একে.এম নাজিম, হাটহাজারী চট্টগ্রাম প্রতিনিধিঃ চট্টগ্রাম হাটহাজারী আল-আমিন ফাউন্ডেশনের দুই দিন ব্যাপী বিশাল তাফসীরুল কুরআন মাহফিলের প্রথম দিনে বক্তারা বলেন, ইসলাম, দেশ ও মানবাধিকার নিয়ে খেলতামাশা বরদাশত করা হবে না। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় একদিকে নাস্তিক্যবাদি শক্তি ইসলাম ও মুসলমানদের উপর ধারাবাহিকভাবে আঘাত হানছে, অন্যদিকে জনগণের মৌলিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করে দেশে আইয়্যামে জাহিলিয়্যার শাসন চলানো হচ্ছে। সরকারের মন্ত্রী-এমপি থেকে শুরু করে ইসলাম বিদ্বেষী গুটি কয়েক নাস্তিক প্রকাশ্যে আল্লাহ, রাসূল ও ইসলাম বিদ্বেষী বক্তব্য দিয়ে মুসলমানদেরকে হেয়প্রতিপন্ন ও উস্কানী দিয়ে যাচ্ছে। ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশে এখন প্রকাশ্য রাজপথে ইসলাম বিদ্বেষী ব্যঙ্গচিত্র আঁকা ব্যানার নিয়ে মিছিল করার দুঃসাহস পর্যন্ত দেখিয়েছে কতিপয় নাস্তিক। তাফসীর মাহফিলে বক্তারা আরো বলেন, একদিকে রাজনৈতিক দলসমূহের ক্ষমতার দ্বন্ধে মানুষের জানমালের নিরাপত্তা বলে কিছুই অবশিষ্ট নেই, অন্যদিকে ধর্মনিরপেক্ষতার নামে দেশকে ইসলামহীনতার দিকে কৌশলে ঠেলে দেওয়ার অপচেষ্টা চলছে। এভাবে একটা দেশ সুশৃঙ্খলভাবে চলতে পারে না। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সবার আগে রাজনৈতিক সংকটের সমাধান হতে হবে। এ জন্য সংলাপের বিকল্প নেই। ১৬ কোটি মানুষের নিরাপত্তার জন্য এই সংলাপের উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকেই।
গতকাল (২০ মার্চ) শুক্রবার বৃহত্তর চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সমাজ সেবামূলক ইসলামী সংগঠন ‘আল-আমিন ফাউন্ডেশন’র উদ্যোগে হাটহাজারী পার্বতী হাই স্কুল ময়দানে দুই দিন ব্যাপি ঐতিহাসিক তাফসীরুল কুরআন মাহফিলের প্রথম দিন সম্পন্ন হয়। আল-আমিন ফাউন্ডেশনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য মাওলানা মুফতী মুহাম্মদ আলীর সভাপতিত্বে¡ অনুষ্ঠিত তাফসীরুল কুরআন মাহফিলে প্রধান অতিথি’র বক্তব্য রাখেন হেফাজতে ইসলামের আমীর দারুল উলূম হাটহাজারী মাদ্রাসার মহাপরিচালক পীরে কামেল শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফী। বক্তব্য রাখেন, হেফাজতে ইসলামের সিনিয়র নায়েবে আমীর আল্লামা শাহ মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী, হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা হাফেজ মুহাম্মদ জুনায়েদ বাবুনগরী, বি-বাড়ীয়া দারুল আরকামের পরিচালক আল্লামা সাজেদুর রহমান, দৈনিক ইনকিলাবের সহকারী সম্পাদক মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী, হাফেজ মাওলানা আহমদুল্লাহ, মুফতী মাহমুদুল হাসান, মাওলানা নোমান ফয়জী, মাওলানা শেখ আহমদ প্রমুখ।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে হেফাজত আমীর আল্লামা শাহ আহমদ শফী বলেন, ঈমানী চেতনাবোধ ও আদর্শহীনতার কারণেই জাতি গভীর সংকটের মুখে পড়েছে। একদিকে সরকারের মন্ত্রী-এমপি থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নাস্তিক্যবাদি ও ইসলাম বিদ্বেষীরা নগ্নভাবে আমাদের ঈমান-আক্বিদার উপর হামলা চালাচ্ছে। ক্বওমী মাদ্রাসা, উলামা-মাশায়েখ ও ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে জঙ্গীবাদের মিথ্যা অভিযোগ দেওয়া হচ্ছে, অন্যদিকে ইসলামবিদ্বেষীদেরকে দেওয়া হচ্ছে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা। পবিত্র কুরআন-হাদীস ও ইসলামী বইপুস্তককে কথিত জিহাদী বই বলে চরমভাবে ইসলাম অবমাননা করছে প্রশাসন থেকেই। বর্তমানে শুধু ইসলাম ও মুসলমানদেরকে নিয়ে নয়, জনগণের মৌলিক অধিকার ও জানমাল নিয়েও চলছে চরম অরাজকতা। ক্ষমতার দ্বন্দ্বে স্বার্থের দ্বন্দ্বে ইসলাম, মুসলমান এবং সাধারণ জনগণের কারোরই নিরাপত্তা নেই। সর্বত্র ন্যায়-নীতি ও মানুষের মৌলিক অধিকার হরণের যেন মহোৎসব চলছে। এভাবে চলতে থাকলে দেশ ও জাতি সহসাই গভীর সংকটের মুখে পড়ে যেতে পারে।
হেফাজত আমীর আরো বলেন, আমরা চাই বর্তমান সংঘাতময় পরিস্থিতির দ্রুত অবসান হয়ে দেশে স্থিতিশীলতা ফিরে আসুক। রাজনৈতিক দলগুলো দেশ ও জনগণের জন্য কাজ করলে এমন সংকট কখনোই তৈরী হতো না। রাজনৈতিক সংকটের সমাধান রাজনৈতিক ভাবেই আসতে হবে, ছাড় দেওয়ার মানসিকতা ছাড়া কখনোই সংকটের সুরাহা হবে না।
হেফাজত আমীর বলেন, পবিত্র ইসলাম ধর্ম হচ্ছে শান্তির ধর্ম। ইসলামে সন্ত্রাস, খুনা-খুনি ও জোর-জুলুমের যেমন স্থান নেই, তেমনি মানুষের মৌলিক অধিকার হরণেরও সুযোগ নেই। ইসলাম সব সময় ন্যায়, ইনসাফ প্রতিষ্ঠায় অন্যায়-অবিচার, জুলূম-অত্যাচার ও অনৈতিক কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে অত্যন্ত কঠোর। দেশের চলমান রাজনৈতিক সংকটের কারণে যে ভয়ংকর সংঘাতময় পরিস্থিতি চলছে, তাতে ইসলামের খাদেম ও দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে দেশের আলেম সমাজের চুপ থাকার সুযোগ নেই। বৃটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত দেশ ও জাতির যে কোন সংকটে আলেম সমাজ দায়িত্বশীল ভূমিকা রেখে আসছে। হেফাজত আমীর রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, আপনারা দেশ ও জনগণের স্বার্থে আল্লাহর ওয়াস্তে আলোচনায় বসে শান্তির পথ বের করুন। ক্ষমতার জন্য কাড়াকাড়ি করে দেশ ও জনগণের সর্বনাশ ডেকে আনবেন না। অন্যথায় ইতিহাস কখনোই আপনাদেরকে ক্ষমা করবে না।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের সিনিয়র নায়েবে আমীর আল্লামা শাহ মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী বলেন, ইসলাম, দেশ ও মানবাধিকার নিয়ে খেলতামাশা বরদাশত করা হবে না। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় একদিকে নাস্তিক্যবাদি শক্তি ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে একের পর এক আঘাত হানছে, অন্যদিকে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য সাধারণ মানুষের জানমাল নিয়ে হোলি উৎসব চলছে। দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করা হয়েছে মানুষের মৌলিক অধিকার ও নিরাপত্তা সুনিশ্চত করার জন্যই। সুতরাং দেশ, জনগণ ও ইসলাম নিয়ে কাউকে আইয়্যামে জাহিলিয়্যার রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে দেওয়া হবে না। তিনি বলেন, আমরা চাই রাজনৈতিক দলসমূহ অনতিবিলম্বে সংলাপে বসে দেশে দ্রুত স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনুক। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া অন্যান্য সংকটের সমাধান হবে না। অন্যথায় মানুষের জানমাল নিয়ে এমন ছিনিমিনি খেলা চলতে থাকলে উলামায়ে কেরাম কোটি কোটি তৌহিদী জনতাকে সাথে নিয়ে দেশের স্বার্থে, মানুষের স্বার্থে, ইসলামের স্বার্থে রাস্তায় নেমে আসতে দ্বিধা করবে না।
আল্লামা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী সরকারের মন্ত্রী-এমপিসহ বিভিন্ন পর্যায়ে ইসলাম বিদ্বেষী বক্তব্য ও রাসূল অবমাননা বেড়ে যাওয়ার উল্লেখ করে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ধর্মনিরপেক্ষতার বিষফল জাতি অনুভব করতে শুরু করেছে। তিনি অবিলম্বে সকল ইসলাম বিরোধী অপতৎপরতা বন্ধের দাবী জানিয়ে বলেন, হেফাজতে ইসলাম ঈমান-আক্বিদা বিরোধী যে কোন অপতৎপরতার বিরুদ্ধে শক্ত ভূমিকা রাখতে পিছপা হবে না।
তাফসীর মাহফিলে হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব আল্লামা হাফেজ জুনায়েদ বাবুনগরী দেশে নাস্তিকতা ও ইসলাম বিদ্বেষকে পরিকল্পিতভাবে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে বলে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ এনে বলেন, সংবিধান থেকে আল্লাহর উপর আস্থা-বিশ্বাসের নীতি বাদ দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়ার শুরু থেকেই দেশের আলেম সমাজ ও তৌহিদী জনতা এমন আশংকা থেকেই এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিল। অথচ সরকার কোটি কোটি তৌহিদী জনতার মতামতের প্রতি কোনরূপ তোয়াক্কা না করেই সংবিধান সংশোধন করে ধর্মনিরপেক্ষ নীতি চালু করে। যার কুফল হিসেবে শুধু নাস্তিক্যবাদিদের মুখে নয়, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কর্তাব্যক্তিরাও প্রকাশ্যে ইসলাম বিদ্বেষী ও অবমাননাকর বক্তব্য একের পর এক দিতে শুরু করেছে। নাটক-সিনেমা, হাটবাজার, স্কুল-কলেজ ও রাস্তা-ঘাটে সাংস্কৃতিক চর্চার নামে ইসলাম বিরোধী কর্মকান্ড এখন প্রকাশ্যে চলতে দেখা যায়।
আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী তাফসীর মাহফিলের এক পর্যায়ে চলমান রাজনৈতিক সংকট, খুন-খারাবি, অর্থনৈতিক স্থবিরতা এবং মানুষের জান-মালের নিরাপত্তাহীনতায় গভীর উদ্বেগ ও হতাশা প্রকাশ করে এ ব্যাপারে বিবাদমান রাজনৈতিক দলসমূহকে অবিলম্বে সংলাপের মাধ্যমে সংকট উত্তরণের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলসমূহের ক্ষমতার লড়াইয়ের কারণে সমাজে অপরাধপ্রবণতা ও খুন-খারাবি মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। তাই সংলাপের মাধ্যমে দ্রুত বর্তমান রাজনৈতিক সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী আরো বলেন, শান্তির জন্য দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমা লের চরমপন্থী সর্বহারা পার্টি, পার্বত্য চট্টগ্রামের সন্ত্রাসী সংগঠন শান্তিবাহিনী এবং পিলখানার বিডিআর বিদ্রোহীদের সাথে যদি সংলাপ হতে পারে, তাহলে ১৬ কোটি মানুষের শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য কেন রাজনৈতিক দলসমূহের মাঝে সংলাপ হতে পারে না। আর সংলাপ তো হবে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যই। সুতরাং কোনরূপ পূর্ব শর্তারোপ দায়িত্বশীলতা নয়।
তিনি বলেন, দেশের আলেম সমাজ কোনভাবেই দমন-পীড়ন, জ্বালাও-পোড়াও ও দলীয় স্বার্থের রাজনীতি চায় না, শান্তি চায়। সরকারী দল ও বিরোধী দলের বর্তমান দ্বন্দ্ব-সংঘাতে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি দেশের আলেম সমাজও গভীরভাবে উদ্বিগ্ন ও অতিষ্ঠ। আলেম সমাজ সংকটের দ্রুত অবসান হয়ে দেশে স্থিতিশীলতা ফিরে আসুক এমনটাই প্রত্যাশা করে।
আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী জঙ্গীবাদের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, কিছু দিন ধরে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই ভিত্তিহীন অভিযোগ এনে বিভিন্ন মাদ্রাসায় উদ্দেশ্যমূলকভাবে আতংক তৈরী করে অভিযান পরিচালনা করছে বলে শোনা যাচ্ছে। এটা খুবই উদ্বেগজনক। তিনি বলেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে অস্ত্রধারী ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে জড়িত যে কারো বিরুদ্ধে নিরপেক্ষ আইনি পদক্ষেপ ও অভিযানে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু উদ্দেশ্যমূলকভাবে মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে দেশকে ইরাক-আফগানিস্তানের মতো পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেওয়ার ষড়যন্ত্র হতে দেওয়া যায় না। তিনি নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে অপরাধ দমনে কাজ করার জন্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানান।
Discussion about this post