অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর
পেশাগতভাবে কেবলমাত্র আইনজীবীদেরকেই ’বিজ্ঞ’ হিসেবে সম্বোধন করা হয়। তাই আইনজীবীদের কাজে-কর্মে-আচরণে বিজ্ঞতার ছাপ থাকা আবশ্যক। আত্মসম্মান রক্ষা করার জন্য নবীন কিংবা প্রবীণ সকল আইনজীবীদের করণীয় ও অনুসরণীয় আচরণবিধি সম্পর্কে স্মরণ রাখা উচিৎ। সাম্প্রতিককালে পেশাগত অসদাচরণের কারণে বার কাউন্সিল সনদ বাতিল হয়েছে কতিপয় আইনজীবীর এভাবে চলতে থাকলে একদিন সাধারণ মানুষ আইনজীবীদের তথা আইন-আদালতকে অবিশ্বাস করতে শুরু করবে। একজন আইনজীবীর শপথ ও আচরণবিধি সম্পর্কে জানতে হবে এবং সব সময় স্মরণ রাখা বাঞ্ছনীয়। ‘দি বাংলাদেশ লিগেল প্র্যাকটিশনারস এন্ড বার কাউন্সিল অর্ডার এন্ড রুলস, ১৯৭২ এবং ক্যাননস অব প্রফেশনাল কনডাক্ট এন্ড এটিকেট’ (The Bangladesh Legal Practitioners and Bar Council Order,1972, The Bangladesh Legal Practitioners and Bar Council Rules,1972, Canons of Professional Conduct and Etiquette) বইটি পড়ে সেখানে উল্লেখিত আচরণবিধি সবাইকে মান্য করতে হবে। আইন শুধু পড়ার জন্য, জানার জন্য না। আইন সম্মানের সাথে মান্যও করতে হবে। উক্ত ১৯৭২সালের রুলস এর ৬২(২) অনুচ্ছেদে ইংরেজীতে এডভোকেটের শপথনামা আছে যা বাংলা অনুবাদ করলে হবে, ”আমি………. সশ্রদ্ধচিত্তে শপথ করিতেছি যে, আইনজীবীরূপে আমি আমার পেশার সুউচ্চ মান ও মর্যাদা সমুন্নত রাখিব; একই সঙ্গে আত্মমর্যাদাবোধ ও এই পেশার প্রতি যথাযথ নিষ্ঠাবান থাকিব এবং পেশাদারী আচরণ ও নৈতিক মানদন্ড অনুসরণ করিয়া চলিব। সংবিধানের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধানকে আমার পবিত্র কর্তব্য মনে করিব এবং বাংলাদেশের জনগণের অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তিস্বরূপ ইহার শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখিতে সচেষ্ট হইব। সংবিধানের পরিপন্থী কোন কর্মকান্ডের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করিব না। মানবাধিকার রক্ষায় আমি হইব একজন সদাপ্রহরী এবং এমন একটি সমাজ বিনির্মাণের লক্ষ্যে নিজেকে নিয়োজিত রাখিব যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক,অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার সুনিশ্চিত হইবে।”
অ্যাডভোকেট আচরণবিধি হিসেবে অধ্যায়- ১ এ আইনজীবীদের প্রতি আচরণ ১-১১ দফা, অধ্যায়-২ মক্কেলের প্রতি আচরণ ১-১৪ দফা, অধ্যায়-৩ আদালতের প্রতি কর্তব্য ১-৯ দফা ও অধ্যায়-৪ এ জনগণের প্রতি আচরণ ১-৮ দফা বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে ইদানিং উক্ত আচরণবিধি সম্পর্কে কতিপয় আইনজীবী শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন না। যদিও উল্লেখিত আচরণবিধি প্রত্যেক অ্যাডভোকেটই মেনে চলতে বাধ্য এবং অমান্য করলে পেশাগত অসদাচরণ (Professional Misconduct) বলে গণ্য হবে যার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলে অভিযোগ দায়ের করলে ট্রাইব্যুনাল গঠন পূর্বক এ সব পেশাগত অসদাচরণের অভিযোগের বিচার করা হয় ও দোষী সাব্যস্থ আইনজীবীকে নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য বা চিরকালের জন্য আইন পেশা থেকে বহিস্কারের মত কঠোর শাস্তিও দেওয়া হয়। সংশ্লিষ্টদের সদয় অবগতির জন্য আইনজীবীদের প্রতি আচরণ সংক্রান্ত প্রথম অধ্যায়ের ১-১১ দফা নিম্নরূপ
১. সবসময় নিজের পেশার সম্মান ( Dignity) ও সুউচ্চ মান ( High standing ) রজায় রাখা প্রত্যেক এডভোকেটের কর্তব্য এবং এই পেশার একজন সদস্য হিসেবে নিজের মর্যাদাবোধ ও ব্যক্তিগত মানদন্ড বজায় রাখাও কর্তব্য।
২. কোন এডভোকেট বিজ্ঞাপন বা অন্য কোন উপায়ে কাজ পাওয়ার চেষ্টা করবেন না (shall not)। এই বিধানের অর্থ এই নয় যে, এডভোকেট তার ভিজিটিং কার্ড,নেইমপ্লেট বা কোন ডিরেক্টরীতে তার নাম ও পেশাদারী পরিচয় ছাপতে পারবেন না। তবে শর্ত হলো, এসব ক্ষেত্রে শুধু পেশাদারী,শিক্ষাগত যোগ্যতা ও কোন সরকারী পদে আসীন থাকলে সেই তথ্য ছাপা যাবে, যা কোন বিজ্ঞাপনের স্টাইলে প্রদর্শিত নয়।
৩. একজন এডভোকেট কাজ যোগাড় করে আনার জন্য কাউকে নিয়োগ দিবেন না, কাজ যোগাড় করে আনার বিনিময়েও কাউকে বেতনাদি দিবেন না। তিনি লাইসেন্সবিহীন কোন ব্যক্তিকে আইনজীবী হিসেবে কাজ করতে কোন সাহায্য বা সহযোগিতা করবেন না এবং তার কাছ থেকে বিনিময়ে কিছু গ্রহন করবেন না; লাইসেন্স বিহীন ব্যক্তির বা লাইসেন্সবিহীন ব্যক্তি জড়িত এমন কোনো পেশাদারী কাজ তিনি গ্রহন করবেন না।
৪.কোনো এডভোকেট কোনো পক্ষের সামনে সংশ্লিষ্ট পক্ষের এডভোকেটের অনুপস্থিতিতে বা তার অনুমতি না নিয়ে কোনো বির্তকিত বিষয়ের আলোচনা বা অবহিত করবেন না।
৫. প্রকাশ্য আদালত ছাড়া ও প্রতিপক্ষের আইনজীবীর অনুপস্থিতিতে কোনো আইনজীবী কোনো মামলার বিষয়বস্তু সম্বন্ধে আলোচনা,যুক্তিতর্ক বা এর গুনাগুন( মেরিট) নিয়ে কোন বক্তব্য রাখবেন না। বিচারাধীন মামলার মেরিট বিষয়ে লিখিত বক্তব্য পাঠের বেলায় প্রতিপক্ষকে ওই বক্তব্যের কপি না দিয়ে কোনো আইনজীবী বিচারকের সামনে তার বক্তব্য পেশ করবেন না। অবশ্য, এই বিধান একতরফা মামলা বা বিচারাধীন নয় এমন বিষয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।
৬. মক্কেল যদি একের অধিক আইনজীবী নিয়োগ করতে চান তবে তা বর্তমান আইনজীবীর ওপর আস্থাহীনতা প্রমাণ করে না। অবশ্য এ বিষয়টি সম্পূর্ণরূপে মক্কেলের ইচ্ছার ওপর ছেড়ে দেওয়া উচিত। প্রথমে চুক্তিবদ্ধ এডভোকেটের ফি পরিশোধিত না হওয়া পর্যন্ত অন্য এডভোকেট এই মামলা প্রত্যাখান করবেন।
৭. এডভোকেট নন, মামলা করেন মক্কেলগণ। মামলার পক্ষভুক্ত বাদী-বিবাদীর মধ্যে যত খারাপ সম্পর্কই থাকুক না কেন তা যেন মামলা পরিচালনার সময় আইনজীবীগণের আচরণের ওপর কোনো প্রভাব বিস্তার না করে। আইনজীবীদের মধ্যে ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব বৈশিষ্টের ( idiosyncrasies) দিকে ইঙ্গিত করে বক্তব্য রাখা শিষ্টাচারের লংঘন। মামলা নিস্পত্তিতে বিলম্ব ঘটায় ও আদালতে অশালীন বিশৃঙ্খলা জন্ম দেয় এমন কথাবার্তা আইনজীবীদের সচেতনভাবে পরিহার করে চলতে হবে।
৮. প্রদত্ত আইনী সেবার বিনিময়ে অর্জিত ফি কারো সঙ্গে ভাগাভাগি করা অনুচিত। অবশ্য, চুক্তি মোতাবেক স্থিরীকৃত পদ্ধতিতে সহকর্মী আইনজীবীর সঙ্গে কাজের মাত্রা অনুযায়ী ফি বিভাজন করা যাবে।
৯. সাংবিধানিক রীতিনীতি অনুযায়ী আদালতের কর্মকান্ডে এটর্নী জেনারেল ও এডভোকেট জেনারেল অগ্রাধিকার পাবেন এবং বার কাউন্সিলে সংরক্ষিত রুল (Roll) অনুসারে আগে তালিকাভুক্ত সিনিয়ার এডভোকেটদের অগ্রাধিকার প্রাপ্তির সৌজন্য ও ঐতিহ্য রক্ষা করা আইনজীবীদের দায়িত্ব।
১০. শিক্ষানবীশ ও নবীন এডভোকেটদের উচিত সর্বদা প্রবীণ ও জ্যেষ্ঠ এডভোকেটদের প্রতি যথাযথ সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা। জ্যেষ্ঠ এডভোকেটগণ নবীনদের প্রতি শুধু সজ্জনসুলভ হবেন তা-ই নয় বরং বারের এই নবীন ভ্রাতৃবর্গের প্রতি তারা তাদের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবেন।
১১. যদি কোন পক্ষের মামলার জন্য একের অধিক এডভোকেট নিযুক্ত করা হয় সেক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠ এডভোকেটের অধিকার হলো মামলা পরিচালনা করা এবং কনিষ্ঠ এডভোকেটের কর্তব্য হলো জ্যেষ্ঠ এডভোকেটকে সহযোগিতা করা।
আইনজীবী, আইন প্রয়োগকারী সংস্থায় কর্মরত ও বিচার কাজে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারী ও রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা যত বেশী আইন অমান্য করার মানসিকতা দেখাবেন তত বেশী দেশের সর্বস্থরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হবে। দেশকে বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতার হাত থেকে বাঁচাতে হলে যার যার অবস্থান থেকে সবাইকে প্রচলিত আইন মান্য করার ব্যাপারে আন্তরিক,সর্তক ও যত্নবান হওয়া জরুরী। আইন আদালতকে সম্মান করার ব্যাপারে আইনজীবীদের দায়িত্ব সব চেয়ে বেশী। কারণ আইনজীবীরা সমাজের স্বাভাবিক নেতা।
লেখক: সাবেক সভাপতি কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতি; সাবেক পাবলিক প্রসিকিউটার, কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালত।
Discussion about this post