আজ ২৩শে ফেব্রেুয়ারি, দ্রোহী কথাসাহিত্যিক আব্দুর রউফ চৌধুরীর ২১তম প্রয়াণ-দিবস । ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দের এই দিনে, সকাল ১১টা ৪০ মিনিটে, তিনি তাঁর প্রিয় সংগঠন ‘হবিগঞ্জ সাহত্যি পরষিদ’-এর উদ্যোগে আয়োজিত হবিগঞ্জ মুক্ত স্কাউট ভবনে ‘মহান একুশ’ স্মরণ-সভায় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী বক্তৃতারত অবস্থায় হৃৎযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুকে জীবনরে শাশ্বত সত্য জেনে গ্রহণ করনে দ্রোহী কথাসাহিত্যিক আব্দুর রউফ চৌধুরী।
সামাজিক সংস্কার, অর্থনৈতিক দুরাবস্থা, প্রবাসী জীবনযাপন এবং বৈচিত্র্যময় কর্মজীবনের অভিজ্ঞতা তাঁকে লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশে তাড়িত করে। পাকিস্তানে অবস্থানকালে বাঙালির আর্থ-সামাজিক বৈষম্য এবং ধর্মের নামে পাপাচার তাঁকে ক্ষুব্ধ করে, ফলে ১৯৬১ সালে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর চাকুরি ছেড়ে ব্রিটিশ বিমানবাহিনীতে কর্মরত অবস্থায় পত্রপত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেন। ধর্ম ও দর্শনভিত্তিক একাধিক গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি ―‘নাম মোছা যায় না’ (১৯৬৩), ‘বাইবেলে সত্য নবী মুহাম্মদ (সা.)’ (১৯৬৮), ‘ধর্মের নির্যাস’ (১৯৬৫), ‘ইসলাম ও সমাজতন্ত্র’ (১৯৬৯), ‘পথ’ (১৯৬৩-১৯৯১)। ধর্ম ও বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা, যৌক্তিকতার বিচার-বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন করে দ্রোহী কথাসাহত্যিক আব্দুর রউফ চৌধুরী লিখেছেন ‘যে কথা বলা যায় না’ ও ‘প্রফেট মোহাম্মদ’। ‘প্রফোট মোহাম্মদ’ অবশ্য ‘নতুন দিগন্ত’ উপন্যাসের ‘নথিপত্র’, যদিও তা স্বতন্ত্র একটি গ্রন্থ হতে পারত।
দ্রোহী কথাসাহিত্যিক আব্দুর রউফ চৌধুরীর বিশ্বাস, সমাজতন্ত্রই পারে মেহনতী মানুষকে অর্থনৈতিক শোষণ এবং সামাজিক দাসত্ব-শৃঙ্খল থেকে মুক্তি দিতে। তাই তিনি রচনা করেন ‘বিপ্লব ও বিপ্লবীদের কথা’ বিশাল গ্রন্থটি, এর ‘কার্ল মার্কস ও ফ্রেডারিক এঙ্গেলস’ ও ‘ফরাসী বিপ্লব’ দুটো খণ্ড অঙ্কুর প্রকাশনী প্রকাশ করে।
দ্রোহী কথাসাহিত্যিক আব্দুর রউফ চৌধুরী ১৯৪৬-১৯৭১ সালে ঘটে-যাওয়া রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ছিলেন সচেতন। তিনি প্রত্যক্ষ করেন বাঙালি জীবনের প্রতিটি রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক পর্যায়, তার বিকাশ, প্রতিক্রিয়া এবং পরিণতি। ১৯৪৬-এর ভারতবর্ষ বিভাজনের আন্দোলন, ১৯৪৮-এর বাংলাভাষা আন্দোলন, ১৯৫২-এর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সূচিত বাঙালির সাংস্কৃতিক নবজাগরণের সূত্র ধরে ১৯৭১-এর বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ―এসব তাঁর কলমে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সমান্তরাল ভূমিকায় অবতীর্ণ করে রচনা করলেন প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস ও কবিতা।
‘স্বায়ত্তশাসন, স্বাধিকার ও স্বাধীনতা’ (কথাপ্রকাশ) গ্রন্থটি তিনটি পর্বে বিভক্ত―‘স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন’ (১৯৪৭-৫৪), ‘স্বাধিকার আন্দোলন’ (১৯৫৫-৭০) ও স্বাধীনতার আন্দোলন’ (১৯৭১)। ‘মহান একুশে’ (নাসাস) গ্রন্থে বহুভাষার জনসংখ্যা অধ্যুষিত দেশটির রাষ্ট্রভাষা কী হবে তার ওপর রাজনৈতিক নেতাদের নানা বক্তব্য বিবৃতি এবং সংস্কৃতি ক্ষেত্রের তাত্ত্বিকদের নানা তর্ক-তদন্ত বিধৃত বক্তব্য লেখক উপস্থাপন করেছেন। একাত্তরের বাংলাদেশে পাকিস্তানি দুঃশাসনের ভয়াবহতার পরিপ্রেক্ষিতে লেখকের মানস প্রতিক্রিয়ার সুস্পষ্ট প্রকাশ ঘটে ‘একটি জাতিকে হত্যা’ (নাসাস) গ্রন্থে। ১৯৯০-এর দশকে ‘ভোরের কাগজ’, ‘জনকণ্ঠ’, ‘যুগভেরী’ ও ‘খোয়াই’ পত্রিকায় যেসব রচনা প্রকাশিত হয়, তাই অঙ্কুর প্রকাশনী ‘১৯৭১’ দুই খণ্ডে বিভক্ত গ্রন্থ প্রকাশ করে| আর ‘স্বায়ত্তশাসন, স্বাধিকার ও স্বাধীনতা’, ‘মহান একুশে’, ‘একটি জাতিকে হত্যা’, ‘১৯৭১’ (দুই খণ্ড) গ্রন্থগুলোকে একখণ্ডে বেঁধে দেশ পাবলিকেশন্স প্রকাশ করতে যাচ্ছে ‘মুক্তিযুদ্ধ সমগ্র/ বাংলাদেশ ১৯৭১’ গ্রন্থটি।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কবিতার সঠিক তাঁর গ্রন্থ দুটো হচ্ছে―‘’৭১-এর কবিতা’ ও ‘কবিতাগুচ্ছ’। মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক তাঁর উপন্যাসটি হচ্ছে ‘নতুন দিগন্ত’ (১৯৬৮-১৯৯৫)। সুনিবদ্ধ কাহিনী, অগণন চরিত্র, উজ্জীবিত সংলাপ, স্বগত সংলাপ, স্মৃতি, ইতিহাস, বিশ্লেষণ, বর্ণনা―সবকিছু ছাপিয়ে যায় লেখকের জীবনবেদ।
দ্রোহী কথাসাহিত্যিক আব্দুর রউফ চৌধুরী বিলেতবাসকালে ডায়েরির মাধ্যমে তাঁর অভিজ্ঞতাগুলো লিপিবদ্ধ করে রাখতেন। এরকম একটি উপন্যাস হচ্ছে ‘পরদেশে পরবাসী’ (পাঠক সমাবেশ), এতে আছে কিছু উপাদান যা স্পষ্টত তাঁর ষাটের দশকের সামাজিক, রাজনৈতিক এবং দার্শনিক চিন্তাভাবনা। ‘সাম্পান ক্রুস’ (নাসাস) ও ‘অনিকেতন’ (প্রিয়মুখ প্রকাশনী)-ও বহুমাত্রিক শৈল্পিক গুণের সমৃদ্ধ।
নির্দ্বিধায় বলা চলে, তিনি সাহিত্যের মাধ্যমে সর্বাত্মকভাবে এক দ্রোহী মানসিকতাকে অবলম্বন করে তাঁর শিল্পকে সমৃদ্ধ করেছেন। তাঁর ‘গল্পসম্ভার’ (নাসাস)‘গল্পভুবন’ (নাসাস) ও ‘বিদেশী বৃষ্টি’ (নাসাস)-এর ছোটগল্পের বর্গীকরণ করলে যে সুষ্ঠু কাঠামো পাওয়া যায় তা হচ্ছে―(ক) দাম্পত্য জীবনের জটিলতা: নীলা, আত্মব্রত, বিকল্প, বন্ধুপত্নী। (খ) সামাজিক সমস্যা ও প্রতিবাদ: জিন, নেশা, ভূত ছাড়ানো, জিনা। (গ) মনস্তাত্ত্বিক: রানী, সৃষ্টিতত্ত্ব, পরিচয়, শাদি। (ঘ) মুক্তিযুদ্ধের চেতনা: অপেক্ষা, পিতা, বীরাঙ্গনা, বাহাদুর বাঙালি। (ঙ) বাৎসল্য রস: উপোসী, স্নান, যৌতুক, ট্যাকরা-ট্যুকরি। এছাড়াও রয়েছে ‘নজরুল: সৃজনের অনন্দমহল’ (দেশ পাবলিকেশন্স), ‘রবীন্দ্রনাথ: চির নূতনের দিল ডাক’, ‘যুগে যুগে বাংলাদেশ’ (নাসাস), ‘বাঙালির উৎস সন্ধানে’, ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’, ইত্যাদি। দ্রোহী কথাসাহত্যিকি আব্দুর রউফ চৌধুরী আগামী দিনেও বেঁচে থাকবনে তাঁর সৃজনর্কমের গৌরবে।
Discussion about this post