সিরাজ প্রামাণিক
যে জমিগুলো সাধারণত সরাসরি সরকারের মালিকানাধীন থাকে সেগুলোকে আমরা খাস জমি বলে থাকি। অর্থাৎ সরকারের যে জমি কালেক্টরের নামে রেকর্ড তাকে খাস জমি বলে। জেলা প্রশাসক বা ডিসি সাহেব যখন জমি জমার বিষয়ে কাজ করেন তখন তাকে কালেক্টর বলে। অন্যান্য সংস্থার জমিও সরকারের মালিকানায় থাকলেও তাকে খাস জমি বলা হয় না। কারণ জমিগুলো যে সংস্থার মালিকানায় থাকে সেই সংস্থার জমি বলে পরিচিত হয়, যেমন রেলের জমি। খাস জমির কোন ভূমি উন্নয়ন কর দিতে হয় না কিন্তু সংস্থার জমির ভূমি উন্নয়ন কর দিতে হয়।
খাস জমির মজার ইতিহাস আছে। খাস ফার্সি শব্দ, এর অর্থ একান্ত আপন বা নিজস্ব বা নিজের। মোগল আমলে ‘খালিসা’ ও ‘জায়গির’ এই দুই ধরনের জমি ছিল। মোগল সম্রাট খালিশা জমি নিজের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ রাখতো। এই জমি হতে সম্রাটের ইচ্ছানুযায়ী জায়গির দান করা হতো। সম্রাটের ব্যক্তিগত খরচ মেটানোর জন্য কিছু জমি আলাদা করে রাখা হতো তাকে ‘সির্ফ-ই-খাস’ বা ‘একান্ত নিজের’ বলা হতো। সম্রাট সাধারণত উর্বর জমি তার নিয়ন্ত্রণে রাখতেন। ১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্র কাননে বাংলার বিহার উড়িষ্যার নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পতনের পর এদেশে ইংরেজ শাসন কায়েম হয়। ইংরেজরা ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু করে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থা প্রবর্তনের পর জমিদারগণ কিছু জমি সরাসরি তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতেন। জমিদারগণ এই জমিকে খাস জমি বলতেন। ১৯৫১ সালে জমিদারী অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন জারি করে জমিদারী উচ্ছেদ করা হয়। এই আইনে জমিদারদেরকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ জমি নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ রেখে বাকি জমি সরকারের নিকট সমর্পণ করার আদেশ দেয়া হয়। এইসব জমি কালেক্টরের ১নং খাস খতিয়ানে নেয়া হয় যা খাস জমি হিসেবে পরিচিত। কালেক্টর ছাড়া অন্যান্য সংস্থার নামের রেকর্ডীয় জমি খাস জমি হিসেবে পরিচিত না।
জমি কিভাবে খাস হয়
জমিদারদের ব্যবহৃত সিলিং বহির্ভূত অতিরিক্ত খাস জমি জমিদারী অধিগ্রহণের সময় কালেক্টরের খাস খতিয়ানে নেয়া হয়। বছরের পর বছর বন্দোবস্ত দেয়ার কারণে খাস জমি ক্রমে ক্রমে কমে যায়। অপরদিকে বিভিন্নভাবে খাস খতিয়ানে নতুন নতুন জমি যোগ হয়। নতুন চর জেগে উঠলে তা খাস জমি হিসেবে বিবেচিত হয়। কোন মালিক একাধারে ৫ বছর জমি অনাবাদি রেখে বাস্তুভিটা ত্যাগ করলে বা তিন বছরের বেশি সময় খাজনা না দিয়ে জমি অনাবাদি রাখলে সহকারী কমিশনার ভূমি নোটিশ দিয়ে শুনানি করে সেই জমি খাস করতে পারেন। জমি সাবলেট দেয়া নিষিদ্ধ থাকা সত্ত্বেও যদি সাবলেট দেয়া হয় তবে শুনানি করে বাজেয়াফত করে খাস খতিয়ানে নেয়া যেতে পারে। সিলিং বহির্ভূত সমর্পিত জমি কালেক্টরের খাস খতিয়ানে যোগ হয়। যে কেউ তার জমি সরকার বরাবরে খাস খতিয়ানে সমর্পণ করতে পারেন। খাজনা বকেয়া থাকলে বা কোন ঋণ থাকলে বা জরিমানা হলে বা সম্পত্তি বাজেয়াফত হলে খাস খতিয়ানে নেয়া যায়। সরকার কোন প্রকল্প বাস্তবায়ন বা অন্য কাজে জমি অধিগ্রহণ করতে পারে যাকে আমরা একোয়ার বলে জানি। আপনার জমি একোয়ার করা হলে আপনি ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অধিকারী। তবে নানা কারণে এই অধিগ্রহণের টাকা তুলতে অসুবিধা হয় এবং জমির প্রকৃত দামের চেয়ে কম টাকা ক্ষতিপূরণ পাওয়া যায়। যাহোক একোয়ার করা জমি খাস খতিয়ানে আসতে পারে। এছাড়া অন্য আইনের মাধ্যমেও জমি সরকারের খাস খতিয়ানে আসতে পারে যেমন কোন ব্যক্তি ওয়ারেশ ছাড়া মারা গেলে তার জমি খাস খতিয়ানে আসে।
যেভাবে খাস জমির শ্রেণীবিন্যাস করা হয়
১. কৃষি খাস জমি
২. অকৃষি খাস জমি
ক) চা বাগান, রাবার বাগান, চিংড়ি চাষের জমি
খ) সর্বসাধারণের ব্যবহার্য জমি যেমন রাস্তা, খাল, ঘাট ইত্যাদি
গ) জেগে উঠা চরের জমি
কারা খাস জমি বন্দোবস্ত পাওয়ার অধিকারী
কৃষি খাস জমি সাধারণত ভূমিহীনরা বন্দোবস্ত পাওয়ার অধিকারী। সে জন্য জেনে নেয়া দরকার কারা ভূমিহীন হিসেবে গণ্য হবে। খাস জমি বরাদ্দ নীতিমালা অনুযায়ী সেই সব পরিবার ভূমিহীন বলে গণ্য হবে যেসব পরিবারের (ক) বসতবাড়ী ও কৃষি জমি কিছুই নাই, কিন্তু পরিবারটি কৃষি নির্ভর (খ) ১০ শতাংশ পর্যন্ত বসতবাড়ী আছে কিন্তু কৃষিযোগ্য জমি নেই, এইরূপ কৃষি নির্ভর পরিবারও ভূমিহীন হিসেবে গণ্য হবে।
তবে একটি উপজেলায় ভূমিহীন পরিবারের সংখ্যা অনেক খাকতে পারে । সবাইকে একসাথে জমি দেয়া সম্ভব নাও হতে পারে। কারণ সেই উপজেলায় পর্যাপ্ত পরিমাণ খাস জমি নাও থাকতে পারে। খাস জমি থাকলেও দেখা যায় দেওয়ানি আদালতে মামলা মোকদ্দমা থাকার কারণে বন্দোবস্ত দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। তাছাড়া সকল শ্রেণীর খাস জমি বরাদ্দ দেয়া যায় না। তাই সরকার ভূমিহীনদের জমি বন্দোবস্ত পাওয়ার একটি অগ্রাধিকারের ক্রম তৈরি করে দিয়েছে। সেই অগ্রাধিকারের ক্রম নিচে দেয়া হল-
কারা খাস জমি বন্দোবস্ত পাওয়ার অগ্রাধিকার
সবার আগে (১) দুঃস্থ মুক্তিযোদ্ধা পরিবার, এরপর (২) নদীভাঙা পরিবার, তারপর (৩) সক্ষম পুত্রসহ বিধবা বা স্বামী পরিত্যক্তা পরিবার, তারপর (৪) কৃষি জমিহীন ও বাস্তুভিটাহীন পরিবার, তারপর (৫) অধিগ্রহণের ফলে ভূমিহীন পরিবার, সবশেষে (৬) যে পরিবারের ১০ শতাংশ পর্যন্ত বসতবাড়ী আছে, কৃষি জমি নেই কিন্তু কৃষি নির্ভর।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইন গ্রন্থ প্রণেতা ও গবেষক।
Discussion about this post