‘নো স্মোকিং, নট ইভেন অ্যান আবদুল্লাহ সিগারেট’—ষাটের দশকে বিশ্বের সবচেয়ে দামি সিগারেটের বিজ্ঞাপনের প্রচারিত বাণী এটি। উদ্দেশ্য অবশ্য যতটা না সিগারেটের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে জানানো, তার চেয়ে বেশি ‘আবদুল্লাহ’ ব্র্যান্ডের সিগারেট পরিচিত করানো। বাংলাদেশেও কোনো না কোনো কৌশলে চলছে সিগারেটের প্রচার।
বাংলাদেশে ২০০৫ সালে আইন করে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারের প্রচারে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। আইনটির কিছু দুর্বলতা দেখা দেওয়ায় সংশোধনী আনা হয় ২০১৩ সালে। এর বিধিও চূড়ান্ত হয়েছে গত মার্চ মাসে। কিন্তু তামাকজাত পণ্যের প্রচার-প্রসারে তেমন একটা প্রভাব ফেলতে পারেনি এই আইন। আইনের ফাঁক গলে সিগারেট কোম্পানিগুলো নানা কৌশলে পণ্যের প্রসার ঘটাচ্ছে।
কোনো না কোনো উপায়ে সিগারেটের এই প্রচার মানুষকে ধূমপানের প্রতি আকৃষ্ট করে। গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে বলছে, বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর প্রতি ১০ জনে ৪ জন দোকানপাটে সিগারেটের বিজ্ঞাপন দেখে এবং প্রতি ১০ জনে ৩ জন যেকোনো জায়গায় সিগারেটের বিজ্ঞাপন দেখে আকৃষ্ট হয়।
সিগারেটের প্রসার বন্ধ করতে আইনে সব ধরনের প্রচারকৌশল নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য (নিয়ন্ত্রণ) আইনে তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন ও প্রচারণা নিষিদ্ধ এবং পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ন্ত্রণ-সম্পর্কিত বিধানে বলা আছে, ‘তামাকজাত দ্রব্যের বিক্রয়স্থলে যেকোনো উপায়ে তামাকজাত দ্রব্যের প্রচার করিবেন না, বা করাইবেন না।’
তামাক উৎপাদন ও বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো আইন মেনে চলছে বলে দাবি করে। তবে বাস্তবে তাদের আইন ভাঙার উদাহরণ আছে। সে হিসেবে দোকানগুলোকে সিগারেট দিয়ে সাজিয়ে দেওয়ার চল ব্যাপকভাবে দেখা যাচ্ছে।
ওয়ার্ক ফর বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্ট (ডব্লিউবিবি ট্রাস্ট) কর্মসূচি সমন্বয়ক আমিনুল ইসলাম সুজন বলেন, ‘বিক্রয়স্থলে প্রচার বেড়েছে। ধানমন্ডি ২৭ নম্বর থেকে সিটি কলেজ পর্যন্ত মোট ১৩২টি বিক্রয়স্থলে কোম্পানিগুলোর প্রচার দেখেছি আমরা। সরকার ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছে। কিন্তু কোম্পানিগুলো কোনো কিছুই মানছে না।’
কোথায় কীভাবে লঙ্ঘন: ২৮ মে নিউমার্কেট থানা থেকে কাঁটাবন পর্যন্ত মোট ১৩টি চা-সিগারেটের অস্থায়ী দোকানে গিয়ে দেখা যায় প্রতিটিতেই সুন্দর করে সিগারেট সাজিয়ে রাখা হয়েছে। এটি করেছে মূলত সিগারেট কোম্পানিগুলো। একই চিত্র দেখা যায় রাজধানীর রাসেল স্কয়ার থেকে পান্থপথ মোড় পর্যন্ত থাকা সব দোকানে। পান্থপথে আলেয়া বেগম নামে এক চা-সিগারেট বিক্রেতা বলেন, ‘সিগারেট কোম্পানির মালিক একদিন আইস্যা দোকান গুছায়া দিয়া গ্যাছে। এই যে বাক্সটা দেখতেছেন এইডা বাইরে থেকে দেইখা বুঝবেন না যে এইডা আসলে একটা ছোট আলমারি। বাইরের দিকে সিগারেটের প্যাকেট লাগানো, ভেতরের দিকে ড্রয়ার আছে অনেকগুলা। না দিলে কই রাখতাম মালসামান, কন?’।
আলেয়ার পাশেই চা-সিগারেটের দোকান আবদুল মালেকের। তাঁর দোকানে জাভা ব্ল্যাক সিগারেটের পোস্টার।
এ ছাড়াও সিগারেট কোম্পানিগুলো আরও নানা কৌশলে আইন ভাঙে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষক ইনতিসার আলম বলেন, ‘ক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগে নিত্যব্যবহার্য পণ্যগুলো বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকে। সিগারেট কোম্পানিগুলোর সে সুযোগ নেই। তাই তারা আইনের নানা ফাঁক খুঁজে বেড়ায়। ধরুন, বড় বড় সুপার মার্কেটে কেনাকাটা শেষে যখন টাকা দিতে যাবেন দেখবেন চকোলেট, চুইংগামের, বাদামের পাশাপাশি সিগারেটের মোড়ক বা লাইটারও আছে। আপনি সিগারেট বা লাইটার কিনে নেবেন। এভাবে প্রসার হবে।’ এ ছাড়া তারা বিক্রেতাদের নানাভাবে টাকা-পয়সা দিয়ে সিগারেট বিক্রিতে উদ্বুদ্ধ করে।
তামাকজাত পণ্যবিরোধী প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞা। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, খালি প্যাকেটপ্রতি বিক্রেতা ২০ টাকা করে পান। গত বছর চাকরি দেওয়ার নামে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সিগারেট কোম্পানি বিজ্ঞাপন প্রচার করেছে। বিএটিবি ‘ব্যাটল অব মাইন্ডস’ নামে প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিল। ফাইন কাট নামের একটি নতুন ব্র্যান্ডের সিগারেট বাজারজাত করার আগে বিএটিবি আয়োজন করে কনসার্টের। প্রতিষ্ঠানের লোগো ব্যবহারে আইনগত বাধা থাকায় তারা বেনসন অ্যান্ড হেজেসের মধ্যকার ‘অ্যান্ড’কে এমনভাবে লেখে, যাতে সবাই বুঝতে পারে এটি কোনো প্রতিষ্ঠানের পণ্য। প্রায়ই সিগারেট কোম্পানিগুলো শুভেচ্ছা উপহার হিসেবে লাইটার দিয়ে থাকে, বিপণনকর্মীরা সিগারেটের ব্রান্ডের নাম লেখা গেঞ্জি পরেও পণ্য বিক্রি করেন।
বাংলাদেশের বাজারে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানি সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্র্যান্ড। সিগারেট বাজারের ৫০ শতাংশ প্রতিষ্ঠানটির দখলে। গত এক বছরে প্রতিষ্ঠানটি ব্র্যান্ড মার্কেটিংয়ে ৭৪ কোটি টাকারও বেশি খরচ করেছে ২০১৪ সালে।
বিএটিবির জনসংযোগ কর্মকর্তা আনোয়ারুল আমিন বলেন, ঢাকা শহরে ১০ লাখের বেশি সিগারেট বিক্রেতা আছে। বিক্রেতারা নিজেরাই দোকানে সিগারেট সাজিয়ে রাখেন, যেন ক্রেতারা বুঝে-শুনে কিনতে পারেন। আইনের বিধি হওয়ার পর তাঁরা সব ধরনের প্রচারমূলক জিনিস বাজার থেকে উঠিয়ে নিয়েছেন বলে জানান তিনি।
জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের সাবেক সমন্বয়ক আমিনুল আহসান প্রথম আলোকে বলেছেন, নিয়মিত দেশজুড়ে অভিযান পরিচালনার চেষ্টা চলছে। আইন না মানায় অনেককে জরিমানা দিতে হয়েছে।”প্রথম আলো
Discussion about this post