ছোটবেলা মেলায় বা খেলনার দোকানে গেলে প্রথমেই বাচ্চারা কিনতে পছন্দ করে বন্দুক, পিস্তল জাতীয় খেলনাগুলো । হয়ত অনেক বাবা মায়েরা সাবধান করে এগুলো কিনে দেন আবার কেউ কেউ কিছু না জেনে বুঝে এগুলো কিনে দিয়ে সন্তানের সাহসের প্রশংসা করেন ! ছোট বেলার কথা মনে আছে – অনেক কষ্টে, অনেক চাওয়ার পর হয়ত পেতাম কিন্তু ব্যবহারে খুব সীমিত থাকতে হত বাবা মায়ের জন্যই । এখনকার প্রজন্ম আমাদের চেয়ে কোন জিনিস প্রাপ্তিতে অনেক বেশী এগিয়ে থাকে । অনেক সময় অনেক বাবা মা সন্তানদের সব কিনে দিয়েই নিজেদের ধন্য মনে করে । কিন্তু তারা জানেইনা কি ক্ষতি করছে তারা তাদের নিজেদের শিশুদের । এর সাথে নতুন যোগ হচ্ছে বিভিন্ন ধরণের টিভি অনুষ্ঠান ।
সেদিন আমারই পাশের এক বাড়িতে গেলাম । গিয়ে দেখলাম চার থেকে পাঁচ বছরের শিশু ভারতীয় চ্যানেলে সিআইডি নামক অনুষ্ঠানটি দেখছে । তার খুব মনোযোগ । দেখাচ্ছিল কিভাবে খুনীকে আবিস্কার করে পুলিশের স্পেশাল টিমগুলো । এই কাহিনী দেখাতে গিয়েই অনুষ্ঠানটিতে দেখালো অপরাধটি কিভাবে সংগঠিত করেছিলো অপরাধীরা !চোখের পলক না ফেলে ছোট্ট শিশুদের এমন অনুষ্ঠান দেখার প্রভাব কতটুকু তা কি কেউ পরিমাপ করছেন কখনও ?
শ্রীপুরের রাকিন । পরীক্ষা শেষ, দৌড়াদৌড়ি করে খেলা চলছে মাঠে । কে জানে তার খুব কাছের কেউই তাকে হত্যার পরিকল্পনা করে বসে আছে ! এক বিকেলে খেলতে গেল তারপর আর সে নাই । বাবা মা হন্যে হয়ে খুঁজেও তাকে পাচ্ছেনা । ছেলেটি কখনও কাউকে না বলে বাইরে থাকে না কিন্তু সেদিন আর ফিরে আসছেনা । পাঁচ ডিসেম্বর ছেলেটি নিখোঁজ হয় তারপর পাঁচদিন পর লাশ পাওয়া যায় ছেলেটির বাড়ির পাশে বাঁশ ঝাড়েই ।
দুজন আসামীকে গ্রেফতার করে গতকাল রা্যব-1 । যারা খুন করেছে তাদের মধ্যে একজন হল রাকিনকে প্রাইভেট টিউটর হিসেবে পড়াতো । আরেকজন ঐ গ্রামেরই নবম শ্রেণী পড়ুয়া ছাত্র । রাকিনের প্রাইভেট টিউটর পারভেজ এবং নবম শ্রেণী পড়ুয়া ফয়সাল মিলে পরিকল্পনা করে রাকিনকে হত্যা করে তারা রাতারাতি বড়লোক হয়ে যাবে । এই আইডিয়া তারা নেয় ক্রাইম পেট্রোল নামক অপরাধ বিষয়ক অনুষ্ঠান থেকে । শুধু তাই নয় অনেক দিন আগে থেকেই এ পরিকল্পনা ছিলো বলে তারা সাকিনের বাবার মোবাইল ফোন চুড়ি করে এবং রাকিনকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর ঐ মোবাইল দিয়ে কল করেই জানানো হয় মুক্তিপণের কথা !(সূত্রঃ আমাদের সময়, 18/12/2018 ইং)
রাকিন হত্যা, গত বছর পঞ্চম শ্রেণী পড়ুয়া একজন ছোট্ট মেয়ে শিশু হত্যা ও আরও অনেক অনেক কিশোর অপরাধের কথা বর্তমানে আমরা জানতে পারছি । শহরাঞ্চলে মাঝে মাঝেই খবর আসে কিশোর গ্যাং বাহিনীর কথা । অপহরণ বাড়ছে, দেখতে হচ্ছে নতুন নতুন কৌশলে মানুষের মৃত্যু! প্রতিনিয়ত এই অসহ্যতায় গমন কেন হচ্ছে, কেন নতুন নতুন কৌশলে মানুষের, শিশুদের মৃত্যু বাড়ছে তা হয়ত গবেষনাও হচ্ছে কিন্তু বড় দায় কিন্তু টিভি অনুষ্ঠান গুলিরই ।
আমরা যখন সন্তানদের শিক্ষা দেই তখন একভাবে সন্তান না বুঝলে অন্যভাবে বোঝাতে চেষ্টা করি । যতক্ষন না বোঝে ততক্ষন সময় নিয়েই তাদের বোঝাই । টিভি সিরিয়াল গুলোও একই কাজ করছে । অপরাধ সংগঠনের উপায়গুলো যখন সামনে আনছে তখন মেলায় গিয়ে বন্দুক কেনার শখের মত তারা অপরাধ করার স্পৃহাও মনে মনে নিয়ে নিচ্ছে !
অপরাধ প্রবনতা শিক্ষা পায় এমন অনুষ্ঠান বন্ধে পদক্ষেপ গ্রহন করা খুব দ্রুতই প্রয়োজন । মস্তিষ্ক যখন বার বারা অপরাধের দিকে ধাবিত করবে তখন একটা সময় অপরাধ আরও বেড়ে যাবে আর তার পূর্বাভাস এখন থেকেই দেখা যাচ্ছে । অনুষ্ঠান বন্ধের পাশাপাশি প্রতিটি পরিবারেই যাতে এই চ্যানেলগুলো বন্ধ রাখা হয় সে ব্যপারে অভিভাবকদের আরও সচেতন হতে হবে । গণমাধ্যমে এই সিরিয়াল গুলো সন্তানদের না দেখানোর ব্যপারে উৎসাহ মূলক নাটিকা, খন্ড নাটকও প্রকাশ করা যেতে পারে । পারভেজ, ফয়সালদের মত আমাদের আশেপাশেও কত মানুষ আছে যারা এই সব অনুষ্ঠান দেখার মাধ্যমে আমাদেরই শত্র হয়ে উঠছে তাই বা কে জানে ! তথ্য মন্ত্রনালয়ের এ ব্যপারে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে । অপরাধ বাড়ার পেছনে গণমাধ্যমের যদি দায় চলে আসে তখন অপরাধ কমানো বা বন্ধ করাই কঠিন হয়ে পড়বে । যত দ্রত সম্ভব অপরাধ বিষয়ক অনুষ্ঠান গুলোর ব্যপারে নীতিমালা তৈরী করা প্রয়োজন । অনুষ্ঠান অপরাধ বিষয়ক হতে পারে তবে সেখানে কিভাবে অপরাধ সংগঠিত হয়েছে তা না দেখানোর ব্যপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে । এতে করে শিশুরা এ ধরণের অনুষ্ঠানগুলো থেকে বের হয়ে আসবে এবং অপরাধ আর শিখতে পারবে না ।আশা করি তথ্য মন্ত্রনালয় এ বিষয়গুলো আরও বেশী মনোযোগ সহকারে দেখবেন ও দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহন করবেন ।
সাঈদ চৌধুরী
সদস্য, উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি
ও রসায়নবিদ
শ্রীপুর, গাজীপুর
ছবিঃ সংগৃহীত
Discussion about this post