তানবীর চৌধুরী:
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৭ নং অনুচ্ছেদে বলা আছে যে, “প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ; এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে”৷ প্রথম লাইনে আসুন, ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ’- মানে হল জনগণই দেশের সকল ক্ষমতার মালিক, কিন্তু দ্বিতীয় লাইনে আবার বলল ‘জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে’- এর মানে সংবিধানে বাহিরে গিয়ে জনগণ কিছুই করতে পারবে না। অবশ্য সংবিধানে বাহিরে গিয়ে জনগণ কখনও কিছু দাবিও করে নি। এখন কথা হল, সংবিধানে যদি কোন সীমাবদ্ধতা থাকে, কিংবা সংবিধানে অগণতান্ত্রিক কিছু থাকে, তাও আমাদের বাধ্য হয়ে মেনে নিতে হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হল, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বসবাস করে কেন আমরা অগণতান্ত্রিক কিছু মেনে নিব? তেমনি একটি অগণতান্ত্রিক ইস্যু হচ্ছে আমাদের সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ[মূলত ৭০(১)]।
সংবিধানের ৭০(১) অনুচ্ছেদ নিয়ে ইতি মধ্যে অনেক লেখালেখি হয়েছে, উচ্চ আদালতে রীটও করা হয়েছে। লেখালেখি গুলো মূলত এই অনুচ্ছেদটির ত্রুটি নিয়ে হয়েছে। ত্রুটি নিয়ে আলোচনার আগে ৭০(১) অনুচ্ছেদটি পরখ করা যাক,
“কোন নির্বাচনে কোন রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হইয়া কোন ব্যক্তি সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হইলে তিনি যদি উক্ত দল হইতে পদত্যাগ করেন, অথবা সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করেন, তাহা হইলে সংসদে তাঁহার আসন শূন্য হইবে।
ব্যাখ্যা।- যদি কোন সংসদ-সদস্য, যে দল তাঁহাকে নির্বাচনে প্রার্থীরূপে মনোনীত করিয়াছেন, সেই দলের নির্দেশ অমান্য করিয়া-
(ক) সংসদে উপস্থিত থাকিয়া ভোটদানে বিরত থাকেন, অথবা
(খ) সংসদের কোন বৈঠকে অনুপস্থিত থাকেন,
তাহা হইলে তিনি উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবেন”।
-এর মানে হচ্ছে, সংসদে একজন সংসদ সদস্য যে দল থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন, সবসময় ঐ দলকেই ভোট দিতে হবে। এখন প্রশ্ন হল, আমাদের দেশের গণতন্ত্রের মক্কা হল জাতীয় সংসদ, সেই সংসদেই যদি গণতন্ত্র না থাকে তাহলে সারাদেশে গণতন্ত্র চর্চা হবে কি করে? একজন সংসদ সদস্যের বক্তব্য/মতামত কেবলমাত্র ওনার বক্তব্য/মতামত ভাবলে চলবে না, একজন সংসদ সদস্যের বক্তব্য একটি আসনের লক্ষাধিক মানুষের বক্তব্য। অতএব, একজন সংসদ সদস্যকে অবহেলা করা মানে লক্ষাধিক মানুষকে পাত্তা না দেওয়া। এটা গণতন্ত্রের সাথে অসমঞ্জসপূর্ণ। কেননা, সাধারণ মানুষ সংসদে গিয়ে কিছু বলার যোগ্যতা রাখে না বলেই তারা প্রতি আসন থেকে একজন করে প্রতিনিধি নির্বাচন করে সংসদে পাঠায়। কিন্তু, সংসদে গিয়ে সেই সংসদ সদস্য কি নিজের এলাকার জনগণের মতামত উপস্থাপন করে নাকি উনাকে যে দল থেকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে সেই দলের হুজুরের সাথে মাথা নাড়িয়ে হুজুরের মনের ইচ্ছা পূরণ করেন? সেটা সবারই জানা আছে। আচ্ছা, বেচারা সংসদ সদস্যরই বা কি করার আছে? নিজ দলকে ভোট না দিলে নিজের দল থেকে তো বাদ পড়বেনই সাথে সাথে সংসদ সদস্য পদটুকুও হারাবেন। নিজের পায়ে নিজে কুড়াল তো আজকাল পাগলও মারে না। তাই, বাধ্য শিষ্যের মত হুজুরকে মান্য করছে, আর সাধারণ জনগণের সাথে একরকম প্রতারণাই করছে। সংসদ সদস্য নিজেও বাধ্য, তাই আর বেশী কিছু বলার থাকে না। কিন্তু এককথায় এটা খুবই কষ্টের।
একটা উদাহরণ দিলে পুরো ব্যাপারটা সহজ হয়ে যাবে। কিছু দিন আগে আমাদের মহামান্য রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছিল। রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন এ্যডভোকেট আব্দুল হামিদ। নিঃসন্দেহে তিনি একজন ভালো মানুষ এবং যথেষ্ট নিরপেক্ষ। উনাকে নির্বাচন করার ক্ষেত্রেও এই অনুচ্ছেদ মাথায় রেখেই সংসদ সদস্যরা ভোট দিয়েছেন নিশ্চয়ই। কিন্তু এই অনুচ্ছেদের ভয় যদি না থাকতো, তাহলে আমরা নিশ্চয়ই আরো বেশী নিরপেক্ষ কেউ কে পেতাম। অনেকে হয়তো বলবেন এর চেয়ে খারাপও পেতে পারতাম। আপনিও সঠিক। কিন্তু, কথা হল, ভাল পাই আর খারাপ পাই, পদ্ধতিটা গণতান্ত্রিক হওয়া তো আবশ্যক। যদিও আমরা জানি, গণতন্ত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর একটা মাথা মোটা ঠাকুরের মধ্যে কোন পার্থক্য না, ভোট যে বেশী পাবে সেই মুখ্য। ভোটের পদ্ধতিটা যদি গণতান্ত্রিক হত, তাহলে মনে কষ্ট থাকতো না। কিন্তু ভোটই যদি হয় অগণতান্ত্রিক তাহলে নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যেতে পারে।
লোকজনকে বলতে শুনেছি, নেতাদের কাছে নাকি সাধারণ জনগণের হাত পা বন্দি, কিন্তু এখন তো দেখছি নেতাদের হাত পা হুজুরদের হাতে বন্দি। আর বন্দি করার এই কৌশল হুজুররা পাচ্ছেন স্বয়ং সংবিধান থেকে। বাংলাদেশের মত একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সংবিধানের ৭০(১) অনুচ্ছেদটি অগণতান্ত্রিক ভূমিকা পালন করছে। আর এর পায়দা নিচ্ছে যখন যে ক্ষমতায় আসছে। মনোনয়ন থেকে শুরু করে সংসদে ভোট সব কিছুই অগণতান্ত্রিক। মনোনয়ন দেওয়া না হয় দলের দলীয় কাজ, কিন্তু সংসদে ভোট দেওয়াটা সম্পূর্ণ সংসদ সদস্যের ব্যক্তিগত কাজ, এতে দলের নাক গলানোটা সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক। অবিলম্বে এই অনুচ্ছেদ সংশোধন না করলে, অচিরেই দেখা যাবে বাচ্চারা বাংলা ব্যাকরণে সমার্থক শব্দ পড়তে গিয়ে দেখবে গণতন্ত্র=একনায়কতন্ত্র। কাগজে কলমে গণতন্ত্র হলেও বাস্তবে এখনই চলছে একনায়কতন্ত্র। কেননা, জিয়াউর রহমান কিংবা এরশাদ সাহেবের শাসন আমলের সাথে এখনকার শাসনের তেমন কোন তফাৎই নাই। তখন রাষ্ট্রপতি যা বলতেন, তাই হত; আর এখন হুজুর যা বলছেন তাই হচ্ছে। জনগণের কথা সে কালেও কেউ শুনে নাই, এই কালেও না। তাহলে গণতন্ত্র আমাদের কি দিল? রক্ত দিয়ে পাওয়া এই গণতন্ত্র থেকে কি পেলাম? গণতন্ত্র কি দিল বলাতে একটা গল্প মনে পড়ে গেল, শহরের এক ব্যাচেলর রান্না বান্না নিয়ে খুবই হতাশ। নিজে রান্না বান্না করে খেতে খুব কষ্ট হয় দেখে তার মা ভাবল ছেলেকে বিয়ে করিয়ে দিই। যেই কথা সেই কাজ, ব্যাচেলর থেকে সরাসরি বিবাহিত পুরুষ। কিন্তু মজার ব্যাপার হল, বিয়ের পর স্বামী জানতে পারলো, তার নববধূ রান্না করতে পারে না। তাহলে কি হল, যেই লাউ সেই কদু। আগে তো নিজে একা রান্না করে খেত, এখনতো নতুন বোঝা তার কাঁধে। আমাদেরও কি এখন সেই আবস্থা না? কত সংগ্রাম করলাম গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য; কিন্তু কি দিল এই গণতন্ত্র? একটি মাত্র অনুচ্ছেদের জন্য সংবিধানে গণতন্ত্র নিয়ে প্রশ্ন উঠুক, এটা আমাদের কারও কাছেই প্রত্যাশিত না। তাই, সর্বোচ্চ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষে অতিশীঘ্রর সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদটি সংশোধন করা হোক। সংসদে সংসদ সদস্যদের ভোট দেওয়ার স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হোক।
তানবীর চৌধুরী
শিক্ষার্থী, দ্বিতীয় বর্ষ, আইন বিভাগ, নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়
Discussion about this post