সাইদ আহসান খালিদ
আইনের শিক্ষকদের সাথে আইনজীবীদের পেশাগত ক্ষেত্রে বেজায় একটি মানসিক দূরত্ব আছে। একজনের পেশার সীমানায় অন্যজন প্রায় অনাহূত, অবাঞ্ছিত। একজন প্র্যাকটিসিং আইনজীবী কে কোর্স টিচার হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্বাগত জানানোর সংস্কৃতি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় সমূহে বিশেষত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় অনুপস্থিত। হয়তো গেস্ট টিচার হিসেবে দুয়েকটা ক্লাস বা সেমিনারে এসে আইনজীবীরা বক্তৃতা দিয়ে থাকেন কিন্তু পূর্ণ কোন কোর্স কোন আইনজীবীকে কোর্স টিচার হিসেবে এসাইন করার প্র্যাকটিস ইউনিভার্সিটিগুলোতে নাই। আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষকরা ‘আইনজীবী’ হিসেবে কোর্টে ‘ল’ প্র্যাকটিস করছেন- এমনটাও দুর্লভ, বাংলাদেশের উচ্চ আদালতে আইনের প্রফেসর কে ‘এমিকাস কিউরি’ বা আদালতের বন্ধু হিসেবে গণ্য করার চল নগণ্য- প্রায় নেই বললেই চলে।
আইন পড়ে হয় ‘আইনজীবী’, নয়তো ‘আইনের শিক্ষক’ – এই দুই পরিচয়ের যে কোন একটিই ধারণ করতে হয় বাংলাদেশে। দ্বৈত সত্ত্বা ধারণ করা অস্বীকৃত, অচল, প্রতিবন্ধকতাসংকুল- এক পরিচয় ধারণ করলে অন্যটি ছেড়ে দিতে হবে। এ যেন সেই পুরাতন ল্যাটিন ম্যাক্সিমের বাস্তব রূপ- ‘inclusio unius est exclusio alterius’ মানে ‘Inclusion of one thing excludes another’. অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যমান আইন কিংবা বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের আইনে কোন আইনজীবী বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন পড়াতে পারবেনা কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের শিক্ষক আদালতে আইনচর্চা করতে পারবেনা- এরূপ কোন নিষেধাজ্ঞার কথা আমার জানা নাই। কোন বাধা বা প্রতিবন্ধকতা যদি থেকেও থাকে- সেটির অপসারণ এখন সময়ের দাবি।
আইনজীবীরা হরহামেশা এই অভিযোগ করে থাকেন যে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনবিভাগ থেকে আইনের গ্র্যাজুয়েটরা যে বিদ্যা অর্জন করে কোর্টে হাজির হয় তাঁর সাথে বাস্তব আইন চর্চার বেশিরভাগ মিল নেই- ‘Law in books’ ও ‘Law in Action’ অর্থাৎ ‘কেতাবি আইন’ ও ‘কেজো আইন’- এই দুইয়ের বিস্তর তফাৎ, আসমান-জমিন ফারাক। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক যার আদালতে আইনজীবী হিসেবে ল’ প্র্যাকটিসের কোন অভিজ্ঞতাই নাই, অথবা থাকলেও বহু বছর আগের প্রায় বিস্মৃত অভিজ্ঞতা সম্পন্ন- তাঁর পক্ষে একজন আইনের শিক্ষার্থী কে আসলেই কি বর্তমান আদালতে আইন প্র্যাকটিসের উপযুক্ত বাস্তব জ্ঞান ও ট্রেনিং প্রদান করে ভবিষ্যৎ আইনজীবী হিসেবে তৈরি করা সম্ভব? দেওয়ানি কার্যবিধি, ফৌজদারি কার্যবিধি, দন্ডবিধি, সাক্ষ্য আইন, মুট কোর্টের মতো পদ্ধতিগত আইনসমূহ যেগুলো আইনের বাস্তব প্র্যাকটিসের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত সেসব কোর্স কেতাবি জ্ঞানলব্ধ আইনের প্রফেসরদের পড়ানো কতোটুকু সমীচীন, প্রাসঙ্গিক, কার্যকর ও যুগোপযুগী? আদালতের সাথে একেবারেই সংযুক্তিহীন, আইনের চর্চা সম্পর্কে প্রায়োগিক অভিজ্ঞতাহীন, শুধু তত্ত্ব জানা একজন আইনের শিক্ষক কর্তৃক এসব প্রসিডিউরাল কোর্স পড়ানোর অর্থ হচ্ছে অনেকটা এরকম যে- একজন কুমারী মেয়ে যার এখনো বিয়েই হয়নি সে যেন এক সন্তান-সম্ভবা মা কে পরামর্শ দিচ্ছে কিভাবে সন্তান প্রতিপালন করতে হবে !
আইনের শিক্ষকেরা আইনের নানা তত্ত্ব এমনকি আইনের প্র্যাকটিক্যাল ফিল্ডের নানান বিষয় নিয়েও ভালো ভালো এবং গভীর গবেষণা করেন- সেসব গবেষণা নিবন্ধ দেশীয় ও আন্তর্জাতিক নানা স্বীকৃত বিখ্যাত জার্নালে প্রকাশিত হয়। কিন্তু প্রচুর ফুট নোট সমৃদ্ধ এই ভারি ভারি প্রবন্ধগুলো কি আমাদের আদালতের সম্মানিত বিচারক ও আইনজীবীদের আইন পেশায় ও আইন চর্চায় কোন কাজে আসে আদৌ? উনারা কি এসব প্রবন্ধ পড়েন? বাংলাদেশের আদালতের কোন রায়ে কি সম্মানিত প্রফেসরদের এই আইনের প্রবন্ধগুলোর Citation হয়? সত্যিটা হচ্ছে- এই গবেষণা প্রবন্ধগুলো আইনজীবী ও বিচারকের কোন কাজেই লাগেনা- উনারা এসব পড়েও দেখেন না- এই প্রবন্ধগুলো আরেক শিক্ষকের নতুন প্রবন্ধ লেখার রেফারেন্স হিসেবেই কাজে আসে শুধু।
তাই বলে কি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ বিলুপ্ত হবে? কেতাবি জ্ঞান ও গবেষণার কি প্রয়োজন নেই? অবশ্যই আছে। কারন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ থেকে আইনের ডিগ্রিধারীদের সবাই আইনজীবী পেশায় যাবে না- কেউ বিচারক হবে, কেউ শিক্ষক হবে, কেউ আইনের গবেষক হবে, কেউ বা অন্য পেশায় যাবে। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ শুধুই শিক্ষার্থীকে একজন ‘আইনজীবী’ হিসেবে তৈরি করার ‘ট্রেনিং সেন্টার’ মাত্র নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের মনে আইনের ধারণার ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করে দেন। আইন কি?, এটি কিভাবে কাজ করে?, আইন কে কিভাবে বুঝতে হয়?, আইন কিভাবে পড়তে হয়? আইনের গবেষণা কিভাবে করতে হয়? কিভাবে আইনের যুক্তিবোধ (Legal Reasoning) গড়ে তুলতে হয়? — এসব কিছুই আমরা আইনের শিক্ষকদের কাছে শিখি। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের প্রফেসররা আমাদের কে শেখায়- ‘How to think like a lawyer’. এই শিক্ষা দেওয়ার জন্য আইনের শিক্ষকরাই যথার্থ মানুষ। এই শিক্ষা ছাড়া আইনের চর্চা ত্রুটিপূর্ণ, অসম্পূর্ণ এবং বিপদজনক !
আবার আইনের অধ্যাপকরা আইনজীবীদের তত্ত্বীয় জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা নিয়ে খুব সোচ্চার। তাঁদের যুক্তি হচ্ছে- তত্ত্বের জ্ঞান ছাড়া প্রয়োগ ভিত্তিহীন। একজন আইনের অধ্যাপক যে সময়, নিষ্ঠা, প্রচেষ্টা আর একাগ্রতা নিয়ে আইনের কোন একটি তত্ত্বীয় বিষয় বা সমস্যা নিয়ে গভীর গবেষণা করেন- সেটির নানান ডাইমেনশান চিহ্নিত করে আনেন- সেটি অনেকক্ষেত্রেই আইনজীবীর পক্ষে করা সম্ভব নয়। জুরিসপ্রুডেন্স, লিগ্যাল হিস্ট্রি, টর্ট আইন, সাংবিধানিক আইন, পারিবারিক আইন, মানবাধিকার আইনের মতো যেসব তত্ত্বীয় বা Substantive Law আছে সেসব ক্ষেত্রে আইনের অধ্যাপকদের জ্ঞানের কোন বিকল্প নাই। এই সংশ্লিষ্ট আদালতের কার্যক্রমে তাই আইনের অধ্যাপকদের গবেষণা ও মতামতের স্বীকৃতি থাকার দাবি উঠেছে। দুঃখজনক সত্য হচ্ছে- আইন বিভাগ সমূহে আইনের শিক্ষকরা খুব কম ক্ষেত্রেই DLR, MLR, BLC ইত্যাদি আইনের বাস্তব প্রয়োগ সংক্রান্ত কেস রিপোর্টগুলো অনুসরণ করে পাঠদান করে থাকেন। অর্থাৎ, বিচারকের রায় আর আইনজীবীদের সাবমিশান আইনের শিক্ষার্থীদের কাজে লাগছেনা। দূরত্ব টা রয়েই যাচ্ছে।
অথচ মেডিকেল সায়েন্সে আমরা উল্টোটাই দেখি। সেখানে প্রফেসররা মেডিকেল সায়েন্স পড়াচ্ছেন আবার নিজেরা ডাক্তার হিসেবে প্র্যাকটিস ও করছেন! শিক্ষার্থীরাও ক্লাসের থিওরি পড়ার সাথে সাথে হাসপাতালের ওয়ার্ডে সংযুক্ত থেকে ব্যবহারিক জ্ঞান লাভ করছে। আইন ও তো একটি খাঁটি ব্যবহারিক বিদ্যা। তাহলে?
আইনের অধ্যাপক ও আইনজীবীদের দ্বৈরথ নয় বরং এখন সময় এসেছে পারষ্পরিক সহযোগিতার। পদ্ধতিগত আইনসমূহ আইনজীবীদের বা বিচারকদের পড়ানো দরকার, একইসাথে আইনের শিক্ষকদের মধ্যে যারা আদালতে কোন নির্দিষ্ট ফিল্ডে ল’ প্র্যাকটিস করতে চায় তাঁদের কে উৎসাহিত করা উচিত যাতে তাঁর ক্লাসের শিক্ষার্থীরা তত্ত্বের সাথে প্র্যাকটিকাল জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাও লাভ করতে পারে। এভাবে আইনের তত্ত্বজ্ঞান সমৃদ্ধ একজন আইনের শিক্ষক অসাধারণ আইনজীবী হিসেবে আত্মপ্রকাশ ও বিকশিত হতে পারেন। আবার একজন আইনজীবীও বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার মাধ্যমে আইনের তত্ত্বের গভীরতায় প্রবেশও গবেষণায় সমৃদ্ধ হতে পারেন। বিশ্বের অন্যান্য বহুদেশের আইন বিভাগে ল প্র্যাকটিসিং আইনজীবীদের কে কোর্স টিচার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় আবার অনেক প্রফেসর থাকেন যারা কোর্টে ল প্র্যাকটিস অব্যাহত রাখেন।
আমার বন্ধু ব্যারিস্টার Monzur Tonoy এই কথার বাস্তব উদাহরণ। কিছুদিন বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন পড়িয়েছে সে। বাংলাদেশের শীর্ষ যে কোন পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে আইনের সুশিক্ষক হওয়ার সব যোগ্যতা তাঁর রয়েছে কিন্তু সে আইনজীবী পেশা কে বেছে নিয়েছে। সেখানে এগিয়ে যাচ্ছে রকেট গতিতে। একাডেমিশিয়ান হওয়ার তাড়না কিন্তু ত্যাগ করেনি সে। দেশের বাইরে পিএইচডি’র প্রস্তুতি নিচ্ছে এখন। কিন্তু যখনই আমি কোন একাডেমিক ক্লাসে এই বন্ধুর আইন পড়ানো দেখি- মুগ্ধ হয়ে শুনতে থাকি। তনয় এর মতো মেধাবী আইনজীবীরা অধ্যাপনায় যুক্ত হলে আইনের শিক্ষার্থীদেরই মঙ্গল। আবার আমার অনেক শিক্ষক বন্ধুকে কাছ থেকে চিনি যাদের যুক্তিবোধ, পান্ডিত্য, জ্ঞানের গভীরতা, উপস্থাপনা, স্মার্টনেস আর বাগ্মীতা বিস্ময় জাগায়, ভাবি- এই মুখগুলোকে আদালতে সংযুক্ত করা গেলে আমাদের আদালতের চিত্র কি ভিন্ন ব্যঞ্জনা পেতোনা? আইন চর্চায় গুণগত পরিবর্তন আসতো, আইনজীবীদের নিয়ে প্রচলিত নেতিবাচক ধারণাগুলো ভেঙে পড়তো নির্দ্বিধায়।
আইনের ‘কেতাবি’ জ্ঞান ও ‘কেজো’ জ্ঞান উভয়টিই একজন আইনের শিক্ষার্থী ও আইন পেশাজীবীর জন্য অপরিহার্য। পুরনো ম্যাক্সিম কে আসুন পাল্টে দিয়ে বলি- ‘inclusio unius est NON exclusio alterius’
লেখক: শিক্ষক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
Discussion about this post