সুপ্রিম কোর্টে চূড়ান্ত নিষ্পত্তির অপেক্ষায় মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডপ্রাপ্ত এক ডজনেরও বেশি আসামির আপিল আবেদন। দিন দিন বাড়ছে এ তালিকা। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল মৃত্যুদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দিলেও দীর্ঘদিন আপিল বিভাগে এসব মামলার শুনানির উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়নি। সর্বশেষ ২০১৬ সালের ৩০ আগস্ট আল-বদর কমান্ডার জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদণ্ডের রায় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে চূড়ান্ত নিষ্পত্তির পর তা কার্যকর করা হয়।
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল মীর কাসেমের পর একে একে আরও ২০টি মামলার রায় দেন। সেগুলো থেকে পর্যায়ক্রমে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আবেদন করা হয়। কিন্তু দীর্ঘ সাত মাসে আর কোনো আপিল শুনানির উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
ট্রাইব্যুনালের মামলার রায় ঘোষণার পর ক্রমানুযায়ী মীর কাসেমের পর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রাজাকার মোবারক হোসেনের আপিল শুনানি হওয়ার কথা। এরপর সৈয়দ মুহম্মদ কায়সার, জামায়াত নেতা এ টি এম আজহারুল ইসলাম, জামায়াতের সিনিয়র নায়েবে আমির আবদুস সুবহানের মামলা শুনানির তালিকায় উঠে আসবে।
২০১৪ সালের ২৪ নভেম্বর মোবারকের বিরুদ্ধে রায় দেন ট্রাইব্যুনাল। ১৮ ডিসেম্বর মামলাটি আপিল বিভাগে আসে। বর্তমানে আপিল বিভাগে চূড়ান্ত শুনানির অপেক্ষায় থাকা ২০ মানবতাবিরোধীর ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড এবং একজনের আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত। এর মধ্যে ১৯ জন দণ্ড কমাতে আপিল করেছেন এবং একজনের সাজা বাড়ানোর জন্য আবেদন করা হয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে। তবে রাষ্ট্রপক্ষ এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ না নেয়ায় মামলাগুলোর চূড়ান্ত শুনানি কবে হবে তা অজানাই থেকে যাচ্ছে।
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এ প্রসঙ্গে গণমাধ্যমকে বলেন, সুপ্রিম কোর্টের স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী মানবতাবিরোধী অপরাধের আপিল মামলা শুনানি হবে। এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে পারেন প্রধান বিচারপতি। এ নিয়ে আমার কোনো বক্তব্য নেই।
তদন্ত সংস্থার জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা সানাউল হক মিয়া গণমাধ্যমকে বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলাগুলো কোনো সাধারণ মামলা নয়। এসব আপিল শুনানিতে রাষ্ট্রীয় তাগিদ থাকা দরকার। স্বাধীনতাকামী ও ভিকটিম সবাই তাকিয়ে আছে এসব অপরাধীর মামলার বিচারের দিকে।
তিনি আরও বলেন, ৪৬ বছর আগের ওই ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি প্রয়োজন। আমাদের সঙ্গে জাতিরও প্রত্যাশা, দ্রুত মামলাগুলো নিষ্পত্তি হোক।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ মনে করেন, দীর্ঘ সময়ে আপিল বিভাগে শুনানি না হওয়ায় পুরো প্রচেষ্টা অর্থহীন হচ্ছে।
সাধারণত আপিল মামলা দ্রুত শুনানির দিন ধার্য করতে সুপ্রিম কোর্টের চেম্বার আদালতে আবেদন দাখিল করা হয়। ওই আদালত তারিখ নির্ধারণ করে শুনানির জন্য আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে পাঠিয়ে দেন। সে অনুযায়ী শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। জানা গেছে, রাষ্ট্রপক্ষ থেকে এসব মামলার আপিল শুনানির জন্য কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
অবশ্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (সংশোধনী) আইন অনুযায়ী, আপিল করার ৬০ দিনের মধ্যে তা নিষ্পত্তি করার কথা। তবে আইনজ্ঞদের মতে, এ বিধান আপিল বিভাগের জন্য বাধ্যতামূলক নয় বরং নির্দেশনামূলক। আপিল বিভাগ তাদের অন্তর্নিহিত ক্ষমতায় ন্যায়বিচারের স্বার্থে মামলা শুনানি করে করেন।
এ বিষয়ে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, আপিল বিভাগের স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী যুদ্ধাপরাধের মামলার শুনানি হবে। এ ব্যাপারে আমরা আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করব না।
তিনি বলেন, আপিল বিভাগে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলা শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। আপিল বিভাগ তাদের নিয়মিত শিডিউল অনুযায়ী মামলা শুনানি করবেন।
তবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ বলেন, ‘যদিও আদালত তার নিজস্ব গতিতে চলে। এরপরও বলব, নানা প্রতিকূলতার মধ্যে জাতির প্রত্যাশা অনুযায়ী ট্রাইব্যুনাল স্বল্প সময়ের মধ্যে বিচার প্রক্রিয়া শেষ করেন। কিন্তু দীর্ঘ সময়ে আপিল বিভাগে শুনানি না হওয়ায় পুরো প্রচেষ্টা অর্থহীন হচ্ছে।’
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়ক আবদুল হান্নান খান বলেন, ‘এ বিষয়ে আমাদের কিছুই করণীয় নেই, যা করার অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয় করবে।’
আপিল বিভাগে বর্তমানে পর্যায়ক্রমে শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত মোবারক হোসেন, সাবেক প্রতিমন্ত্রী জাতীয় পার্টি নেতা হবিগঞ্জের সৈয়দ মুহম্মদ কায়সার, জামায়াত নেতা এটিএম আজহারুল ইসলাম, জামায়াতের সিনিয়র নায়েবে আমির আবদুস সুবহান এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জের আফসার হোসেন চুটু ও মাহিদুর রহমান, পটুয়াখালীর ফোরকান মল্লিক, বাগেরহাটের সিরাজুল হক ও খান আকরাম হোসেন, নেত্রকোনার আতাউর রহমান ননী ও ওবায়দুল হক খান তাহের, কিশোরগঞ্জের অ্যাডভোকেট শামসুদ্দিন আহমেদ, হবিগঞ্জের মহিবুর রহমান বড় মিয়া, মুজিবুর রহমান আঙ্গুর মিয়া ও আবদুর রাজ্জাক, জামালপুরের দুই রাজাকার এবং যশোরের সাবেক এমপি সাবেক জামায়াত নেতা সাখাওয়াত হোসেন। তারা সবাই ট্রাইব্যুনালে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি।
অন্যদিকে ট্রাইব্যুনালের দেয়া আমৃত্যু দণ্ডপ্রাপ্ত পিরোজপুরের সাবেক এমপি পলাতক জব্বার ইঞ্জিনিয়ারের সাজা বৃদ্ধি (মৃত্যুদণ্ড) চেয়ে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ।
-জাগো নিউজ
Discussion about this post