অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক
সম্প্রতি জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের এক প্রতিবেদনে ‘ইন্টারনেটে প্রবেশাধিকার একটি মানবাধিকার কি না’- সে বিষয়টি খতিয়ে দেখার চেষ্টা করা হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে ইন্টারনেটের কিছু কিছু সাইটকে ব্লক করা কিংবা সেগুলোতে সীমাবদ্ধ প্রবেশাধিকারের ব্যাপারে সমর্থন জ্ঞাপন করা হলেও প্রতিবেদনের শেষদিকে উপসংহার টানতে গিয়ে বলা হয়েছে, ইন্টারনেট জগতে প্রবেশের ক্ষেত্রে পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলে তা ‘নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আইনের’ ১৯ নং অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন হিসেবে বিবেচিত হবে। উল্লেখ্য, ওই অনুচ্ছেদে মতপ্রকাশের অধিকারকে নাগরিকের ‘অলঙ্ঘনীয় অধিকার’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
কিন্তু জাতিসংঘ প্রতিবেদনের এই উপসংহারের সঙ্গে একমত নন অনেকেই। যেমন ‘ইন্টারনেটের জনক’ হিসেবে সুপরিচিত এবং গুগলের ভাইস প্রেসিডেন্ট ভিন্ট সার্ফ সম্প্রতি নিউইয়র্ক টাইমসের উপ-সম্পাদকীয়তে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন যে, ইন্টারনেটে প্রবেশাধিকার মানবাধিকারের আওতায় পড়বে না। তিনি যুক্তি দিয়ে বলেছেন, ‘কোনো অধিকারকে ‘মানবাধিকার’ হিসেবে ঘোষণা দেয়ার আগে ওই অধিকারের ফলাফল শনাক্ত করা প্রয়োজন। যেমন, কথা বলা কিংবা মত প্রকাশের অধিকার এবং তথ্য গ্রহণের অধিকার। এসব অধিকার কোনো নির্দিষ্ট প্রযুক্তি কিংবা কোনো নির্দিষ্ট সময়ের গণ্ডিতে আবদ্ধ নয়। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে ইন্টারনেটে প্রবেশাধিকারকে ‘মানবাধিকার’ হিসেবে দাবি করা হলেও স্বীকার করে নেয়া হয়েছে যে, কোনো একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য ইন্টারনেট একটি মাধ্যম মাত্র। এটি নিজেই কোনো লক্ষ্য নয়।’
মি. সার্ফ অবশ্য জোর দিয়ে বলেছেন যে, এটি একটি নাগরিক অধিকার এবং আইনের দ্বারা আমাদের ওপর এই অধিকার বর্তায়। তিনি বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের সরকার কখনোই ‘টেলিফোন-ব্যবহারের অধিকারকে ‘মানবাধিকার’ হিসেবে ঘোষণা করে নি। অথচ ‘সার্বজনীন সেবা’র ধারণা থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় এই যন্ত্রটির সঙ্গে আমরা ক্রমেই ঘনিষ্ঠ থেকে ঘনিষ্ঠতর হয়ে উঠেছি। টেলিফোন সেবা এখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। এর মধ্য দিয়ে আমাদের কাছে এটি পরিষ্কার যে, ইন্টারনেটে প্রবেশাধিকার টেলিফোনের অধিকারের মতোই একটি নাগরিক অধিকার মাত্র। কারণ, প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা একটি নীতি, যা প্রয়োজন ও সামর্থ্য অনুসারে সরকার নিশ্চিত করে থাকে।”
অন্যদিকে প্রযুক্তিগত দৃষ্টিকোণ থেকে জেডি রাকার তার নিজের ব্লগে লিখেছেন, ‘ইন্টারনেট ব্যবহারের ফলাফল এতটাই তাৎপর্যপূর্ণ যে, এটিকে অলঙ্ঘনীয় অধিকারের মর্যাদা প্রদান করা হলে সুযোগের পরিবৃদ্ধি এবং উন্নততর শিক্ষা নিশ্চিত হওয়ার পাশাপাশি অজ্ঞতা থেকে উদ্ভূত হিংসা-বিভেদের সমাপ্তি পর্যন্ত ঘটতে পারে।’ আবার ম্যাথু ইনগ্র্যাম নামের একজন লিখেছেন, ইন্টারনেটে প্রবেশাধিকারকে ‘মানবাধিকার’ হিসেবে সংজ্ঞায়ন করা না হলে সরকারগুলো খুব সহজেই এর ওপর অযৌক্তিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের সুযোগ পায় এমনকি কখনো কখনো পুরোপুরিভাবে এই অধিকারকে খর্ব করে। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কয়েকটি রাজনৈতিক বিপ্লবের (যেমন আরব বসন্ত) দিকে তাকালে ব্যাপারটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
যাই হোক, ইন্টারনেটে প্রবেশাধিকারের প্রশ্নটি নিছক দার্শনিক কোনো বিতর্ক নয়। পৃথিবীর নানাপ্রান্তে রাষ্ট্রযন্ত্রগুলো আজ বিভিন্ন ছুতায় ইন্টারনেট ব্যবহারে বিধিনিষেধ আরোপ করছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর বহু দেশের আইনেই ইন্টারনেট ব্যবহারের ওপর সরকারের তরফ থেকে নিষেধাজ্ঞা আরোপের সুযোগ রাখা হয়েছে। মজার ব্যাপার হলো, সম্প্রতি ব্রিটেনের আপিল আদালত জাতিসংঘের এই প্রতিবেদনের প্রতি তাদের পরোক্ষ সম্মতি জ্ঞাপন করেছে। ‘রেজিনা বনাম স্মিথ অ্যান্ড আদারস’ নামক মামলায় ‘যৌন অপরাধ আইন ২০০৩’ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আদালত বলেছেন, ইন্টারনেট এখন আমাদের প্রতিদিনের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এর ব্যবহারের ওপর পরিপূর্ণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ কখনোই সমীচীন নয়। লর্ড জাস্টিস হাগস বলেন, “ইন্টারনেট আবিষ্কারের আগে কোনো আসামি যদি তার নিজের কাছে শিশু পর্নোগ্রাফি রাখত, সে ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই তার কাছে থাকা যাবতীয় ছাপানো সরঞ্জামাদির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হতো না।” আধুনিক যুগে ইন্টারনেটের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।
ফুলবাড়ি বা তেলগ্যাস আন্দোলন নিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয় নাই সেরকম সচেতন মানুষ নাই, এখন থেকে এসব কাজ সন্ত্রাসী কার্য হিসাবে গণ্য হবে। সংবিধান যেই চেতনা, চিন্তা ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলেছিল তাকে এখানে জবাই করা হয়েছে। এদেশে বুদ্ধিজীবী বা চিন্তকদের উপর এত বড় আঘাত এর আগে কেউ করে নাই। আপনার টুইটার, ফেসবুকে সবসময় দৃষ্টি রাখবে পুলিশ, স্কাইপি টেপ করবে পুলিশ ইন্টারনেট চ্যাটবক্স দখলে থাকবে পুলিশের, আপনার ফোন রেকর্ড করা হবে এসবই অপরাধের সাক্ষ্য হিসাবে উপস্থাপিত হবে আদালতে। এদেশের দৈনিক পত্রিকাগুলা, মিডিয়াগুলা বহু আগেই কর্পোরেশনের খোপে চলে গেছে। যেখান সরকারের, বহুজাতিক কোম্পানির অবৈধ কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে লেখালেখি করা বা কথা বলা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাকী ছিল এই সামাজিক গণমাধ্যম বা যোগাযোগ মাধ্যম। সেখানেও মুক্তচিন্তার প্রকাশ প্রায় আইন করে বন্ধ করে দেয়া হল। এর চাইতে চেতনা বিরোধী, চিন্তার স্বাধীনতা বিরোধী সিদ্ধান্ত আর কি হতে পারে? এই আইনের মাধ্যমে মানুষের চিন্তা বা মস্তিষ্ককে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে যে কেউ একজন সত্য কথা ভাবার আগেই, তা প্রকাশ করা আগেই লেখক ভাববেন তিনি একজন সন্ত্রাসী হতে যাচ্ছেন, তার চিন্তাকে এমনভাবে নপুংসক করা হচ্ছে যাতে আগামীতে চিন্তাহীন, বিবেকহীন, মানবতাহীন একটা রোবট প্রজন্ম দুনিয়াকে আমরা উপহার দিতে পারে।
কখনো কখনো অবশ্য ইন্টারনেটের ওপর পূর্ণ নিষেধাজ্ঞাও আদালত কর্তৃক সিদ্ধ হতে পারে। ২০১১ সালের নভেম্বর মাসে জাস্টিস সিলবার এক আদেশে বলেন, জরুরি পরিস্থিতিতে সন্দেহভাজন সন্ত্রাসীদের ঠেকাতে ইন্টারনেটের ওপর পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা আইনসিদ্ধ। ব্রিটেনের বিভিন্ন মামলার নজির বিশ্লেষণ করে বোঝা যায়, ইন্টারনেট সম্পর্কে দেশটির বর্তমান যে অবস্থান, তাতে জাতিসংঘ প্রতিবেদনের মতামত অনেকখানি প্রতিফলিত হলেও এখন পর্যন্ত দেশটি ওই প্রতিবেদনকে পুরোপুরি অনুমোদন দেয়নি। মানবাধিকারসংক্রান্ত ইউরোপিয়ান সনদের ১০ নং অনুচ্ছেদে ‘মত প্রকাশের অধিকার’ যেমন একটি ‘শর্তাধীন অধিকার’, ইন্টারনেটে প্রবেশাধিকারও ঠিক তেমনি একটি অধিকার। এ ধরনের অধিকারের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র প্রয়োজন মনে করলে যৌক্তিক বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে। জাতিসংঘ প্রতিবেদনে অবশ্য স্বীকার করে নেয়া হয়েছে যে, যৌন অপরাধ এবং সন্ত্রাসী সন্দেহভাজনের মতো জরুরি কিছু ক্ষেত্রে ইন্টারনেটের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রয়োজন হতে পারে।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইন গ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক দৈনিক ‘সময়ের দিগন্ত’।
Discussion about this post