাজার ৩৪০টি।
নিরসনের উপায়: দেশে বিদ্যমান দেওয়ানি কার্যবিধির বয়স ১০৮ বছর। ফৌজদারি কার্যবিধির বয়স ১১৮ বছর। সাক্ষ্য আইনের বয়স ১৪৪ বছর। এসব কার্যবিধি বর্তমান আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে অনেকটাই অকার্যকর। বিচারপ্রার্থী মানুষকে দ্রুত প্রতিকার দিতে হলে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণের পাশাপাশি শতাব্দীপ্রাচীন এসব আইনেরও ব্যাপক সংস্কার ও প্রয়োজনীয় নতুন আইন প্রণয়ন জরুরি। এর মধ্যে ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইনের কয়েকটি ধারা সংশোধন অপরিহার্য। কারণ দেওয়ানি ও ফৌজদারি উভয় মামলার ক্ষেত্রেই বিশেষজ্ঞের সাক্ষ্য বা অভিমত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, কোনো বিশেষজ্ঞ কোনো বিষয়ের ওপর তার অভিমত দিয়ে লিখিত প্রমাণপত্র দেওয়ার দীর্ঘ সময় পর তাকে আবার আদালতে সাক্ষী হিসেবে তলব করা হয়। মধ্যবর্তী এ সময়ে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ মারা যেতে পারেন, অবসরে অথবা বিদেশেও যেতে পারেন। এমন ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞের সাক্ষ্যের জন্য মামলা-মোকদ্দমা দীর্ঘায়িত হয় বছরের পর বছর। এসব প্রেক্ষাপটে সাক্ষ্য আইনের ৪৫ থেকে ৫১ ধারায় বিশেষজ্ঞের অভিমত, ৫৬ থেকে ৫৮ ধারা এবং ৩০ ও ৯০ ধারা অবিলম্বে সংশোধন করা প্রয়োজন বলে মনে করেন আইনজ্ঞরা।
এই ধারাগুলো সংশোধনের বিষয়ে অধস্তন আদালতের বিচারকরা বলছেন, ৫৭ ধারা অনুসারে কোনো নির্দিষ্ট মামলায় বিচারকের বিবেচনায় কী কী বিষয় আছে, তা নির্দিষ্ট করা থাকলে বাদী-বিবাদী উভয়পক্ষকে ওই বিষয়ে প্রশ্ন বা জেরা করা থেকে বিরত রেখে বিচারিক সময় দ্রুত কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। কারণ একটি মামলার ক্ষেত্রে স্বীকৃত ঘটনার একটি তালিকা উভয় পক্ষের ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রণয়ন করা গেলে অযথা প্রশ্ন বা জেরা করার প্রয়োজন হয় না। ফলে মামলা নিষ্পত্তিতে দ্রুত প্রতিকার পাওয়া যাবে। সাক্ষ্য আইনের ৯০ ধারা অনুসারে ত্রিশ বছরের পুরাতন দলিল দিয়ে মামলা-মোকদ্দমা করার সুযোগ রয়েছে। এ কারণে ৩০ বছরের পুরনো জাল দলিল দিয়ে সম্পত্তি দখল করে বৈধ মালিক সেজে অনেকেই অহরহ ভূ-সম্পত্তি ভোগদখল করছেন। আর প্রকৃত মালিক তার বৈধ স্বত্ব হারিয়ে পথে পথে ঘুরছেন। এ জন্য এই ধারাটিও সংশোধন হওয়া প্রয়োজন। এ ছাড়া সাক্ষ্য আইনের ৬০ ধারায় মৌখিক সাক্ষ্য অবশ্যই প্রত্যক্ষ হতে হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এটা সংশোধন করে বর্তমান প্রেক্ষাপটে ‘অপ্রত্যক্ষ’ সাক্ষ্য গ্রহণ করার ব্যবস্থা করতে হবে। এর ফলে তথ্যপ্রযুক্তির বিভিন্ন উপাদান, যেমন মোবাইল, অডিও, ভিডিও, স্থিরচিত্র ইত্যাদিতে দেওয়া বক্তব্য মৌখিক সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা সম্ভব হবে।
একই সঙ্গে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার ও বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি ব্যবস্থা আরও কার্যকর করা প্রয়োজন। বিদ্যমান আইন সংশোধন করে এ বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করতে হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
প্রতিক্রিয়া: বিশিষ্ট আইনজীবী ড. কামাল হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘মামলাজট নিরসনে দক্ষ ও যোগ্যতাসম্পন্ন আরও বেশিসংখ্যক বিচারক নিয়োগ দিতে হবে। শুধু আইন সংস্কার করে দ্রুত ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা যাবে না।’
মামলাজট নিরসনে এডিআরের ওপর গুরুত্বরোপ করে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, ‘বিচারকাজ বিলম্বিত হলে বিচারপ্রার্থীরা হতাশায় ভোগে। আবার বিরোধের নিষ্পত্তি দীর্ঘায়িত হলে আরও বিরোধ সৃষ্টির আশঙ্কা থাকে। এ জন্য যেগুলো বাদী-বিবাদীদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে (মীমাংসাযোগ্য) নিষ্পত্তি করা যায়, সেগুলো এডিআরের আওতায় নিষ্পত্তি করতে হবে।’
শফিক আহমেদ আরও বলেন, ‘শত বছরের পুরনো আইন দিয়ে বিচারকাজ পরিচালনা করায় নানা অসুবিধা হচ্ছে। তাই পুরনো আইনগুলো দ্রুত সংশোধন হওয়া জরুরি।’
মামলাজট নিরসনের জন্য বিচারাঙ্গনে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতি বন্ধ করা প্রয়োজন উল্লেখ করে বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল বাসেত মজুমদার গণমাধ্যমকে বলেন, ‘মামলা হওয়ার পর একপক্ষ এর দ্রত নিষ্পত্তি চাইলেও অপরপক্ষ চায় তা ঝুলিয়ে রাখতে। এসব কাজে বিচারাঙ্গনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও ব্যবহার করে তারা। এটা দুর্নীতি। মামলাজট নিরসন করতে হলে এই দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে।’
ফৌজদারি বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ খুরশীদ আলম খান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বিচারের ক্ষেত্রে সাক্ষ্য আইনের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। সমাজে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হলে এবং দ্রুত মামলা-মোকদ্দমা নিষ্পত্তির প্রয়োজনে বিদ্যমান সাক্ষ্য আইনের ব্যাপক সংশোধন জরুরি।’
আবু সালেহ রনি/সমকাল
Discussion about this post