ড. বদরুল হাসান কচি
শিরোনামের কথাটি কিছুদিন আগে একটি ইলেক্ট্রোনিক মিডিয়াতে এক আলোচকের মুখে শুনেছিলাম। তিনি নাকি সাবেক এক মন্ত্রীকে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করার প্রসঙ্গে কিছু জানতে চাইলে মন্ত্রি মহোদয় অক্ষমতা স্বীকার করে তাকে আক্ষেপ করে এই কথাটি বলেন। বলা যায় বর্তমান সামগ্রিক আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিবেচনায় জনগণের কাছে এই কথাটি সত্য প্রমাণিত।
অপরাধ নিয়ন্তন ও তদন্তকাজে ধীর গতির কারণে পুলিশের গতিশীলতা নিয়ে দেশজুড়ে জনমনে প্রশ্ন জেগেছে। সাথে যুক্ত হয়েছে সক্ষমতা বাড়ানোর দাবী। যদিও পুলিশের ঊর্ধ্বতনমহল গতিশীলতার অভিযোগ বরাবরই অস্বীকৃতি জানিয়েছেন এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পুলিশের অক্ষমতাকে অস্বীকার করে সক্ষমতা বাড়ানোর দাবী উড়িয়ে দিয়েছেন।
তাই এই দাবীর যৌক্তিকতা সন্ধানের চেষ্টা করা হয়েছে এই লেখায়। সম্প্রতি আশুলিয়ায় একটি চেকপোস্টে দুই পুলিশ কনস্টেবলের উপর দুর্বৃত্তরা হামলা চালিয়ে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে একজনকে হত্যা করেন, অন্যজন না জীবিত না মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আছেন। এটা দেশব্যাপী আলোচিত ঘটনা তাই সবারই জানা আছে। আলোচনার সুবিধার্থে আবার সামনে আনলাম। ঐ ঘটনা শুনে রীতিমতো অবাক হলাম, পুলিশ চেকপোস্ট বসিয়েছেন অথচ তার বন্দুকের গুলি লোড করা ছিলোনা। বন্দুক ছিলো কাঁধে আর গুলি ছিলো পকেটে। বুঝুন এবার কতোটা অপেশাদারিত্ব আচরণ। তবে ঐ ঘটনায় আরো একটি অপেশাদারিত্ব এবং দুঃখজনক ঘটনা ঘটলো, ঘটনার খুব নিকটে আরো তিনজন পুলিশ সদস্য তাদেরই কলিগদের এমন নিসংসভাবে হামলার শিকার হচ্ছে দেখে কাঁধে বন্দুক নিয়ে দৌড়ে পাশের বনে পালিয়ে বাঁচলেন! এই অপেশাদার অদক্ষ মনোবলহীন বাহিনীর কাছ থেকে জনগণ আর কেমন নিরাপত্তা প্রত্যাশা করে?
এই ঘটনার ঠিক দুই সপ্তাহ আগে রাজধানীর কল্যাণপুর এলাকায় তেমনি একটি ঘটনায় আরো এক পুলিশ সদস্য নিহত হলেন। তার মানে একই ঘটনাগুলো বার বার ঘটছে। এখন কি তাহলে পুলিশ চেকপোস্ট উঠিয়ে নিয়ে অপরাধীদের যাতায়াত নির্বিঘ্ন করবে? তা হয়তো নয়, কিন্তু এক্ষেত্রে পুলিশের দক্ষতা এবং পেশাদারিত্ব বাড়ানো প্রয়োজন তা কি করে অস্বীকার করবেন মাননীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রি? মনোবল হারিয়ে পুলিশ যদি নিরাপত্তা চৌকি বসায় সেক্ষেত্রে আসল অপরাধী হয়তো পুলিশের চোখ এড়িয়ে পার পেয়ে যেতে পারে, তারপর জনগণের জানমাল ক্ষতি করবে। ধরুন এভাবেই পুলিশের চোখ এড়িয়ে কোন অপরাধী পোঁছে যায় পুরনো ঢাকার হুসেনি দালানে এবং হামলা চালায় শিয়াদের তাজিয়া মিছিলে। যদি দক্ষ গোয়েন্দা পুলিশের কাছে আগেই তথ্য থাকতো এবং সেই তথ্যে চৌকস বাহিনী আগেই যাবতীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতো তাহলে হয়তো শতাধিক মানুষকে বোমা হামলার শিকার হয়ে হাসপাতালের বিছানায় যেতে হতো না।
এইসব ঘটনার হত্যাকারীদের সনাক্ত করতে পুলিশ তেমন কোন সন্তোষজনক প্রমাণ দেখাতে পারেননি। ঠিক একই সময়গুলোতে রাজধানীতে খুন হলেন এক প্রকাশক এবং মারাত্মকভাবে আহত হয়েছেন আরো এক প্রকাশক ও দুই লেখক। আমাদের সবার জানা কথা গত তিন বছরে দেশে আরো পাঁচজন লেখক ব্লগারকে নির্মমভাবে কুপিয়ে খুন করেছে দুর্বৃত্তরা। যদিও পরে অনলাইনে বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠীর নামে হত্যার দায় স্বীকার করা হয়েছে। ব্লগার রাজিব হত্যা মামলার কিছুটা অগ্রগতি হলেও বাকি সব মামলার তদন্ত চলছে ধীর গতিতে। পুলিশ এই সকল অপরাধীর কৌশলে পেরেই উঠতে পারছেন না। আবার দেখা গেলো এই অপরাধী চক্র দেশের অন্যান্য অনেক ব্লগার লেখককে নিয়মিত অনলাইনে হত্যার হুমকি দিয়ে আসছেন। দেশ তথ্য প্রযুক্তিতে এগিয়ে যাচ্ছে ঠিক কিন্তু দেশের আইন শৃঙ্খলা বাহিনী পুলিশের তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার জ্ঞান খুবই দুর্বল। এক্ষেত্রে তাদের দক্ষ জনবল বাড়ানো যেমন দরকার সেই সাথে বিদেশ থেকে অপরাধী সনাক্তকরণে নিত্য নতুন যন্ত্রপাতি আমদানি করাও প্রয়োজন। দুঃখজনক হলো বরাবরের মতো পুলিশ এই ব্যাপারেও তাদের দৃঢ় অবস্থানে। অক্ষমতা স্বীকার করেন না। আবার সক্ষমতার প্রমাণও দেখাতে পারেন না। তাই জনমনে স্বাভাবিকভাবে পুলিশের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ এসে যায়। আর এই প্রশ্ন থেকেই বিচারের প্রতি অনাস্থা জানিয়ে নিহত প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনের বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক ছেলে হত্যার বিচার না চেয়ে হত্যাকারীদের শুভবুদ্ধি উদয় ঘটানোর প্রত্যাশা করেছেন। অন্যদিকে সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এমএস কিবরিয়ার হত্যার বিচার প্রত্যাশা করে স্ত্রী চিত্রশিল্পী আসমা কিবরিয়া দশ বছর দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে গত কয়দিন আগে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। প্রচলিত এই কথাটি এখানে মনে পড়ে গেলো, বিচারের বানী নিরবে নিভৃতে কাঁদে।
বর্তমানে দেশে মোট পুলিশের সংখ্যা যত তাতে প্রায় বার তের শত মানুষের জন্যে একজন পুলিশ বরাদ্ধ আছে। অথচ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে এই সংখ্যা পাঁচ ছয়’শ। তাহলে এতো কম সংখ্যক পুলিশ সদস্য দিয়ে ভালো কিছু প্রত্যাশাও করি কি করে আমরা। বেশীরভাগ সময় একজন পুলিশ তার নির্দিষ্ট সময়ের চেয়ে বেশী সময় দায়িত্ব পালন করেন। সেক্ষেত্রে ঐ পুলিশ সদস্যের কাছ থেকে ভালো কোন সেবা আশা করাও অনেকটা অনুচিত। জন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার স্বার্থে দেশে আরো বেশী পরিমানে পুলিশ সদস্য বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। এজন্যে জাতীয় বাজেটে বরাদ্ধ বাড়ানো যেতে পারে। কারণ জন-শৃঙ্খলার উপর দেশের শান্তি এবং অর্থনীতির অগ্রগতি নির্ভর করে।
তাই সক্ষমতা বাড়ানোর দাবী এড়িয়ে যাবার কোন সুযোগ নেই। পাশাপাশি পুলিশের নৈতিক শক্তি বাড়ানো উদ্যোগ নেয়া এবং তাদের পেশায় স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ সৃষ্টি করাও সমান গুরুত্ব বহন করে।
লেখক: আইনজীবী,
Discussion about this post