সুপ্রিম কোর্টে অনলাইন কজলিস্ট (মামলার দৈনন্দিন কার্যতালিকা) চালুর পর এখনো সেভাবে জনপ্রিয়তা অর্জন করেনি। সাধারণ মানুষ তো দূরে থাক, খোদ আইনজীবীদেরই আগ্রহ কম অনলাইন কজলিস্টে। এ ছাড়া মামলার রায় ওয়েবসাইটে দেওয়ার ক্ষেত্রে আপিল বিভাগ ত্বরিত থাকলেও হাইকোর্ট বিভাগের অধিকাংশ বেঞ্চেই ফলাফল দেওয়া হয় না। দুই-একটি বেঞ্চে সব মামলার শুনানির ফল দেওয়া হয় একেবারে দিনশেষে। তাই অনলাইন কজলিস্ট থেকে বিচারপ্রার্থী মানুষ খুব বেশি সুফল পান না।
এ ছাড়াও অনলাইন কজলিস্ট নিয়ে সেভাবে প্রচারণা না থাকায় সাধারণ বিচারপ্রার্থীদের খুব কম লোকই জানেন এই সেবা সম্পর্কে। যারা প্রতিনিয়ত আদালতে মামলা নিয়ে আসেন তাদের কেউ কেউ হয়তো এই সেবা সম্পর্কে জানেন।
অনলাইনে বিচারপ্রার্থীদের কজলিস্ট দেখতে সহায়তার জন্য সুপ্রিম কোর্টের মূল ভবনে আইনজীবী সমিতি ভবন সংলগ্ন নিচতলার গেটে অনলাইন কজলিস্ট সহায়তা কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। মাস ছয়েক হলো সেখানে কাজের জন্য দু’জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
প্রতিদিন সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগ মিলে শুনানির জন্য কয়েক হাজার মামলা কার্যতালিকায় থাকলেও খুব সামান্য সংখ্যক মানুষই এই তথ্য সহায়তা কেন্দ্রে আসেন সেবা নিতে। সহায়তা কেন্দ্রে যোগদান করা দু’জনের মধ্যে একজনের নাম শাকিল। তাদের কাছে প্রতিদিন কেমন লোক কজলিস্ট সম্পর্কে সহায়তা চান? জানতে চাইলে গণমাধ্যমকে তিনি বলেছেন, ‘প্রতিদিন হয়তো ১৪/১৫ জন লোক আসে বিভিন্ন বিষয়ে জানতে।’
এই তথ্য সহায়তা কেন্দ্র থেকে আর কি কি সেবা দেওয়া হয় জানতে চাইলে তিনি বলেছেন, ‘আমরা অনলাইনে কজলিস্ট দেখি। এ ছাড়া এই মামলার সর্বশেষ অবস্থা কি ও এটি কোন পর্যায়ে আছে তা এখান থেকে মানুষকে জানাই।’
বিচার বিভাগে ডিজিটালাইজেশনের অংশ হিসেবে ২০১৬ সালে এই অনলাইন কজলিস্ট চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়। পরবর্তীতে সুপ্রিম কোর্ট সিদ্ধান্ত নেয়, কাগজে কজলিস্ট ছাপা বন্ধ করে দিয়ে অনলাইনেই শুধু কজলিস্ট ছাপা হবে। সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন তখন বলেছিল ছাপা কজলিস্ট বন্ধ করে দেওয়া হলে অন্তত ২১ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। তবে আইনজীবীদের বিরোধিতার মুখে ওই বছর ১ ফেব্রুয়ারি প্রথম দফায় ও ৩ এপ্রিল দ্বিতীয় দফায় উদ্যোগ নিয়েও তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। তারপর আর ছাপা কজলিস্ট বন্ধের কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
কাগজে কজলিস্ট বন্ধ করে শুধু অনলাইনে চালুর বিষয়ে সবশেষ অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার (প্রশাসন ও বিচার) সাব্বির ফয়েজ গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘এ বিষয়ে পরে আর কোনো আলোচনা হয়নি। এখন অনলাইন ও ছাপা দুই ধরনের কজলিস্টই চলছে।’
এদিকে সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে মামলার কজলিস্টের পাশে মামলার ফলাফল এর একটা ঘর আছে। মামলার শুনানি শেষেই আপিল বিভাগে ফলাফল দিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু ওয়েবসাইটে দেখা যায় হাইকোর্ট বিভাগে অধিকাংশ বেঞ্চেই মামলার ফলাফল শুনানি শেষে তাৎক্ষণিকভাবে দেওয়া হয় না। ওই ঘর ফাঁকাই থাকে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাব্বির ফয়েজ বলেছেন, ‘আপিল বিভাগে নিয়মিত আপডেট হলেও হাইকোর্ট বিভাগের অনেক বেঞ্চেই তা হয় না। কজলিস্ট আপডেট করার দায়িত্ব তো প্রত্যেক বেঞ্চের বেঞ্চ অফিসারদের উপর থাকে। আমাদের নির্দেশনা আছে এটা করার। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে টেকনিক্যাল কারণে এবং দক্ষ জনবলের অভাবে সবক্ষেত্রে এটা করা যাচ্ছে না। নিয়মিত আপডেটের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন কাজ করছে।’
অনলাইন কজলিস্ট ছাড়াও সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে বার্ষিক ক্যালেন্ডার, প্রধান বিচারপতিসহ অন্য সব বিচারপতির নামের তালিকা, প্রধান বিচারপতিসহ অন্য সব বিচারপতির সংক্ষিপ্ত বায়োগ্রাফি, সুপ্রিম কোর্টে কর্মরত বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের নামের তালিকা, কেস সার্চ, কজলিস্ট অ্যাপস, বাংলাদেশের বিচার বিভাগের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, বিভিন্ন নোটিস, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি থাকে।
ওয়েবসাইটে হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগের রুলসও রয়েছে। এ ছাড়া সুপ্রিমকোর্টের ওয়েবসাইটে বাংলাদেশের সংবিধান, দেশে প্রচলিত অনেক আইন ও আইন মন্ত্রণালয়ের লিঙ্ক রয়েছে। বিচারকদের অনলাইনে ছুটির ব্যবস্থা করতে ইতোমধ্যে একটি ই-এপ্লিকেশন সফটওয়্যারও তৈরি করা হয়েছে।
শুধু সুপ্রিম কোর্ট নয়, পুরো বিচার বিভাগে ডিজিটাইজেশন উদ্যোগের অংশ হিসেবে আরও বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন বর্তমান প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। এর অংশ হিসেবে সিলেটের ২০টি আদালতে ডিজিটাল এভিডেন্স রেকর্ডিং চালু হয়েছে। শিগগিরই দেশের ৬৪টি জেলার আদালতেও এ প্রকল্প চালু হচ্ছে। চাঞ্চল্যকর মামলার আসামি ও জঙ্গিদের বিচার কাজ ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে পরিচালনার বিষয়টিও ভাবা হচ্ছে।
তবে বিচার বিভাগকে পরিপূর্ণ ডিজিটাইজেশন করার ক্ষেত্রে অনেক সময় আইনজীবীদেরই অনাগ্রহ দেখা যায়। বিশেষ করে কাগজ বাদ দিয়ে শুধু অনলাইনে কজলিস্ট চালুর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি বিরোধিতা করেছেন আইনজীবীরা। তাদের যুক্তি, সুপ্রিম কোর্টের প্রায় ছয় হাজার আইনজীবীর সবাই তো আর ইন্টারনেট ব্যবহারে দক্ষ নয়। এ ছাড়া সার্ভার সিস্টেমও ততোটা শক্তিশালী না।
শুধুমাত্র অনলাইনে কজলিস্ট চালুর বিষয়ে অনীহার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘শুধু বাংলাদেশ নয়, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশসহ বিশ্বের অনেক দেশেই ছাপা কজলিস্ট আছে। এ ছাড়া বাংলাদেশে আইটি ও সার্ভার সিস্টেম এতোটা শক্তিশালী হয়নি যে শুধু অনলাইনে কজলিস্ট থাকাটা যথেষ্ট হবে।’
সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ২০১৫ সালের ১ নভেম্বর থেকে পরীক্ষামূলকভাবে অনলাইনে দৈনন্দিন মামলার কার্যতালিকা সংশ্লিষ্ট কোর্টের বেঞ্চ অফিসাররা লিপিবদ্ধ করে আসছেন। সম্প্রতি এ ব্যাপারে যাবতীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য গঠন করা হয়েছে অনলাইন দৈনন্দিন কার্যতালিকা পর্যবেক্ষণ কমিটি।
পর্যবেক্ষণ কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, সার্ভার যেন ডাউন না হয়, সেজন্য ব্যাকআপ সার্ভার রাখা, সাবমেরিন কেবল সেবায় কোনো কারণে সাময়িক বিপত্তি এলেও অনলাইন দৈনন্দিন কার্যতালিকায় যাতে ইনপুট দেওয়া যায়, সেজন্য স্যাটেলাইট বেজড ইন্টারনেট সংযোগ রাখা হবে। ইতোমধ্যে আইসিটি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল হার্ডওয়্যার সাপোর্ট দেওয়ার জন্য এবং প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের এ টু আই প্রজেক্ট থেকে সফটওয়্যার সাপোর্ট দেওয়ার জন্য একটি প্রকল্প কাজ করছে।
সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন এমন পদক্ষেপের কথা বললেও সার্ভার সিস্টেম শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তন হয়নি বলে জানিয়েছেন জয়নুল আবেদীন। তিনি বলেছেন, ‘সার্ভারে কোনো আপগ্রেডেশন হয়নি। আগের অবস্থাতেই আছে। এখনও বহু সময় সার্ভার ডাউন থাকে। তাই ছাপা বাদ দিয়ে শুধু অনলাইন কজলিস্ট চালু হলে আইনজীবীরা কেবল নন, পুরো বিচার কার্যক্রম পরিচালনাই অসুবিধার মধ্যে পড়বে।’
সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন দপ্তর জানিয়েছে, প্রতিদিন রাত ৮টার মধ্যে আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগের বেঞ্চ কর্মকর্তারা পরের দিনের মামলার তালিকার খসড়া পাঠিয়ে দেন বেঞ্চ ও ডিক্রি শাখায়। সংশ্লিষ্ট শাখার তত্ত্বাবধায়ক তা সংগ্রহ করে ছাপানোর জন্য পাঠিয়ে দেন সরকারি ছাপাখানায় (তেজগাঁও বিজি প্রেসে)। প্রতিদিন ভোরে প্রায় ৪০০ পৃষ্ঠার তিন হাজার কপি দৈনন্দিন কার্যতালিকা ছাপা হয়। পরদিন সেই তালিকা অনুসারে চলে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের মামলার কার্যক্রম।
ইন্টারনেট ব্যবহারে তুলনামূলক কম পারদর্শী বা ইন্টারনেটে অনভ্যস্ত প্রবীণ আইনজীবীরা নন, নবীনরাও ছাপা কজলিস্ট উঠিয়ে দেওয়ার বিপক্ষে। যারা সার্বক্ষণিক ইন্টারনেট সুবিধা ব্যবহার করে থাকেন তারাও মনে করছেন কাগজের কজলিস্ট উঠিয়ে দিলে অসুবিধা হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির কার্যনির্বাহী সদস্য ও তরুণ আইনজীবী কুমার দেবুল দে গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘কাগজে কজলিস্ট বন্ধের সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে আইনজীবীদের যে সাধারণ সভা হয়েছিল তাতে একজনও ছাপা কজলিস্ট উঠিয়ে দেওয়ার পক্ষে মত দেননি।’
তিনি আরও বলেছেন, ‘কাগজে কজলিস্ট বন্ধ হলে পুরো বিচার ব্যবস্থার উপরই প্রভাব পড়বে। এটা নতুন দুর্ভোগ সৃষ্টি করবে। এটা আসলে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারা না পারার সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। ডিজিটালাইজেশন প্রয়োজন আছে। তবে সবক্ষেত্রে ম্যানুয়েল সিস্টেম উঠিয়ে দেওয়া বাস্তবসম্মত হবে না।’
তবে এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের দায়িত্বপ্রাপ্তদের অনেকে মনে করেন, কজলিস্ট পুরোপুরি ডিজিটালাইজড হয়ে গেলে আইনজীবীদের উপর বিচারপ্রার্থীদের নির্ভরশীলতা অনেকাংশেই কমে যাবে। তারা মামলার অবস্থা জানাতে গিয়ে বিচারপ্রার্থী মানুষকে অনেক ক্ষেত্রেই সঠিক তথ্য দেন না। বিশেষ করে আইনজীবীর সহকারীরা এসব তথ্য সংগ্রহের নামে মক্কেলদের কাছ থেকে বাড়তি অর্থ আদায় করে থাকেন। মক্কেলদের নির্ভরশীলতা কমে যাওয়ার আশঙ্কা থেকেই এর বিরোধিতা করেন অনেক আইনজীবী।
-দ্য রিপোর্ট
Discussion about this post