ইমরান হোসেন
১৯৭১ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বয়স ৪৪ বছর। এই দীর্ঘ সময়ে নানান বিষয়ে বিভিন্ন আইন পাশ হয়েছে, কিন্তু রাষ্ট্রের প্রধান ৩ টি অঙ্গের একটি বিচারবিভাগের উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে বাংলাদেশ এখনো কোন বিশেষ, সুশৃঙ্খলিত আইন দেখেনি। সম্প্রতি আইন কমিশন সুপ্রিমকোর্টে বিচারক নিয়োগে ৬ টি সুপারিশ করেছে,যা বাস্তবায়ন করা গেলে আমাদের বিচারব্যবস্থা আরেক ধাপ এগিয়ে যাবে।
সুপারিশকৃত বিষয়গুলো হলো-
১) উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে একজন ব্যক্তিকে কমপক্ষে দশ বছর অধ:স্তন আদালতে চাকুরীর অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। এই দশ বছর পুরোটাই বিচার কাজে নিয়োজিত থাকতে হবে। বিচার বিভাগীয় প্রশাসন ও অন্যান্য সরকারি অফিসে চাকুরির সময় এই দশ বছর গণনায় আসবে না। এই দশ বছরের মধ্যে ন্যূনতম তিন বছর জেলা জজ বা সমপর্যায়ের বিচারক হিসেবে অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।
২) কমপক্ষে দশ বছর সুপ্রিমকোর্টে প্র্যাকটিস করতে হবে। শুধু enrolment যথেষ্ট নয়। এই দশ বছর ন্যূনতম সংখক মামলা সফলভাবে পরিচালনার রেকর্ড থাকতে হবে। এর মধ্যে দুই বছর আপিল বিভাগে মামলা পরিচালনা করতে হবে।
৩) বিচারক এবং আইনজীবী ছাড়া আইনজ্ঞ ব্যক্তি, যার একাডেমিক পরিচয় আছে,বিচারক হিসেবে নিয়োগের জন্য বিবেচিত হতে পারবেন। তাঁর সর্বনিম্ন বয়সসীমা হবে ৪৫ বছর।
৪) অধস্তন আদালত হতে বিচারক নিয়োগের আনুপাতিক সংখ্যা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
৫) হাইকোর্ট বিভাগে বিচারকদের অস্থায়ী নিয়োগদান এবং হাইকোর্টের বিচারক আপিল বিভাগে অস্থায়ী আসন গ্রহণেরর বিধান বিচার বিভাগের স্বাধীনতার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয় বিধায় তা বিলুপ্ত করা প্রয়োজন।
৬) রাষ্ট্রপতি কতৃক প্রধান বিচারপতির কাছে পরামর্শ চাওয়া হতে হবে সাংবিধানিক এ বিচার বিভাগীয় ধ্যান-ধারণায় বিশেষ অর্থবহ,নিছক আভিধানিক অর্থে নয়। এজন্য প্রধান বিচারপতির পরামর্শ প্রক্রিয়া হতে হবে স্বচ্ছ এবং লিখিতভাবে যাতে তার উপর সামাজিক পর্যবেক্ষণ সম্ভব হয়।
সংবিধানে বিচারক হিসেবে অভিজ্ঞতার যে দশ বছরের কথা বলা হয়েছে,সে দশ বছরে বর্তমানে জেলা জজ হওয়া সম্ভব নয়। তাছাড়া জেলা জজ হিসেবে ও দীর্ঘ সময়ের অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। শুধু জেলা জজ হিসেবে প্রমোশন হলেই তাঁকে বিচারক নিয়োগ দেয়া হয় না। কাজেই আইনের সাথে বাস্তবতার মিল নেই। একজন ব্যক্তি এডভোকেট হিসেবে দশ বছর সুপ্রিমকোর্টে প্র্যাকটিস করলে যেদিন দশ বছর পূর্ণ হবে রাষ্টপতি চাইলে পরদিনই তাকে বিচারক নিয়োগ করতে পারেন। কিন্ত বাংলাদেশে একটি এমন দৃষ্টান্ত ও নেই যে, একজন বিচারিক কর্মকরতার দশ বছর পূর্ণ হওয়ার পরেই উচ্চ আদালতে নিয়োগ পেয়েছেন। সুতরাং এই দশ বছরকে বাড়ানো যেতে পারে অথবা জেলা জজ থেকে নিয়োগ প্রথা শিথিল করতে হবে। আইনজীবিদের দশ বছরকে বিচারকদের বয়সের সাথে সমন্বয় সাধন করা যেতে পারে অথবা ব্রিটেনের মত ১৫ বছর করা যেতে পারে। প্রতিবেশী দেশ ভারতে অবশ্য দশ বছরই প্র্যাকটিসের সর্বনিম্ন সময়। আমাদের বর্তমান প্রধান বিচারপতি সহ অনেক বিচারপতিই প্রায় বিশ বছর প্র্যাকটিস করার পর বিচারক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এমনকি আমাদের প্রতিবেশী দেশে ও প্রাদেশিক হাইকোর্ট আছে। ফলে সেসব দেশে বিচারক ও বেশী এবং মামলা জট কম। অন্যদিকে আমাদের হাইকোর্ট একটিই এবং বিচারক ও কম। ফলে মামলা জট খুব বেশী। এমতাবস্থায় উচ্চ আদালতে বিচারক বাড়াতে হবে। নিম্ন আদালতে ও একই সমস্যা বিরাজমান। সম্প্রতি অবশ্য আইন কমিশন ২৪০০ অতিরিক্ত বিচারক নিয়োগ দেওয়ার সুপারিশ করেছে।
ভারত,ব্রিটেন,সুইডেন প্রভৃতি দেশে আইনে অভিজ্ঞ ব্যক্তি যেমন আইনের অধ্যাপকদের ও উচ্চ আদালতে বিচারক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। তাই আমাদের দেশে ও এটি বিবেচনা করা যেতে পারে।
বাংলাদেশে হাইকোর্ট বিভাগে বিচারক নিয়োগ দেয়া হয় অস্থায়ী ভিত্তিতে দুই বছরের জন্য। দুই বছর শেষ হওয়ার পর রাষ্টপতি তাকে স্থায়ী না করলে তাকে পদ ছেড়ে দিতে হবে। কাজেই রাষ্ট্রপতির কনফার্মেশন পাওয়ার চিন্তাটি বিচার বিভাগের স্বাধীনতার হরণই বটে। আমেরিকায় রাষ্টপতি বিচারপতি নিয়োগ দেন। এরপর তার নিয়োগ সিনেট কতৃক পাশ হতে হয়। Senate Judiciary Committee তাকে নানা প্রশ্ন করেন। এতসব চড়াই-উৎরাইয়ে উত্তীর্ণ হলে তাকে বিচারক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। সাধারণত প্রেসিডেন্ট নিজের আদর্শের ব্যক্তিকে বিচারক হিসেবে নিয়োগ দেন। কিন্তু প্রধান বিচারপতি Earl Warren কে নিয়োগ দিয়ে প্রেসিডেন্ট Dwight D. Eisenhower দু:খ করে বলেছিলেন, “the biggest damn fool mistake I ever made”। সুইডেনে বিচার বিভাগীয় কমিটি প্রার্থীর মেধার উপর ভিত্তি করে বিচারক নিয়োগ দেন। এসব দেশে নিয়োগের সময়ই বিচারককে স্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়া হয়। ফলে বিচারক স্বাধীনভাবেই বিচার করতে পারেন। সুতরাং,আমাদের দেশেও স্থায়ী ভাবেই নিয়োগ দেয়া হোক। উচ্চ আদালতে নিম্ন আদালতের বিচারক নিয়োগের অনুপাত বাড়ানো যেতে পারে, যেন তাদের বিচারিক অভিজ্ঞতায় উচ্চ আদালতে বিচারের মান কিছুটা হলেও বাড়ে।
যাহোক, আইন কমিশনের সুপারিশগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে বিচারবিভাগের অনেক উন্নতি সাধিত হবে। সম্প্রতি আইন কমিশনের এক প্রভাবশালী সদস্য অত্যন্ত দু:খের সাথে বলেছেন, সরকার কমিশনের সুপারিশগুলো খুব কমই আমলে নেয়। আমরা চাই সরকার কমিশনের সুপারিশগুলো গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করুক। যেন অন্যান্য উন্নত দেশের বিচার বিভাগের মত আমাদের বিচার বিভাগ প্রতিযোগিতা করতে পারে ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে এবং মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারে।
আইন শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
Discussion about this post