মো: সাজ্জাদ হোসেন
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিভাবান ও তরুণ মেধাবী ছাত্ররা যখন দ্রুত শিক্ষা জীবন শেষ করে একটি ভাল চাকরির আশায় প্রতিনিয়ত দিন গোনে এবং বেকারত্বের অভিশাপ ঘুচিয়ে নিজেকে স্বাবলম্বী করতে চায়। সেখানে অনেকেই আবার নতুন কিছু করার তাগিদে চাকরির প্রলোভনে নিজেকে না জড়িয়ে ভিন্ন কিছু করার স্বপ্ন দেখে। আর সেরকমই এক স্বপ্নবাজ তরুন মেধাবী আইনজীবী আব্দুল্লাহ আল আরিফ।
২০১১ সাল । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি ও এলএলএম শেষ করে সব বন্ধুরা যখন বেকারত্বের কারণে আর্থিক কষ্ট, হলের বেডের ছাড়পোকার কামড় আর ডাইনিং এর বিখ্যাত পাতলা ডালের স্বাদ ভোলার জন্য মরিয়া হয়ে চাকরিতে যোগদান নিয়ে ব্যস্ত, ঠিক তখনই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন আবার পড়াশোনার! কতোটা দৃঢ় লক্ষ্য আর অবিচল স্বপ্ন থাকলে এমন একটা সিদ্ধান্ত নেয়া যায় সেটা আব্দুল্লাহ আল আরিফকে না দেখলে বোঝার উপায় নেয়। তাই ২০১১ সালেয় ২য় এলএলএম করার জন্য পাড়ি জমান ভারতের নয়া দিল্লীতে। এরপর SAARC India Silver Jubilee Scholarship নিয়ে ভর্তি হন সাউথ এশিয়ান (সার্ক) বিশ্ববিদ্যালয়ে।
সাল ২০১৩। স্বপ্নের এলএলএম শেষ করে যখন দেশে ফিরে আসেন। সঙ্গে ছিল স্বপ্নের এলএলএম এর ডিগ্রী আর বিশ্ববিদ্যালয়ের এলএলএম পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধকার করার স্বীকৃতিস্বরুপ University Gold Medal । দেশে ফিরে তার বন্ধুরা সবাই যখন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ঠিক তখন তাকে নামতে হয় জীবনে টিকে থাকার সংগ্রামী যুদ্ধে। বন্ধুদের সবার পকেটে যখন মোটা অঙ্কের বেতনের ঝনঝনানি। ঠিক তখন আব্দুল্লাহ আল আরিফের প্রতিদিন শুরু হত নতুন কিছু করার আশায়। অন্য সবাই যখন চাকরি-বাকরি নিয়ে ব্যস্ত সেসময় আব্দুল্লাহ আল আরিফের সময় যেত চাকরির পত্রিকায় চোখ বুলাতে বুলাতেই।
এমন সময় জানতে পারলেন নতুন এক ইংরেজি দৈনিক Dhaka Tribune পত্রিকার কথা যারা পত্রিকায় আইন পাতা বের করতে আগ্রহী সেজন্য একজন যোগ্য লোকের দরকার। স্যার সরাসরি পত্রিকার সম্পাদকের কাছে চলে গেলেন। এবং তার মেধা চিন্তা আর বুদ্ধিদীপ্ততা সম্পাদকের বুঝতে দেরী হল না। অল্পদিনে বেকারত্বের অভিশাপ ঘুচিয়ে যোগদান করলেন Dhaka Tribune পত্রিকায়। আইনের এত মেধাবী আর স্বর্ণ পদকপ্রাপ্ত একজন ছাত্র হয়েও জুডিশিয়ারী, আইনজীবী কিংবা অনেক লোভনীয় সব চাকরির প্রস্তাবে না গিয়ে যোগদান করলেন কিনা সাংবাদিকতায়! তখনই বোঝা গিয়েছিল ব্যতিক্রম কিছু হতে যাচ্ছে।
কিন্তু একটা সম্পূর্ণ আইনপাতা সামলানো কি আর চারটি খানি কথা? এতো এতো লেখা পাবো কোথায়? একা আর কতই বা লেখা যায়? এরকম হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে লাগল তার মাথায়। কিন্তু তিনি দমে যাওয়ার পাত্র নয়। তাই নিজের দুইটা লেখা আর সাথে সৈয়দ রাশেদ ইমাম আকলেন এক কার্টুন চিত্র। অবশেষে বের করা করা হল আইন পাতার একটা ডামি কপি। সেটা দেখানো হল পত্রিকার সম্পাদককে। সম্পাদকই আইন পাতাটির নাম দিলেন Juris । আর সেই সাথে শুরু হল Juris এর গল্প। আর তখন থেকেই Juris আর আব্দুল্লাহ আল আরিফ এক অঙ্গাঅঙ্গি নাম। Juris ছিল তাঁর ঘরের সদস্যেদের মত। এমনও হয়েছে Juris কে সময় দিতে গিয়ে নিজের পরিবারকে ঠিক মত সময় দিতে পারেননি। Juris ই ছিল তার সব ধ্যনজ্ঞান। পত্রিকার আইন পাতাটি যখন আকাশছোয়া জনপ্রিয়তার কাছাকাছি তখনই পত্রিকা কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিল পত্রিকাটির কিছু বিষয় বাদ দেবার। তার মধ্যে আইন পাতাটি ও পড়ে গেল। মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হল স্যারের। দীর্ঘ ২ বছরের অক্লান্ত শ্রম, সাধনা আর অধ্যবসায় সামান্য একটা সিদ্ধান্তের কাছে হার মেনে যাবে? স্যার যেন কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলেন পত্রিকার সমস্ত লেথাগুলো একত্রিত করে বই আকারে প্রকাশ করলে কেমন হয়? কিন্তু বাধ সাধল খরচ? তখন এগিয়ে এলেন তাঁর শ্রদ্ধেয় শিক্ষক এস এম মাসুম বিল্লাহ। বই এর উচ্চমান লেখনীগুলো দেখে “পলল প্রকাশনী” বই টি প্রকাশ করার ব্যপারে আগ্রহ পোষণ করল। বইটি নাম নামকরণ করা হল- “JURIS: A layman’s guide to the law” । এখানে layman মানে হল অ-বিশেষঙ্গ বা সাধারণ মানুষ। অর্থাৎ আইন এর সাথে সম্পর্কিত নয় কিংবা সাধারন মানুষ যারা আইন কে অনেক দুর্বোধ্য মনে করেন তাদের কাছে আইনকে আরো সহজ ভাবে উপস্থাপন করার জন্য এ বইটি অনেক কার্যকরি। বই টিতে মূলত সাধারণ মানুষের আইন সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর এবং আমাদের প্রতিনিয়ত যে আইনগুলো জানা খুব দরকার সেগুলো অতি সহজ ও প্রাঞ্জল ভাষায় লেখা হয়েছে।
“JURIS: A layman’s guide to the law” বইয়ের প্রচ্ছদ অংকন করেছেন দেশ সেরা গুণী ও বরেন্য শিল্পী সব্যসাচী হাজরা। এবং বই এর মূল ভূমিকা লিখেছেন এই সময়ের শ্রেষ্ঠ মেধাবী তরুণ শিক্ষকদের একজন যিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এবং বর্তমানে নিউজিল্যান্ডের ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি অব ওয়েলিংটনে পিএইচডি গবেষক এস এম মাসুম বিল্লাহ।
বইয়ের সূচি দেখলেই মনে হয় এ যেন আইনের এক বৃহৎ জাদুঘর। কি নেই এখানে? দেশের নারী-অধিকার থেকে শুরু করে দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োজনীয় ছোটবড় আইন, দেশের আইন ব্যবস্থা, আইন শিক্ষা, বাক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সংবিধান, শিশু অধিকার, বিচারব্যবস্থার স্বরূপ, মানব পাচার, টর্ট আইন, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি, বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি আইন, শ্রম আইন, তথ্য আইন, পুলিশ সংস্কার ও কারাগার, শরণার্থী আইন, মানবাধিকার মানবিক আইন, মাদক আইন, খাদ্য নিরাপত্তা, সমুদ্র সীমা, চিকিৎসায় অবহেলা ও অসদাচরণ, নাগরিকত্ব ও জাতীয়তা আইন, ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠি প্রতিবদ্ধী কিংবা ৩য় লিঙ্গধারী নাগরিকের অধিকার ও সংকট, এমনকি বুক রিভিউ পর্যন্ত- এমন নানান বিষয়স্তুর অধীনে এক সুতোয় গ্রন্থিত হয়েছে শ খানেক অসাধারণ আইন বিষয়ক সব প্রবন্ধ।
সদ্য প্রকাশিত হওয়া বই টি ইতিমধ্যেই বাজারে ব্যাপক সারা ফেলেছে। মাত্র ৩০০ টাকা মূল্যের আইনের এমন অমূল্য বইটি যেন আস্ত এক আদালত। বই টি পাওয়া যাচ্ছে ঢাকার শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটের নিচ তলার “পলল প্রকাশনীর” স্টলে। ঢাকার বাইরের গ্রাহকরা রকমারি.কম এ গিয়ে অর্ডার দিয়েও বইটি পেতে পারেন।
উল্লেখ্য, আব্দুল্লাহ আল আরিফ বর্তমানে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশানাল ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের তুমুল জনপ্রিয় একজন প্রভাষক হিসাবে কর্মরত আছেন। আইন বিষয়ক লেখালেখির সাথে অনেক দিন ধরেই জড়িত আছেন। অতি সম্প্রতি তার একটি গবেষণা প্রবন্ধ Macquarie Journal of International and Comparative Environmental Law (MqJICEL) এ প্রকাশিত হয়েছে। এই জার্নালটি প্রকাশ করে অস্ট্রেলিয়ার Macquarie University school of Law.
বহু প্রতিভার অধিকারী আব্দুল্লাহ আল আরিফ একাধারে শিক্ষক, সাংবাদিক এবং সবশেষ লেখক হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে নিজেকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন।
লেখক: আইন শিক্ষার্থী ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি,
Discussion about this post