বিডি ল নিউজ:
উচ্চ আদালতে বেঞ্চ অফিসারদের দুর্নীতিতে বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তি বাড়ছে। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, সুপ্রীমকোর্টের আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগের বেঞ্চে মামলা কার্যতালিকায় ওঠানোর (কজলিস্ট) জন্য সংশ্লিষ্ট বেঞ্চ অফিসারকে নির্দিষ্ট অংকের টাকা দিতে হয়। তা না হলে মামলা কবে কজলিস্টে উঠবে, তা জানা থাকে না আইনজীবী কিংবা বিচারপ্রার্থীদের।
কেবল কজলিস্ট নয়, আদেশ ও রায়ের নকল কপি পাওয়ার সময়ও বেঞ্চ অফিসারদের দৌরাত্ম্যের শিকার হতে হয় বিচারপ্রার্থীদের। এতেও গুনতে হয় মোটা অংকের টাকা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাইকোর্টের বেশ কয়েকটি বেঞ্চ আছে, যেখানে মামলা কজলিস্টে আনার জন্য বেঞ্চ অফিসারদের বেশি টাকা দিতে হয়। রিট কিংবা ফৌজদারি ক্ষমতাসম্পন্ন বেঞ্চে ভোগান্তির পরিমাণ আরও বেশি। আপিল বিভাগও এর বাইরে নয়।
ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করে জানান, এ সব বেঞ্চে ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে দুই থেকে পাঁচ হাজার টাকা, রিটের বেলায় পাঁচ থেকে দশ হাজার এবং দেওয়ানি ক্ষমতাসম্পন্ন বেঞ্চে এক থেকে পাঁচ হাজার টাকা দিতে হয়।
গাজীপুর থেকে আসা নূর মোহাম্মদ বিডি ল নিউজকে বলেন, ‘আমার এক ভাইয়ের অন্তর্বর্তীকালীন জামিনের জন্য হাইকোর্টে এসেছিলাম। আইনজীবীকে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দেওয়ার পরও মামলা কজলিস্টে তুলতে আরও তিন হাজার টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে।’
মুন্সীগঞ্জ থেকে আসা মো. লুৎফর রহমান বলেন, ‘জমিজমা সংক্রান্ত আমার একটি মামলার ছয় মাস শুনানি হয় না। আদালতে এসে জানতে পারি, বেঞ্চ অফিসারদের টাকা না দিলে মামলাটি কজলিস্টে আসবে না। তাই অনেক কষ্টে পাঁচ হাজার টাকা যোগাড় করে এনে দিয়ে মামলাটি কজলিস্টে আনার ব্যবস্থা করি।’
সরেজমিন দেখা গেছে, আদালতের কার্যক্রম শেষ হওয়ার পর বিচারপ্রার্থীরা নিজ হাতে অথবা আইনজীবীর সহকারীদের মাধ্যমে ছোট ছোট সাদা কাগজে টাকা মুড়িয়ে বেঞ্চ অফিসারদের হাতে দিয়ে আসেন। সাদা কাগজে লেখা থাকে সংশ্লিষ্ট মামলার নম্বর। মামলার অবস্থার ওপর ভিত্তি করে টাকার অংক কম-বেশি হয়ে থাকে।
‘ন্যায়বিচারের জন্য আমরা উচ্চ আদালতে আসি। এখানেও দুর্নীতি।’ সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতি ভবনের পাশে দাঁড়িয়ে এভাবেই কষ্টের কথা বলছিলেন গাজীপুর থেকে আসা একজন বিচারপ্রার্থী। ভোগান্তি থেকে মুক্তি পেতে তিনি প্রধান বিচারপতির হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বিডি ল নিউজকে বলেন, ‘শুধু বেঞ্চ অফিসারকে নয়, সেকশনেও টাকা না দিলে কাজ হয় না, কোনো ফাইল কোর্টে আসে না। সব জায়গায় দুর্নীতি শুরু হয়ে গেছে।’
খোকন বলেন, ‘প্রধান বিচারপতি চাইলেই এ সব দুর্নীতি বন্ধ করতে পারেন। কারণ সুপ্রীমকোর্টের সকল কর্মকর্তা তার অধীনে কর্মরত। প্রধান বিচারপতি উদ্যোগ নিলে আইনজীবী সমিতি সর্বোচ্চ সহযোগিতা করবে।’
উচ্চ আদালতসহ দেশের সকল আদালত অঙ্গন দুর্নীতিমুক্ত হোক এটা আইনজীবীদের প্রাণের দাবি বলেও উল্লেখ করেন বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের এই সদস্য।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সুপ্রীমকোর্টের মূল ভবনের একজন বেঞ্চ অফিসার বলেন, ‘অনেক বেঞ্চ অফিসার আছেন, যারা এভাবে দুর্নীতি করে ঢাকায় বাড়ি-গাড়ি কিনেছেন। কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন।’ বিচারপতিরা উদ্যোগ নিলেই এ দুর্নীতি বন্ধ করা সম্ভব বলে জানান তিনি।
বেঞ্চ অফিসারদের দুর্নীতি বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে সম্প্রতি আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে একটি চিঠি পাঠিয়েছে আইন কমিশন।
উচ্চ আদালতে বেঞ্চ অফিসারদের দুর্নীতির বিষয়ে কথা উঠলে গত বছর ২৪ জন বেঞ্চ অফিসারের বিরুদ্ধে তদন্ত করেছিল দুদক। তিনটি মামলা করার প্রস্তুতি নিয়ে এ তদন্ত করা হয়। প্রাথমিক তদন্তে কয়েকজনের বিরুদ্ধে কোটি টাকার দুর্নীতি প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল। এর পর বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলাও হয়।
২০১১ সালে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) বিচার বিভাগের ওপর প্রকাশিত জরিপ প্রতিবেদনে উচ্চ আদালতে বেঞ্চ অফিসারদের দুর্নীতির বিষয়টি বেরিয়ে আসে।
টিআইবির প্রকাশিত ওই প্রতিবেদন নিয়ে উচ্চ আদালতের পাশাপাশি দেশের সব আদালত অঙ্গন এবং সরকারের শীর্ষপর্যায়েও ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। এর পর সুপ্রীমকোর্ট থেকে টিআইবিকে কয়েক দফা নোটিশ পাঠানো হয়। টিআইবির কাছে জানতে চাওয়া হয়, তারা কীসের ভিত্তিতে জরিপের নামে আদালতের কর্মকর্তা ও বিচারকদের সম্পর্কে দুর্নীতির প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। টিআইবি পরে তথ্য-উপাত্ত সংবলিত নথি আদালতে জমা দেয়।
সুপ্রীমকোর্টের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার মো. কুদ্দুস জামান বলেন, ‘বেঞ্চ অফিসারদের দুর্নীতির বিষয়টি আমার জানা নেই। আপনাদের কাছে কোনো অভিযোগ থাকলে আমাকে দিন। সাধ্যমতো ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’
কোনো ভুক্তভোগী যদি আদালত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দেন, তাহলে প্রমাণসাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার জানান।
Discussion about this post