‘আপনার মক্কেলকে সুরক্ষা দিতে না পারলে আদালতে আসবেন না। আপনারা যতোই ক্ষমতাধর হন না কেন, আইন কিন্তু সোজা চলবে। আকা-বাঁকা পথে চলবে না। আমরা অনেক সহ্য করেছি। সংবিধান রক্ষায় যেকোনো আদেশ দিতে আমরা হেজিটেট ফিল করবো না, আপনি যেই হোন’।
মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতের কর্মপরিষদ সদস্য মীর কাসেম আলীর আপিল মামলার চূড়ান্ত রায় প্রদানের প্রাক্কালে এ দুই মন্ত্রী বিচার বিভাগ ও প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে বিরুপ মন্তব্য করেন। এরপর গত ০৮ মার্চ দুই মন্ত্রীকে তলব করেন আপিল বিভাগ। আর ওই দিনই মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়।
দুই মন্ত্রীর হাজিরার দিনে গত ১৫ মার্চ মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আদালতে উপস্থিত হলেও বিদেশ থাকায় হাজির হতে পারেননি খাদ্যমন্ত্রী। পরে ২০ মার্চ ফের দুই মন্ত্রীকে হাজিরের নির্দেশ দেন আপিল বিভাগ।
এর আগের দিন ১৪ মার্চ অবশ্য তাদেরকে দেওয়া সর্বোচ্চ আদালতের শো’কজ নোটিশের জবাবে দুই মন্ত্রী নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়েছেন।
রোববার আপিল বিভাগে খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলামের পক্ষে ছিলেন আবদুল বাসেত মজুমদার এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার রফিক-উল হক।
শুনানিতে আদালত কামরুল ইসলামের জবাবের বিষয়ে জানতে চাইলে আবদুল বাসেত মজুমদার বলেন, ‘ভবিষ্যতে এ ধরনের কোনো মন্তব্য করবো না বলে অঙ্গীকার করছি। এবং নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করছি। প্রধান বিচারপতি এবং আপিল বিভাগের প্রতি আমার (খাদ্যমন্ত্রীর) সম্মান আছে। আবেদনকারী (খাদ্যমন্ত্রী) একজন মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তার গভীর আবেগ রয়েছে। আবেগপ্রবণ হয়ে তিনি এ ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন’।
আদালত অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলামের দেওয়া জবাব খারিজ করে ২৭ মার্চ পর্যন্ত শুনানি মুলতবি করেছেন। ওই দিন দুই মন্ত্রীকে ফের হাজির হতে নির্দেশ দিয়েছেন।
প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘কোর্টে শুনানির সময় আমাদের মুখ বন্ধ করে দিয়েছেন আপনারা রাজনীতিবিদরা। আমাদের শুনানি নিয়ে সংসদে ও টকশো’তে আপনারা নানা মন্তব্য করেন। দু’জন মন্ত্রী যে ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন, সে ব্যাপারে নেপালে (সার্ক প্রধান বিচারপতি কনফারেন্স) থাকাবস্থায় একজন মন্ত্রীর সঙ্গে টেলিফোনে কথা হয়েছে। আমি মন্ত্রীকে (একজন মন্ত্রী) বলেছি, ক্যাবিনেটে প্রধানমন্ত্রীকে বিষয়টি অবহিত করতে। আমি দেশে ফেরার আগেই দুই মন্ত্রীকে প্রেস কনফারেন্স করে ক্ষমা চাইতে বলেছি। শুনেছি, প্রধানমন্ত্রী দুই মন্ত্রীকে বকাঝকা দিয়েছেন। এ বকাঝকায় কিছু হবে না। প্রেস কনফারেন্স করে ক্ষমা না চাইলে পরিণতি সাংঘাতিক খারাপ হবে’।
‘বিমানবন্দর থেকে আমি বাসায় না গিয়ে সরাসরি কোর্টে আসি। পরের দিন গুরুত্বপূর্ণ রায় দেবো। মন্ত্রীকে বলেছিলাম, এর আগে কোনো চুল পরিমাণ বরখেলাপ হবে না, যদি নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করে প্রেস কনফারেন্স না করেন। ক্ষমা না চাইলে এর ফলাফল সাংঘাতিক খারাপ হবে। একজন মন্ত্রী সব বিচারপতিদের সঙ্গে কথা বলতে আসলেন। আমার বিচারপতিরা উনার সঙ্গে কথা বললেন না। এটা বুঝে রাখেন, এই কোর্ট সংবিধানের অঙ্গ। সরকারের অঙ্গ নয়। আমাদের পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ থাকে। যে সিনিয়র জজ যিনি দায়িত্বে থাকেন, তিনি প্রধান বিচারপতিই হোন আর যেই হোন, তার প্রতি আমাদের প্রত্যেকেরই সম্মান থাকে’ বলেও মন্তব্য করেন প্রধান বিচারপতি।
আইনজীবীকে উদ্দেশ্য করে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আপনার মন্ত্রী প্রধান বিচারপতিকেই শুধু ছোট করেননি, গোটা বিচার বিভাগকে পায়ের নিচে গুঁড়িয়ে দিয়েছেন। উনি জানেন না, উনি কী বলেছেন। প্রধান বিচারপতিকে এক হাজার কোটি টাকা ঘুষ দিলেও আরও মাননীয় চারজন বিচারপতি আছেন, তাদেরকে কেনা সম্ভব নয়। আপনাদের জানতে হবে, এখানে প্রধান বিচারপতি একা কোনো রায় দেন না। প্রধান বিচারপতি চাইলেও তার পক্ষে একা রায় দেওয়া সম্ভব না। রায় প্রদানের আগে প্রধান বিচারপতিও একা জানেন না যে, কী রায় হবে’।
এরপর কামরুল ইসলামের আইনজীবীকে উদ্দেশ্য করে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আপনার ব্যাখ্যা হয়নি। এটা আমরা রিজেক্ট করলাম। পড়ালেখা করে আসেন। আপনার প্যারা ৫ (দাখিল করা জবাবের) সাঙ্ঘাতিক ঔদ্ধত্যপূর্ণ’।
এ সময় আদালত রফিক-উল হককে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘এটাই যদি হয় স্ক্যান্ডালাইজ অব দ্য কোর্ট, বিচার প্রশাসনে হস্তক্ষেপ এগুলো ক্রিমিনাল কনটেম্পট (ফৌজদারি অবমাননা)। ডাকাতি মামলার আসামিকে যেমন সাজা দেওয়া হয় এ ধরনের কনটেম্পট করলেও একই রকমের সাজা দেওয়া হয়। এটা জনকণ্ঠের মামলায় বলে দিয়েছি’।
আদালত আরও বলেন, ‘আপনি স্বীকার করেছেন, অপরাধ করেছেন। এই চ্যাপ্টারটা আমরা এখানেই শেষ করতে চাই। আমরা আপনাদের কনটেম্পট নিয়ে আর বাড়াবাড়ি করতে চাই না। প্রতিটি টকশো’তে যাবেন আর বাড়াবাড়ি করবেন। এটা আর দেখতে চাই না। আমরা বিচার করতে চাই’।
‘এখন বলেন, আপনি শপথ নিয়েছেন, সংবিধান রক্ষার। আপনি যদি এই শপথ ভঙ্গ করেন, আপনার কী হবে?। আপনি স্বীকার করেছেন, অন্যায় করেছেন। এর পরিণতি কি হবে?’ আদালত এমন প্রশ্ন রাখেন রফিক-উল হকের উদ্দেশ্যে।
প্রধান বিচারপতি আরও বলেন, ‘এটা দেশের সর্বোচ্চ আদালত। কোর্ট অব রেকর্ডের বাইরে আমরা রায় দিতে পারি না। আমরা সংবিধানের চুল পরিমাণ ব্যত্যয় করতে পারি না। আপনি (মন্ত্রীরা) সংবিধানের অধীনে শপথ নিয়েছেন। আপনার অপরাধ স্বীকার করা আর জনকণ্ঠের সাংবাদিক বা কোনো একজনের স্বীকার করা- এর মধ্যে বেশ-কম আছে। আপনার অপরাধ আর একজন সাধারণ নাগরিকের অপরাধ এক না’।
‘দোষ স্বীকার করার পর কী হতে পারে? একজন অপরাধীকে যখন ডকে(কাঠগড়া) আনা হয়, বলা হয়-তুমি দোষী না নির্দোষ? দোষ স্বীকার করছি, ক্ষমা করেন। তখন কোর্ট কি করেন? কোর্ট কি তাকে খালাস দেবেন, না কী করবেন?’ রফিক-উল হককে এমন প্রশ্নও করেন আদালত।
জবাবে রফিক উল হল বলেন, ‘আমি (মন্ত্রী) তো অন্যায় করেছি, নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়েছি। এখন যেভাবেই হোক, আমি বলবো যে, সিম্পলি পানিশমেন্ট (লঘুদণ্ড) দিতে পারেন’।
এ সময় আবদুল বাসেত মজুমদার বলেন, ‘মার্সি যখন চাই, তখন দোষ স্বীকার করেই চাই। আমরা ক্ষমা চেয়েছি। পুরো বিষয়টি আদালতের হাতে’।
আদালত বলেন, ‘আমাদের প্রথা হচ্ছে ক্ষমা দুই লাইনে চাইতে হয়। হোয়াট ইজ দিস? আপনারা বিশাল ব্যাখ্যা দিয়েছেন’।
সর্বোচ্চ আদালত আরও বলেন, ‘আমরা জানি, বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধা কারা? আমরা জানি, মুক্তিযোদ্ধাদের ভূমিকা কী? মি. মজুমদার, প্রধান বিচারপতি ওই মামলা থেকে নিজেকে তুলে নিলে দেশে রায়ট (দাঙ্গা) লেগে যেতো। জানেন না কী কথা বলেছেন আপনারা? পুরো যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল হয়ে যেতো। যুদ্ধাপরাধের বিচারের অনেক সিদ্ধান্ত ছিল না। এখানে আমরা অনেক সিদ্ধান্ত দিয়েছি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে’।
এ সময় আবদুল বাসেত মজুমদার বলেন, ‘আমরা যথাযথভাবে আবেদন দেবো। সময় চাই’।
জবাবে আদালত বলেন, ‘আপনার মক্কেলকে সুরক্ষা দিতে না পারলে আদালতে আসবেন না। আপনারা যতোই ক্ষমতাধর হন না কেন আইন কিন্তু সোজা চলবে। আঁকা-বাকা পথে চলবে না। আমরা অনেক সহ্য করেছি। সংবিধান রক্ষায় যেকোনো আদেশ দিতে আমরা হেজিটেট ফিল করবো না, করবো না, আপনি যেই হোন’।
এরপর আদালত ২৭ মার্চ পর্যন্ত শুনানি মূলতবি করে ওই দিন দুই মন্ত্রীকে হাজির হতে নির্দেশ দেন।
Discussion about this post