ঊনিশ শতকের ঔপনিবেশিক আইন অনুযায়ী প্রণীত জেল কোডের তালিকাভুক্ত বিধি ও আইন অনুযায়ী বর্তমানে দেশে অবস্থিত কেন্দ্রীয় কারাগারসহ সব কারাগারগুলো পরিচালিত হয়ে থাকে। এসব বিধি ও আইনের মধ্যে রয়েছে কারা ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত কারা আইন ১৮৯৪; ১৮৭১ সালের কারাবন্দি আইন; কারাবন্দিদের ব্যবস্থাপনা ও প্রশিক্ষণ সম্পর্কিত ১৯০০ সালের কারাবন্দি আইন; কারাবন্দিদের ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত দেওয়ানি কার্যবিধি এবং ১৮৬০ সালের দ-বিধি আইন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জেল কোড পরিবর্তন ও সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলেও স্বাধীনতা পরবর্তী ৪২ বছরেও এসব আইনের প্রয়োজনীয় পরিবর্তন বা সংস্কার করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। যেটুকু হয়েছে তা সময়ের প্রয়োজন মেটাতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ও সংস্কারের জন্য বিভিন্ন সময়ে গঠিত বিভিন্ন কমিটি কর্তৃক প্রণীত সুপারিশমালা আলোর মুখ দেখেনি এবং সেগুলো বাস্তবায়িতও হয়নি।
আইনানুসারে ইন্সপেক্টর জেনারেল অব প্রিজন (আইজি-প্রিজন) দেশের সব কারাগারের তত্ত্বাবধান করেন। তাকে অতিরিক্ত ইন্সপেক্টর জেনারেল অব প্রিজন (এআইজি-প্রিজন), ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল অব প্রিজন (ডিআইজি-প্রিজন), জেল সুপারিন্টেন্ডেন্ট, জেলার, ডাক্তার, ডেপুটি জেলার তাকে এ কাজে সহায়তা করেন। বর্তমানে প্রচলিত জেল কোড অনুযায়ী সব দ-িত কয়েদি, বিচার চলমান কয়েদি এবং ডিটেনির জন্য জেলখানায় ৩৬ বর্গফুট জায়গা বরাদ্দ দেয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে একজন বন্দিকে জেল কোডে বর্ণিত জায়গার এক-তৃতীয়াংশ জায়গায় থাকতে হচ্ছে। অর্থাৎ জেলখানাগুলোয় ধারণ ক্ষমতার চেয়েও কমপক্ষে তিনগুণ বন্দি এ মুহূর্তে অবস্থান করছে।
প্রচলিত জেল কোডের ৩১ ধারা অনুযায়ী ইন্সপেক্টর জেনারেল অব প্রিজন (আইজি-প্রিজন) প্রতিবছর কমপক্ষে একবার কেন্দ্রীয় জেলখানা এবং অন্ততপক্ষে প্রতি দুই বছরে একবার জেলা কারাগারগুলো পরিদর্শন করবেন। একইভাবে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট প্রতি সপ্তাহে কমপক্ষে একবার জেলা কারাগার পরিদর্শন করবেন। যদি কোনো কারণে তিনি তা করতে অপরাগ হন তাহলে তার পরিবর্তে তার অধস্তন কোনো সিনিয়র কর্মকর্তা বা ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট কারাগার পরিদর্শনের এ দায়িত্ব পালন করবেন। এছাড়া জেল কোডের ৫৫ ধারা অনুযায়ী সরকার জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, বিভাগীয় কমিশনার, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, জেলা জজ, সিভিল সার্জন এবং জেলা স্কুল পরিদর্শক মহোদয়ের সমন্বয়ে জেলখানা পরিদর্শক দল গঠন করবেন যারা নিয়মিত জেলখানা পরিদর্শন করবেন। ৫৬ ধারায় সংসদ সদস্য ও বিভাগীয় কমিশনার কর্তৃক বেসরকারি জেল পরিদর্শক নিয়োগ দানের কথা বলা হয়েছে।
প্রচলিত জেল কোডে সরকারি ও বেসরকারিভাবে কারাগার পরিদর্শনের কথা থাকলেও প্রকৃতপক্ষে ইন্সপেক্টর জেনারেল অব প্রিজন (আইজি-প্রিজন) কেন্দ্রীয় ও জেলা পর্যায়ের কারগারগুলো পরিদর্শনের যথেষ্ট সময় পায় না এবং তিনি খুব কম সময়ই কারাগার পরিদর্শন করে থাকেন। একইভাবে ইন্সপেক্টর জেনারেল অব প্রিজন (এআইজি-প্রিজন) এবং ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল অব প্রিজন (ডিআইজি-প্রিজন) কম সময়ই কারাগার পরিদর্শন করে থাকেন।
যদিও কদাচিৎ করেন, তা পরিদর্শন পরবর্তী সময়ে বন্দিদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা বৃদ্ধি করা ছাড়া কোনো মঙ্গল বয়ে আনে না। কারণ কারাগার পরিদর্শনের আগে সরকারি কর্মকর্তারা কর্তৃক পরিদর্শনসংক্রান্ত খবর কারা-কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়। ফলে কারা-কর্তৃপক্ষ পরিদর্শনকারীদের দেখানোর উপযোগী করে কারাগার প্রস্তুতের যথেষ্ট সময় পায় এবং তারা সেভাবেই তা প্রস্তুত করে থাকেন। এসময় কর্তৃপক্ষ কারা-অভ্যন্তরস্থ অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি ও অন্যান্য অবিচার সম্পর্কে পরিদর্শকদের তথ্য না জানানোর জন্য বন্দিদের নানাভাবে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে।
তাছাড়া পরিদর্শকরা সবসময়ই কারা-কর্তৃপক্ষকে সঙ্গে নিয়ে কারা-অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন এবং তা পরিদর্শন করেন। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বন্দিরা কারা-অভ্যন্তরস্থ অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি ও অন্যান্য অবিচারসংক্রান্ত বিষয়গুলো পরিদর্শকদের কাছে বলতে সাহস করে না। যদি কোনো বন্দি তা বলেও ফেলে তবে তাকে নির্মম নির্যাতনের শিকার, এমনকি মৃত্যুবরণ পর্যন্ত করতে হয়।
তাছাড়া বেসরকারি জেল পরিদর্শকরা সাধারণত রাজনৈতিক প্রভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে থাকেন। ফলে রাজনৈতিক সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তাদেরও পরিবর্তন করা হয়। যখন যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসে তখন সরকার সে দলের আদর্শে বিশ্বাসীদের কারা পরিদর্শক হিসেবে নিয়োগ প্রদান করে। এভাবে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বেসরকারি কারাপরিদর্শকদের নিয়োগদান বন্দিদের জন্য কোনো সুফল বয়ে আনে না।
তাই, কারাগার সংস্কার সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তি, নির্যাতনের বিরুদ্ধে কনভেনশনের ঐচ্ছিক প্রোটোকল অনুমোদন করে সে অনুযায়ী আমাদের দেশে প্রচলিত কারাগারসংক্রান্ত আইনগুলোর সংকলন তৈরি করা দরকার। এতে আমাদের আইনগুলো যুগোপযোগী হতে পারবে। বিদ্যমান জেল কোড সংশোধন করে কার্যকরভাবে কারাগার পরিদর্শনের ব্যবস্থা করতে হবে সরকারকে। সরকারি ও বেসরকারি উভয় ধরনের পরিদর্শকদের কার্যক্রম ফলপ্রসূ করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। তবেই কারাগারগুলোয় বিদ্যমান দুর্নীতি ও অনিয়মের অবসান হয়ে কারা ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন হবে এবং কারাবন্দিদের মানবাধিকার সুরক্ষিত হবে।
Discussion about this post