অবসরের পর রায় লেখা সম্পর্কে চলমান বিতর্কের অনেকটাই যুক্তিখণ্ডালেন সাবেক প্রধান বিচারপতি মাহমুদুল আমিন চৌধুরী।
তিনি বললেন, ‘আমি মনে করি না যে, অবসরের পর রায় লেখা বেআইনি হবে। তবে অবসরের পর রায় লিখতে হলে কোনোভাবেই আদেশের অংশ পরিবর্তন করা যাবে না।’
মঙ্গলবার (০৯ ফেব্রুয়ারি) সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতি ভবন মিলনায়তনে আয়োজিত ‘বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও বিরাজমান পরিস্থিতি’ শীর্ষক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।
আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন গণতান্ত্রিক আইনজীবী সমিতির সুপ্রিম কোর্ট শাখার সভাপতি জগলুল হায়দার আফ্রিক।
বিচারপতি মাহমুদুল আমিন চৌধুরী বলেন, ‘বিচার বিভাগ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। খাদের কিনারে এসে দাঁড়িয়েছে। এই বিচার বিভাগ ধ্বংস হয়ে যাক আমরা চাই না। বিচার বিভাগ সম্পর্কে যখন ভালো কিছু শুনি তখন মনটা ভরে যায়।’
অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের রায় লেখা প্রসঙ্গে সাবেক এই প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমাদের সময় নিয়ম ছিল হাইকোর্ট বিভাগে বিচারকরা এজলাসে বসে রায় ঘোষণা করবেন, আইনজীবীরা বসে শুনবেন, কোনো কিছু বাদ গেলে তো বলবেন। আর আপিল বিভাগ শুধু আদেশ অংশ ঘোষণা করতেন। পূর্ণাঙ্গ রায় আসবে পরে। তাই আমি মনে করি না যে অবসরের পর রায় লেখা বেআইনি হবে। তবে অবসরের পর রায় লিখতে হলে কোনোভাবেই আদেশ অংশ পরিবর্তন করা যাবে না। আদেশ অংশ পরিবর্তন করতে হলে রিভিউ করতে হবে। এটা না করে ছয় মাস বা এক বছর বা দেড় বছর পর যদি কেউ রাতের অন্ধকারে রায়ের আদেশের অংশ পরিবর্তন করে তবে সেটি হবে ফৌজদারি অপরাধ। কিন্তু আমরা তো সেটা করলাম, সেটি ঠিক হয়নি। এ কারণেই প্রধান বিচারপতি বলছেন এটা বেআইনি।’ অবসরের পর রায় লেখা নিয়ে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘এখন তো শুনি হাইকোর্টে কেউ কেউ প্রকাশ্যে আদালতে রায় দেন না, সংক্ষিপ্ত আদেশ দেন, আগে এটা ছিল না, এখন মাসের পর মাসেও পূর্ণাঙ্গ রায় দেয়া হয় না, বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তি হয়, জজ সাহেব সম্বন্ধে নানা আলাপ-আলোচনা হয়। তিনি রায় লিখতে পারেন না বলেই প্রকাশ্যে রায় বা আদেশ দেন না। এখন নাকি রুল দেয়া নিয়ে সিনিয়র জুনিয়র বিতর্ক হয়, সিনিয়র এজলাস থেকে নেমে যান, এটি দুঃখজনক-লজ্জাজনক। এ জন্য দায়ী আইনজীবীরা। কারণ আইনজীবীদের দায়িত্ব কাউকে খালাস করে দেয়া বা কাউকে শাস্তি দেয়া নয়। তাদের দায়িত্ব ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য আদালতকে সহায়তা করা।’
তিনি আরো বলেন, ‘এখন তো শুনি একেকজনের কাছে এক দেড়শো মামলা রয়েছে রায় লেখার অপেক্ষায়। এটা দুঃখজনক। একেকজনের কাছে এই বিপুল পরিমাণ রায় লেখার অপেক্ষায় থাকার কারণে বিচার বিভাগ ও সুপ্রিমকোর্টের সর্বনাশ হয়েছে। এ রায় লেখা পড়ে থাকার জন্যও দোষ আইনজীবীদের। আইনজীবীদের ঐক্যবদ্ধভাবে এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। বিচার বিভাগকে বাঁচাতে হবে। কিন্তু আইনজীবীরা তা করছেন না।’
আইনজীবীদের উদ্দেশ্যে তিনি আরো বলেন, ‘আপনারা রাজনীতি করবেন কিন্তু তা আদালতের বাইরে। আদালত অঙ্গনে আপনাদের পরিচয় আপনারা আইনজীবী। ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় আপনারা কাজ করবেন। জুডিশিয়ারি বাঁচাতে হলে আপনাদের ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন করতে হবে।’
বিচার বিভাগের সংস্কারে প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার গৃহীত পদক্ষেপকে সমর্থন দিতে আইনজীবীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে মাহমুদুল আমিন চৌধুরী বলেন, ‘প্রধান বিচারপতি সঠিক রাস্তায় নিয়ে যেতে চেষ্টা করছেন। আপনাদের উচিত তাকে সহযোগিতা করা। বিচার বিভাগ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। আপনারা বিচার বিভাগকে বাঁচান। দেশ রক্ষা করুন। দেশের স্বাধীনতা রক্ষা করুন।’
দেশের মন্ত্রিসভায় অনুমোদনকৃত নাগরিকত্ব আইন বিষয়ে তিনি বলেন, ‘শুনেছি এটি সংসদে পাসের অপেক্ষায় রয়েছে। এ বিষয়ে পত্রিকায় যে সংবাদ দেখেছি, তা খুবই বিপদজনক। যে কোনো নাগরিকের নাগরিকত্ব কেড়ে নিতে পারবে সরকার।’
তিনি বলেন, ‘রাজাকারদের নাগরিকত্ব বিষয়ে ওই আইনে আছে একজন রাজাকার যদি থাকে তার সম্পদ তার ছেলে-মেয়েরা পাবে না। রাজাকারা তো চলে গেছে ৪০-৪২ বছর আগে। বাবার শাস্তি ছেলে ভোগ করবে? ফৌজদারি আইনে একজনের শাস্তি আরেকজন ভোগ করতে পারে না। গণতান্ত্রিক সরকারে এসব থাকার কথা নয়, জনগণের জন্য আইন হওয়ার কথা। এ বিষয়ে দেখা উচিত আমরা কোথায় যাচ্ছি?’
বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও আইনের শাসনের প্রশ্ন যখন আসবে তখন আইনজীবীদেরকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। ঐক্যবদ্ধ থাকলে সবকিছুই অর্জন করা সম্ভব হবে। এই সুপ্রিমকোর্টে আপনারা (আইনজীবী) আছেন, থাকবেন। আপনারাই ন্যায় বিচার ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতার মশাল তুলে ধরবেন। আর এর জন্য শর্ত একটাই আইনজীবীদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।’
বিচারপতি নজরুল বলেন, ‘১৫ বছর যখন হাইকোর্টের বিচারক ছিলাম তখন কেউ কখনো অন্যায় অনুরোধ নিয়ে আমার সামনে আসেননি। কারণ জানেন অনুরোধ করলে উল্টো ফল হবে।’
হাইকোর্টের বিচারক নিয়োগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘নিমগাছে কখনো ফজলি আম ধরে না। ফজলি আম পেতে হলে ফজলি গাছ রোপণ করতে হয়। বিচারক নিয়োগে নীতিমালা না থাকায় এ নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হচ্ছে। নিয়োগ ঠিক মতো হলে এরকম হতো না।’
ড. শাহদীন মালিক বলেন, ‘বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সুদৃঢ় না, আর বিরাজমান পরিস্থিতি বিব্রতকর। আইনজীবী ও বিচারকদের ব্যর্থতার কারণে জনগণ বিচারের জন্য বিচার বিভাগের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। এদেশে বিচার প্রার্থীদের কথা কেউ বলে না। তাদের দিকে কেউ তাকায় না। একটা দেশে ন্যায় বিচার না থাকলে সমাজ থাকে না।’
৭২-এর সংবিধানের ষষ্ঠ অনুচ্ছেদ হুবহু পুনর্বহালের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এটি করা না হলে বিচারক নিয়োগের আইন থেকে শুরু করে আমাদের কোনো কিছুই অর্জিত হবে না।’
আলোচনা সভায় প্রধান আলোচক ছিলেন সংবিধান প্রণেতা ড. কামাল হোসেন, সুব্রত চৌধুরী প্রমুখ।
Discussion about this post