সিরাজ প্রামাণিক
একটা সময় ছিল, যখন দেশের রাজা যা খুশি করতেন, যাকে খুশি তাকেই শূলে চড়াতে পারতেন। মানবসভ্যতা সেই সামন্ততান্ত্রিক স্বেচ্ছাচারের যুগ অতিক্রম করেছে গণতান্ত্রিক দায়বদ্ধতায় প্রবেশের মাধ্যমে। আইনের চোখে সবাই সমান, এটি কেবল কথার কথা নয়, এটি আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার অন্যতম মৌল ভিত্তি। আমরা সেই রকম দায়বদ্ধ আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা নির্মাণ করতে পেরেছি কি?
মানুষ সন্ত্রাসের শিকার হলে ন্যায়বিচারের জন্য রাষ্ট্রের দ্বারস্থ হয়। কিন্তু রাষ্ট্রই যদি সন্ত্রাস করতে শুরু করে তখন মানুষ যাবে কার কাছে? শিয়ালের কাছে মুরগি বর্গা দেয়ার কাহিনী আমাদের সমাজে বহু আগে থেকেই প্রচলিত। যার অর্থ রক্ষকই যখন হয়ে উঠে ভক্ষক। পুলিশি হেফাজতে মৃত্যু কিংবা নির্যাতন বিচ্ছিন্ন ঘটনা হলে হয়তো এ নিয়ে উচ্ছবাচ্য করার কিছু ছিল না। কিন্তু যখন বিষয়টি অহরহ ঘটতে থাকে, তখন এটিকে নিছক দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেয়ার অবকাশ থাকে না।
এবার আসল কথায় আসি। কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে এক কলেজ ছাত্রকে মাদক ব্যবসায়ী বানিয়ে থানায় ধরে নিয়ে গুলি করে হত্যার হুমকি দেয়ার ঘটনায় ইউএনও-ওসি-এস.আইয়ের বিরুদ্ধে বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। গত বৃহস্পতিবার কুষ্টিয়ার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ও আমলি-২ (দৌলতপুর-ভেড়ামারা) আদালতের বিচারক এম.এম. মোর্শেদ স্বপ্রণোদিত হয়ে এ আদেশ প্রদান করেন।
দৌলতপুরের ওই কলেজছাত্র আব্দুল্লাহ আল মামুনকে বিনা অপরাধে গ্রেফতার করা হয়েছে কি-না, থানা হাজতে থাকাবস্থায় এসআই জাহিদ হুমকী প্রদর্শন করেছেন কি-না ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ৬/১ ধারা লংঘন করে ভ্রাম্যমাণ আদালতে শাস্তি প্রদান করেছেন কিনা তা আদালত জানতে চেয়েছেন। কুষ্টিয়া সহকারী জজ দৌলতপুর আদালতের বিচারক ফয়সাল আল মামুনকে আগামী ৩১ মে ২০১৭ তারিখের মধ্যে এ বিষয়ে তদন্ত পূর্বক আদালতে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, গত ৬ এপ্রিল কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র আবদুল্লাহ আল মামুন বাড়ির সামনে একটি চায়ের দোকানে বসে গল্প করার সময় সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে দৌলতপুর থানার এসআই জাহিদের নেতৃত্বে কয়েকজন পুলিশ সদস্য দুটি মোটরসাইকেলে সেখানে যান। পুলিশ সদস্যরা তার নাম-পরিচয় জানতে চান। তিনি বলার পর তাকে হাতকড়া পরিয়ে দৌলতপুর থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। রাতে তাকে হাজতেই রাখা হয়। রাত আড়াইটার দিকে থানার এসআই জাহিদ হাজত খানায় ঢুকে বলেন, ‘মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিন। ওপরের নির্দেশ আছে। আপনাকে গুলি করা হবে।’ এই বলে এসআই চলে যান। রাত ৩টার দিকে পুনরায় হাজতখানায় ঢুকে এসআই জাহিদ তার নাম-পরিচয়-ঠিকানা লিখে নেন। তখন মামুন এসআই জাহিদকে বলেন, ‘আমাকে বুকে গুলি করে মেরে ফেলেন। পায়ে গুলি করে পঙ্গু করে দিয়েন না।’ পরে গত ৯ এপ্রিল জেলা আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত সভায় কলেজ ছাত্রকে গুলি করে হত্যার হুমকির প্রসঙ্গটি উত্থাপন করে পুলিশের ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা আজগর আলী। এ নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হলে কুষ্টিয়াসহ দেশব্যাপী তোলপাড় শুরু হয়।
সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় রোগ নিরাময়ের পূর্বশর্ত। তেমনি পুলিশের এই বেপরোয়া আচরণের যৌক্তিক কারণ খুঁজে বের করা এ থেকে উত্তরণের প্রধান উপায়। ১৮৬১ সালের পুলিশ আইন এ দেশে সুশৃংখল পুলিশ বাহিনীর গোড়াপত্তন করে। এর আগে এ ধরনের কোন সুনির্দিষ্ট আইন ছিল না। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, পুলিশের বড়কর্তাদের এ আইনের ব্যাপারে বড়ই গাত্রদাহ। কারণ হিসেবে তারা দেখিয়ে থাকেন এটি ঔপনিবেশিক আমলে প্রণীত। সন্দেহ নেই, এটি ঔপনিবেশিক আমলে তৈরি। কিন্তু শুধু এ অজুহাতই কি ওটা বাতিলের জন্য যথেষ্ট? যদি তাই হয়, তাহলে ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধি, ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইন, ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধি অদ্যাবধি বাংলাদেশে ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় মৌলিক আইন। পুলিশের বড় কর্তাদের দাবি অনুযায়ী ওই আইনগুলোও বাতিল হওয়া দরকার, যেহেতু সেগুলো ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে প্রণীত। তাদের ওই পুলিশ আইনের ব্যাপারে গায়ে জ্বালাপোড়ার প্রধান কারণ মূলত ওই আইনের ৪ ধারা, যেখানে উল্লেখ রয়েছে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের সাধারণ নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধানে থেকে জেলা পর্যায়ে পুলিশ সুপার ও অধীনস্থ অন্য অফিসাররা দায়িত্ব পালন করবেন।
১৯৭৫ সালের ১০ ডিসেম্বর তৎকালীন সামরিক শাসক মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক সার্কুলারের মাধ্যমে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক জেলা পর্যায়ে পুলিশের এসপি ও অন্যান্য অফিসারের এসিআর অর্থাৎ বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন লেখার বিধান স্থগিত করেন। পুলিশ রেগুলেশন (পিআরবি) ১৯৪৩-এর ৭৫ক নং রেগুলেশন বলে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ওই এসিআর লিখতেন। ১৮৬১ সালের পুলিশ আইনের ৪ ধারার বিধানকে বাস্তবে কার্যকর করার জন্য পিআরবিতে এরকম বিধান করা হয়েছিল। পিআরবি একটি পূর্ণাঙ্গ ও বিস্তারিত আইনগত রূপ, যার দ্বারা পুলিশ বাহিনী তার সব কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে থাকে। এটি ১৮৬১ সালের পুলিশ আইনের ভিত্তিতে সৃষ্ট। সত্যিকার অর্থে পিআরবির সামান্য দু-একটি বিষয় ছাড়া অধিকাংশ বিষয় বাস্তবসম্মত এবং তা দেশ ও সমাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। পিআরবি’র ৭৫ক নং রেগুলেশনের মাধ্যমে ১৮৬১ সালের পুলিশ আইনের ৪ ধারার যে বাস্তবায়ন করা হতো, তা ১৯৭৫ সালের ১০ ডিসেম্বরে তৎকালীন সামরিক শাসকের হটকারী সিদ্ধান্তে অকার্যকর হয়ে যায়। ফলে আইন থাকলেও এখন তার বাস্তবায়ন নেই। যারা সমাজে আইনের প্রয়োগ ঘটাবে, তারা নিজেরাই যদি আইন না মানে তবে সমাজে আইনের শাসন নয় বরং বেআইনি শাসন প্রতিষ্ঠা হতে বাধ্য।
পুলিশ কর্তৃক আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের ফলে জনগণের জানমালের ক্ষতি হলে পিআরবির ১৫৭নং রেগুলেশন অনুযায়ী এতদিন নিরপেক্ষ তদন্তের বিধান ছিল। বিগত সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর কাছ থেকে পুলিশ কোনদিনই খালি হাতে ফেরেনি। পুলিশের গাড়ি, বাড়ি, জমিই শুধু নয়, এমনকি পুলিশ কর্তৃক মানুষ মারার লাইসেন্সও দেয়া হয়েছে তার আমলে। ৫ জুন ২০০৬ তারিখে জারিকৃত ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (সভা, সমাবেশ, মিছিল ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০৬-এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ওই বিধিমালার ১০নং বিধিতে পুলিশ কর্তৃক আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার তথা গুলিবর্ষণ করা হলে তার নিরপেক্ষ তদন্ত নয় বরং পুলিশি তদন্তের বিধান করা হয়েছে। ওই বিধিমালা পুলিশকে মানুষ মারার যে লাইসেন্স দিয়েছে, তা বাতিল করা না হলে পুলিশ শুধু মানুষ মারবে না, তা আইনসিদ্ধ বলেও অবলীলায় চালিয়ে দিতে থাকবে।
এবার আসি ইউএনও মহোদয় ৬/১ ধারা লংঘন করে ওই ভিকটিমকে ভ্রাম্যমাণ আদালতে শাস্তি প্রদান করেছেন কি-না।
ভ্রাম্যমাণ আদালত আইন, ২০০৯-এর ৬ ধারায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের ক্ষমতা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘ধারা ৫-এর অধীন ক্ষমতাপ্রাপ্ত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বা ধারা ১১-এর অধীন ক্ষমতাপ্রাপ্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও অপরাধ প্রতিরোধ কার্যক্রম পরিচালনা করার সময় তফসিলে বর্ণিত কোনো আইনের অধীন অপরাধ, যাহা কেবল জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক বিচার্য, তাহার সম্মুখে সংঘটিত বা উদ্ঘাটিত হইয়া থাকিলে তিনি উক্ত অপরাধ তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাস্থলেই আমলে গ্রহণ করিয়া অভিযুক্ত ব্যক্তিকে স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে দোষী সাব্যস্ত করিয়া এই আইনে নির্ধারিত দ- আরোপ করিতে পারবেন।’ ৬ ধারা অনুসারে কোনো ভ্রাম্যমাণ আদালত তাঁর সম্মুখে কোনো ঘটনা না ঘটলে বা উদ্ঘাটিত না হলে কোনো আসামিকে এ আইনে দণ্ডাদেশ প্রদান করতে পারবে না এবং দণ্ডাদেশ শুধু আসামির দোষ স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে প্রদান করা যাবে। আসামি দোষ স্বীকার না করলে আইনের ৭ ধারা অনুসারে অভিযুক্ত ব্যক্তির ব্যাখ্যা সন্তোষজনক হলে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাকারী ম্যাজিস্ট্রেট অভিযুক্তকে অব্যাহতি প্রদান করবেন। তবে প্রদত্ত ব্যাখ্যা সন্তোষজনক না হলে তিনি অভিযোগটি বিচারার্থে উপযুক্ত এখতিয়ার সম্পন্ন আদালতে প্রেরণ করবেন। ভ্রাম্যমাণ আদালত আইনের ৬(১) ধারা অনুসারে ভ্রাম্যমাণ আদালতের সম্মুখে কোনো ঘটনা সংঘটিত বা উদ্ঘাটিত না হলে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাকারী নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট উত্থাপিত অভিযোগ এখতিয়ার সম্পন্ন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে প্রেরণ করবেন।’ এ ঘটনা কিন্তু ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাকারী নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে সংঘটিত হয়নি। ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাকারী নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের উচিত, এ ক্ষেত্রে অভিযোগসহ গ্রেপ্তার করা আসামিকে পুলিশের মাধ্যমে এখতিয়ারসম্পন্ন আদালতে প্রেরণ করা। অথচ এ ক্ষেত্রে আইনের কোন ব্যাখ্যাই মানা হয়নি। অবশ্য ইতোপূর্বে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে এক শিক্ষার্থীকে দুই বছর সাজা দেওয়ার বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে টাঙ্গাইলের সখিপুর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও সখিপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) তলব করেছিলেন হাইকোর্ট। সেই সাথে ওই দু কর্মকর্তাকে অন্যত্র বদলীরও নির্দেশ দেন।
পরিশেষে যে কথা দিয়ে শেষ করতে চাই তাহলো, যে আইন মানবাধিকার রক্ষা করতে পারে না, যে আইন ন্যায়পর নীতিমালা রক্ষা করতে পারে না, যে আইন সংবিধান সমুন্নত রাখতে পারে না, যে আইন সব স্বচ্ছতা, যৌক্তিকতা এবং পদ্ধতিগত সংহতি রক্ষা করতে পারে না, সেই আইন আর যাই হোক জনস্বার্থ রক্ষা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে সক্ষম এ কথা বিশ্বাস করার কোনো যৌক্তিক অবকাশ নেই।
প্রিয় পাঠক! আসুন আমরা একটি ইতিবাচক সংবাদের অপেক্ষায় থাকি। যেদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে পত্রিকার পাতায় দেখতে পাবো ‘ বিচারক এম .এম মোর্শেদের স্ব-প্রণোদিত আদেশ কার্যকর হয়েছে এবং আইন আর যাই হোক জনস্বার্থ রক্ষা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছে।’ সেদিন আমাদের সংবিধানের শ্বাসত বাণী চিরন্তন রুপ পাবে। শুরু হবে নতুন এক যুগের। সাহসী ওই বিচারকের প্রতি রইল লাল সালাম।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, সাংবাদিক, আইন গ্রন্থ প্রণেতা ও গবেষক।
Discussion about this post