নামের আগে বিচারপতি, অ্যাটর্নি জেনারেল, অধ্যাপক (আইন), ব্যারিস্টার, অ্যাডভোকেট পদবিগুলো দেখতে কার না ভালো লাগে? এ পদবিগুলো যতটা আকর্ষণীয় এগুলো অর্জন করা ততটা সাধনার ব্যাপার। কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে বহু প্রতিযোগিতা করে আইন পেশায় ভালো করতে হয়। যারা এ পেশায় আসতে চান তারা এসব জেনে বুঝেই আসেন। যারা ধৈর্য-একাগ্রতা নিয়ে আইন বিষয়ে পড়েন এবং পরবর্তীতে প্র্যাকটিসে সততা ন্যায়নিষ্ঠা বজায় রাখেন তাদের জন্য এ পেশায় রয়েছে উজ্জ্বল ক্যারিয়ার গড়ার হাতছানি।
প্রাচীন যুগ থেকে বলা হয় ‘সেই শহরে বসবাস করা নিশ্চয় বুদ্ধিমানের কাজ নয়, যে শহরে কিনা একজনও আইনজীবী নেই।’ আইন পেশা হচ্ছে পৃথিবীর সব অভিজাত পেশার অন্যতম। আর এ অভিজাত পেশার মানুষগুলোর নামের আগে ‘বিজ্ঞ’ শব্দটি ব্যবহার করতে হয়। অর্থাৎ ‘বিজ্ঞ আইনজীবী’ বলার মাধ্যমে এ পেশার আভিজাত্যকে ফুটিয়ে তোলা হয় নিপুণ সৌন্দর্যে।
আইনে ডিগ্রি ও খরচ: বর্তমানে তরুণ প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের পছন্দক্রমের শীর্ষে উঠে এসেছে আইন বিষয়ে পড়ালেখা। মেধাবীরাই আইনে পড়তে আসছে। এক্ষেত্রে একটি সুবিধা হচ্ছে- যে কোনো ব্যাকগ্রাউন্ডের শিক্ষার্থী বা পেশাজীবীর আইন পড়ার সুযোগ আছে। সে বিজ্ঞানের ছাত্র হোক, মানবিক, বাণিজ্য কিংবা মাদ্রাসা ব্যাকগ্রাউন্ডের হোক না কেন। আইন পেশায় আসতে হলে প্রথমে এইচএসসির পর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হয়ে চার বছর মেয়াদি এলএলবি অনার্স করতে হবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে নামমাত্র খরচ হবে। আর প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে তা গিয়ে দাঁড়াবে ৩ থেকে ৮ লাখ টাকায়।
সনদ পরীক্ষা: পড়াশোনা শেষে আইন পেশায় নিয়োজিত হওয়ার জন্য বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের অ্যাডভোকেট এনরোলমেন্ট সনদ পরীক্ষায় পাস করতে হয়। পরীক্ষার সিলেবাস পাওয়া যাবে বার কাউন্সিলের ওয়েবসাইটে। এ বিষয়ে তথ্য পাওয়া যাবে বার কাউন্সিলে। ঠিকানা: বার কাউন্সিল ভবন, ৩ শহীদ ক্যাপ্টেন মনসুর আলী সরণি, শাহবাগ, ঢাকা।
কাজের ক্ষেত্র: বলাই বাহুল্য, আইন পেশায় এখন যোগ হয়েছে নতুন নতুন মাত্রা ও সম্ভাবনা। বিসিএস ও অন্য যে কোনো নন ক্যাডারের চাকরি, ব্যাংক, স্বায়ত্তশাসিত ও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে চাকরির ক্ষেত্রে আইনের ছাত্রদের অন্য ব্যাকগ্রাউন্ডের শিক্ষার্থীদের মতো সমান সুযোগ আছে। তবে বিশেষ কিছু পেশা আছে যেখানে শুধু আইনের ছাত্ররাই কাজ করতে পারবেন, অন্যরা নয়। আইনজীবী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ ছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, আন্তর্জাতিক সংস্থা, বিভিন্ন বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা, বিভিন্ন দেশের দূতাবাস, বহুজাতিক কোম্পানি ও এনজিওতে আছে আইন কর্মকর্তা বা প্যানেল আইনজীবী হিসেবে কাজ করার সুযোগ। রয়েছে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নিম্ন আদালতে যোগ দেওয়ার সুযোগ। এছাড়াও সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে, আইন কলেজে আইন বিভাগের গ্রাজুয়েটদের শিক্ষকতার সুযোগ রয়েছে।
নিম্ন আদালতে প্র্যাকটিস: বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের অ্যাডভোকেট এনরোলমেন্ট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেই মিলবে সনদ এবং বারের সদস্য পদ। একজন আইনজীবী একই সঙ্গে দুটি বারের সদস্য হতে পারেন। সাধারণত একজন নবীন আইনজীবী সিনিয়র আইনজীবীর জুনিয়র হিসেবে কাজ শুরু করেন। পরে সিনিয়র হলে নিজে স্বাধীনভাবে নিম্ন আদালতে প্র্যাকটিস করতে পারেন। নিম্ন আদালতে অ্যাডভোকেটরা সাধারণত দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলা পরিচালনা করে থাকেন।
হাইকোর্ট বিভাগে প্র্যাকটিস: নিম্নআদালতে দুই বছর আইনজীবী হিসেবে কাজের অভিজ্ঞতা থাকলে হাইকোর্ট বিভাগে আইনজীবী হিসেবে অন্তর্ভুক্তির জন্য আবেদন করা যায়। হাইকোর্টে ১০ বছরের বেশি প্র্যাকটিস করছেন, এমন এক সিনিয়র আইনজীবীর সঙ্গে শিক্ষানবিশ চুক্তি করতে হয়। তবে বার-অ্যাট-ল’ বা এলএলএম পরীক্ষায় কমপক্ষে ৫০ শতাংশ নম্বর থাকলে এক বছর পরেই আবেদন করা যায়। এ প্রক্রিয়া অনেকটাই নিম্ন আদালতে অ্যাডভোকেট এনরোলমেন্ট পরীক্ষার মতো।
আপিল বিভাগে প্র্যাকটিস: একজন আইনজীবী হাইকোর্ট বিভাগে পাঁচ বছর প্র্যাকটিসের পর আপিল বিভাগে মামলা পরিচালনার জন্য আবেদন করতে পারেন। এক্ষেত্রে লাগবে ‘আপিল বিভাগে প্র্যাকটিসের যোগ্য’ এই মর্মে প্রধান বিচারপতি ও হাইকোর্টের বিচারপতিদের সংখ্যাগরিষ্ঠের দেওয়া প্রত্যয়ন। আর এটি পেলেই আপিল বিভাগে মামলা পরিচালনার যোগ্যতা অর্জন করেন একজন আইনজীবী।
দেওয়ানি মামলা: সম্পত্তির ওপর স্বত্ব ও দখলের অধিকার নিয়ে যে মামলা হয়, সেটাই দেওয়ানি মামলা। আদালতের ভাষায় এটিকে ‘মোকদ্দমা’ বলে। সব ধরনের দৃশ্যমান স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি এবং অদৃশ্য সব ধরনের অধিকারসংক্রান্ত মোকদ্দমা আইনজীবীরা জেলা জজ আদালতে পরিচালনা করেন। এ মামলা পরিচালনার জন্য ১৮৭৭ সালের সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইন, দেওয়ানি কার্যবিধি আইন, সাক্ষ্য আইনের বিভিন্ন ধারা সম্পর্কে ভালো দখল থাকতে হয়।
ফৌজদারি মামলা: চুরি, ডাকাতি, খুন, মারামারি, ধর্ষণ ইত্যাদি সংঘটিত অপরাধের বিচার ফৌজদারি মামলার আওতাধীন। এ মামলা আইনজীবীরা ফৌজদারি আদালতে পরিচালনা করে থাকেন। এ মামলা পরিচালনার জন্য ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধি, দণ্ডবিধি ও সাক্ষ্য আইনের বিভিন্ন ধারা সম্পর্কে ভালো জ্ঞান রাখতে হয়।
ইনকাম ট্যাক্স আইনজীবী: যারা আইন বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন, কিন্তু অ্যাডভোকেট না, তারাও চাইলে আয়কর আইনজীবী হিসেবে প্র্যাকটিসের জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও ট্যাক্স বারের সদস্য পদের জন্য আবেদন করতে পারবেন। বাণিজ্য বিভাগে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীরাও আয়কর আইনজীবী হওয়ার জন্য এনবিআরে আবেদন করতে পারেন। একই সঙ্গে তাদের ট্যাক্স বারের সদস্য হতে হয়। অ্যাডভোকেট এনরোলমেন্ট পরীক্ষায় উত্তীর্ণের পর ট্যাক্স বারের সদস্য হতে হবে। আবেদন করতে হবে নির্ধারিত ফরমে। আয়কর আইনজীবীরা আয়কর, সম্পদ, আমদানি শুল্ক, আবগারি শুল্ক ইত্যাদি বিষয়ে মামলা পরিচালনা করেন। তাদের আয়কর অধ্যাদেশ, ইনকাম ট্যাক্স রিটার্ন, সম্পদ বিবরণী ইত্যাদি বিষয়ে ভালো জ্ঞান রাখতে হয়।
করপোরেট ল’ প্র্যাকটিস অ্যান্ড লিটিগেশন: যিনি করপোরেশন আইনে বিশেষ জ্ঞান রাখেন, তিনি করপোরেট আইনজীবী। করপোরেট খাতে আইনজীবীদের কাজের ক্ষেত্র দিন দিন বাড়ছে। করপোরেট আইনজীবী হতে হলে কন্ট্রাক্ট ল, কোম্পানি রেজিস্ট্রেশন, ট্রেড লাইসেন্স, ট্যাক্স ল, অ্যাকাউন্টিং, সিকিউরিটি ল, দেউলিয়া আইন, মেধাস্বত্ব আইন সম্পর্কে ভালো জ্ঞান থাকতে হবে। আইন বিষয়ে পড়েও বা অ্যাডভোকেট হয়েও কোর্টে প্র্যাকটিস করতে না চাইলে বিভিন্ন ল’ ফার্মে কাজের সুযোগ পেতে পারেন। ল’ ফার্মগুলোয় বিভিন্ন কোম্পানির ডকুমেন্টেশন প্রস্তুত, লিগ্যাল অ্যাডভাইস দেওয়া, ফাইল তৈরি, মামলার ড্রাফট তৈরির কাজ করতে পারেন।
আরও কাজের ক্ষেত্র: বাংলাদেশে তেমন প্রচলন না থাকলে সাইবার ক্রাইম, ইমিগ্রেশন, স্পোর্টস ও মিডিয়া আইনজীবী হলে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও পেতে পারেন কাজের সুযোগ। তথ্যপ্রযুক্তির প্রসারের ফলে সাইবার বিষয়ে নানা ধরনের আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে। আর মিডিয়া, মিডিয়াকর্মী বা সেলিব্রিটিদের বিভিন্ন আইনি জটিলতার ক্ষেত্রে অভিজ্ঞদের কদর বাংলাদেশেও তৈরি হচ্ছে।
আয়: আইনজীবীদের আয়ের বিষয়টি নির্ভর করে অভিজ্ঞতা, ব্যক্তিগত দক্ষতা, সামাজিক যোগাযোগ, মামলার ধরন ও মক্কেলের ওপর। ৫০ হাজার থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করতে পারেন সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ ও আপিল বিভাগের একজন আইনজীবী। বার-অ্যাট-ল’ ডিগ্রি থাকলে মক্কেলদের কাছে বাড়ে গ্রহণযোগ্যতা। একজন নতুন আইনজীবী সাধারণত ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা আয় করতে পারেন। জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বা সহকারী জজ পদে নিয়োগ পেলে সম্মান, নানা সুযোগ-সুবিধাসহ মিলবে আকর্ষণীয় বেতন।
মানসিক প্রস্তুতিই হচ্ছে আইন পেশার প্রধান হাতিয়ার। আইন পেশার শুরুটা একটু চ্যালেঞ্জের, একটু দুর্গম। তাই শুরু থেকে কঠিন পরিশ্রম, প্রত্যয় এবং একাগ্রতা নিয়ে কাজ করার প্রস্তুতি নিতে হবে। তা ছাড়া এখানে রাজ্যের ধৈর্য নিয়ে আপনাকে বিচারপ্রার্থীর সমস্যার কথা মন দিয়ে শোনার মানসিকতা রাখতে হবে। এ পেশার শুরুটা হয় একজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীর সঙ্গে কাজ দিয়ে। প্রথমে আয়-রোজগারের দিকে না তাকিয়ে কাজের প্রতি মনোযোগী হওয়া বাঞ্ছনীয়। একাডেমিক ফলের চেয়ে আইন পেশায় পেশাজীবনের মেধা, আইন সম্পর্কে খুটিনাটি জানাশোনা, পরিচিত, পরিশ্রম ও ধৈর্যই এনে দেবে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। এই পেশার চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনাকে উপলব্ধি করেই এগিয়ে যেতে হবে আগামীর সাফল্য পেতে।
Discussion about this post