সুরেলা……
জেলের চার দেয়ালের মধ্যে সুরেলার, সুজনের কুপ্রস্তাবের কথাগুলো যেন থাকে প্রতিনিয়ত।কি রকম পশুর মত আচরণ!সুরেলার অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে যেন তাকে নিলামে বিক্রি করার অধিকার পেয়েছিলেন তিনি।সুরেলার আম্মার নাম আরজুমা বানু।রবীন্দ্র সঙ্গীতে গলার স্বর অত্যান্ত সুন্দর হওয়াই তার স্বামী তাকে আদর করে ডাকে তার প্রতিদান হিসেবে কারও সঙ্গে পরিচিত হলে প্রথমেই সুরেলা নাম বলতো।কখনো আসল নাম বলতো না আবার কখনো বা বলতো।তার চারপাশে অনেকেই সে জন্য তার আসল নামটি জানেনা।
মোদাচ্চের হোসেনের সাথে তার সংসার ও পারিবারিক জীবন সুখেই কাটছিল।ভালোবাসা কমতি ছিলনা কখনো।কিন্তু কথায় বলে,টাকা পয়সা না থাকলে ভালোবাসা নাকি জানালা দিয়ে পালিয়ে যায়।না তাদের ভালোবাসা পালিয়ে যায় বরং বাধাগ্রস্ত হয়েছে মাত্র বিভিন্ন সময়ে।মুল কারণ মোদাচ্চের হোসেনের আর্থিক দীনতা।পনের হাজার টাকার একটি চাকুরি করে সে।তা দিয়ে পাঁচ জনের সংসার পরিচালনা করা ঢাকা শহরের মত স্থানে খুবই কষ্ট সাধ্যের ব্যপার।তাছাড়া তিনটি মেয়েই স্কুলে যায়।তাদের বেতন ও বই-কলম কেনার টাকা,নিজেদের খাবার ও অন্যন্য খরচ সব মিলে অসম্ভব বিষয়।তাই সুরেলা মাষ্টার্স পাস হওয়ার পরেও সংসার দেখবে বলে আগে চেষ্টা না করলেও এখন বাস্তবে একটা চাকুরি খুজছেন ।সরকারী চাকুরি করার বয়স আগে শেষ হয়েছে ।
বেসরকারি অনেক গুলো কোম্পানিতে চাকুরীর চেষ্টা করে সে ব্যর্থ হয়েছে।প্রথমদিকে ২০-২৫ কোম্পানীতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়ার পর সে গুনতে শুরু করেছে কতবার চাকুরীর জন্য চেষ্টা করছে।উন্নয়নে বাংলাদেশ নামক কোম্পানীতে তার চেষ্টার অর্ধ-শতক পূর্ন হয়েছে।প্রধান বাধা ছিল তার বয়স।সবখানে একটি প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হতো-এতদিন কোন কাজে যোগদান করেননি কেন?বা কেন এতদিন ধরে বেকার আছেন?উন্নয়নে বাংলাদেশের ম্যানেজার তাকে চাকরি দেয়ার ব্যাপারে একটু উৎসাহী.।সুরেলার মৌখিক পরিক্ষা নিয়ে তিনি খুব খুশি হয়েছেন।দ্বিতীয় আবার তাকে ডাকা হয়েছে।ম্যানেজার সুরেলার পরিবার ও আরতিক বিষয়ে দু’একটি ব্যক্তিগত প্রশ্ন করলেন।অতান্ত অমায়িক তার ব্যবহার।সুরেলার হাতে ভিজিটিং ক দিয়ে যোগাযোগ করতে বলেন তিনি।এর পর দিন সুরেলা তার মোবাইল ফোন থেকে তাকে কল দিয়ে যোগাযোগ করলে তার নিয়োগের ব্যপারে ম্যানেজার পুরন আশ্বাস দেন তাকে।
সুরেলাকে Appoinment letter না দিয়ে ম্যানেজার তাকে অফিসে আসতে বলেন এবং আরও বলেন যে,সুরেলার অফিস শুরু হয়েছে।আগামি মাস থেকে তার বেতন হবে।প্রথম ছয় মাস তাকে স্থায়ী করা হবেনা এবং এ সময় টি তার পিরিয়ড হিসেবে গণ্য হবে এবং মাসিক ১৮,২০০ বেতন পাবে সে।সুরেলা অত্যান্ত খুশি হয় তার চাকুরির খবর স্বামীর সাথে শেয়ার করে।স্বামী খুশি হলেও আচকপালে কিছু ভাড়ের রেখা পরে অদৃশ্য কোন ভয়ে হয়ত!
অফিসে সুরেলার কাজ হচ্ছে ম্যানেজারের পাসের চেয়ারে বসে থাকা এবং মাঝে মাঝে দু’একটি ফাইল এগিয়ে দেওয়া।কাজের ধরনটি তার পছন্দ না হলেও ভালো বেতন পাবে বলে সে মানিয়ে নেয়।ম্যানেজার মাঝে মাঝেই আনমনা হয়ে সুরেলার দিকে নি মত অনেক্ষন ধরে চেয়ে থাকে।তা লক্ষ করে সুরেলা কিছু না বললে বুকের ওড়নাকে আরও সাবধানে ঠিক করে নেয়।
এদিকে সুরেলার স্বামী তাকে কি ধরনের কাজ করতে হয় তা জিজ্ঞেস করলে সুরেলা বলে, “কাম তেমন কিছু নেই,মাঝে মধ্যে দু’একটি ফাইল ম্যানেজার কে এগিয়ে দিতে হয়।আর সারাক্ষন অবসর”।“সারাক্ষন অবসর?আর অবসর সময়টুকু কিভাবে কাটাও?মানে যে তুমি বস কোথায়”?হিসেব করে তার স্বামী।স্বামীর অতি সর্তকতা সম্পর্কে বুঝতে পেরে তাকে অযথা ভিত্তিহীন চিন্তা থেকে মুক্ত রাখতে সুরেলা একটু ভিন্নভাবে উত্তর দেয়।এরপরে তার স্বামী –সুরেলার কাজের পরিবেশ নিয়ে আর কোনদিন জিজ্ঞাসা করেননি।বেশ চাপা স্বভাবের ব্যক্তি তিনি।পাহাড় সম বেদনা অন্তরে থাকলেও মুখে তার লেশ মাত্র ফুঠে উঠে না কখনো।
প্রায় সারাক্ষন সুরেলাকে অবসর সময় কাটাতে হয় বলে তার তেমন একটা ভালো লাগেনা।ব্যস্ততা তার কাছে যেন আর্শিবাদ।আর অবসর বা কাজ হীনতা এর উল্টে।বিষয়টি ম্যানেজার বুঝতে পেরে সুরেলার টেবিলে একটা কম্পিউটার ব্যবস্থা করেন।যেখানে কিছু হিন্দু বাংলা রোমান্টিক গান সরবরাহ করে সুরেলাকে অবসর সময়টুকু কাটাতে বলেন তিনি।মাঝে মধ্যে তিনি নিজের কাজ ভুলে যেয়ে কম্পিউটারে পরদায় চোখ জিইয়ে রাখেন।কখনো কখনো সুরেলা বলে,স্যার,আপনার অনেক কাজ পড়ে আছে।আর আমি এমন গান দেখতে পছন্দ করিনা।আমার জন্য এ সব লাগবেনা।কম্পিউটার বরং সরিয়ে নিন।আপনার কাজে মনোযোগ বাড়বে।“উত্তরে ম্যানেজার বলেন,”কাজ অবশ্যই গুরুত্বপূর্ন।কিন্তু জীবন কাজের চেয়েও বেশি গুরুত্বপুর্ন।এইত জীবনের চেয়ে কাজ কে বেশী গুরুত্ব ভাবার কারণেইত তোমার ভাবি আমাকে ছেড়ে চলে গেছে।অথচ তার জন্যেই কাজ কে বেশী গুরুত্ব দিতাম।“বলতে বলতে চোখের কোনে পানির ফোঁটা মুচেন ম্যানেজার।
দু মাস পার হয়ে তৃতীয় মাসে সুরেলার চাকুরির বয়স হচ্ছে।বেতন পেয়েছে ঠিক ভাবে।আগে যদিও জানত যে অনেক বেসরকারী কোম্পানিতে বেতন ঠিক পাওয়া যেত না।কিন্তু তার বেলায় এ রকম ঘটেনি।এত দিনেও সে এই অফিসের প্রকৃত কাজ কি-তা বুঝতে পারে নাই।ম্যানেজার তাকে মাসাট বদ্ব ফাইল দিতে বলেন,আবার মাসাট বদ্ব করে ফেরত দেন।ভেতরে কি লেখা থাকে তা পড়ার সুযোগ ও ইচ্ছা কোনটায় হয়না সুরেলার।তৃতীয় মাসের শেষ দিকে ম্যানেজার তাকে ধমকে বলে,কাল থেকে আপনাকে আর অফিসে আসতে হবেনা।“উল্লেখ্য-,পূর্বে ম্যানেজার তাকে কখনো আপনি বলেন নাই।এ শুনে সুরেলা যেন আকাশ থেকে পরে।আটার হাজার টাকা বেতন দিয়ে সে তার সংসারে অনেক কিছু করতে পারত।মেয়েদের এটা-ওটা কিনে দেওয়া,স্বামীকে কোন গিফট দেওয়া,নিজের জন্য কিছু কেনা,সংসারে কাজে ব্যয় করা,।।তদপুরি মাসে দশ হাজার টাকা করে জমানো……ভালই চলছিল তার।দু মাসে বিশ হাজার টাকা জমা হয়েছে।মেয়েদের মনেও একটা আশা জাগ্রত হয়েছে যে তাদের মা তাদেরকে এটা-ওটা কিনে দিতে পারে।দু তিন মিনিট পরে সে ম্যানেজারের কাছে জানতে চায়,”স্যার আমার দোষ টা কি?কি কারনে,হঠাৎ করে আমার চাকরি চলে যাবে?আর আমাকে আপনি বা কেন হঠাৎ আপনি থেকে তুমি বলছেন?” এ শুনে ম্যানেজার আরও ক্ষিপ্ত গলায় বলেন,”আপনার কোন দোষ নেই।সবদোষ আমার।এক্ষুনি অফিস থেকে বের হয়ে যান।আর শুনুন,আপনার আগামী মাসের বেতন হবেনা।“বলেই তিনি অফিস থেকে বের হয়ে যান।পিয়ন তার রুমে তালা দিয়ে দিলে সুরেলা বাসায় চলে আসে,বাসায় আসতেই মেয়েরা নানান রকম আবদার করে বসে।বড় মেয়ে মৌটুসি বলে,মা এবার আমকে একজোড়া নুতন সু কিনে দিবে।মেঝ মেয়ে বলে,মা আমার কিন্তু নুতন জামা চাই,এবার ছোট্রটা বলে,মা আমার কোন খেলনা নেই।পাশের বাসার খুকুর অনেক খেলনা।ও আমাকে ওর খেলনা ধরতে দেয় না।“ইত্যাদি শুনে সুরেলা যেন আরও আসহায় ফিল করছে।মনে মনে ভাবল পরদিন ম্যানেজারের পা ধরে ক্ষমা চাইবে কোন বেয়াদবি হলে।
না তা করতে হয়নি সুরেলার।উল্লেখ্য ম্যানেজার তার ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনে কল দিয়ে তাকে সরি বলেছেন।
সুরেলা অফিসে উপস্থিত হয়ে কিচুক্ষন আগেই ম্যানেজার বললেন, “হ্যালো সুরেলা,গতকাল আমার মাথা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।হঠাৎ করে মনে হচ্ছিল তোমাকে জড়িয়ে ধরে অনেক আদর করি।কিন্তু তোমার অনিচ্ছায় কিছু করতে চাইনা।বলেই কোন মিন ক্রিয়েট না করে তোমার উপর রাগ করেছি।আমার অন্যায় হয়েছে”।কথা গুলু শুনে সুরেলা আরও আশরযনিত হলো এবং তীব্র ঘৃনা অনুভব করছে ম্যানেজারের উপর।একদিকে এই ঘৃনা অন্যদিকে মেয়েদের বায়না-সুরেলাকে দ্ব্যর্থবোধের সর্বোচ্চ সীমা ফেলে দিয়েছে।
তৃতীয় মাসের বেতন সুরেলা পাইনি।তবুও সে অফিসে আসছে।মেয়েদের বায়না গুলুকে প্রতিনিয়ত তারা স্বরণ করে দিচ্ছে।মাসের ১০ তারিখে চলে যাওয়ার পর তাদের বায়না আরও বেগতিক হয়ে গেছে।১৫ তারিখের পর আর কেউ কিছু বলছেনা।বায়না উঠিয়ে নিয়েছে-এমন না বরং মায়ের উপর অভিমান করেই তারা এ বিষয়ে আর কিছু বলছেনা।সুরেলা আড়াল থেকে একদিন শুনতে পায় বড় মেয়ে অন্য দুজন কে বলছে, “মা এখন থেকে দশ হাজারের জায়গায় পনের হাজার টাকা করে ব্যাংকে জমাবে।তাই আমাদের চাওয়া পুরণ হবেনা কোনদিন”।দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে চোখ দিয়ে সুরেলার।
এতদিন সুরেলা অফিসে শুধু গিয়েছে আর এসেছে।ম্যানেজারের সাথে একটি কথাও নিজ থেকে বলেন নি।তার অরদার শুনেছে,কুশলাদি জিজ্ঞাসা করলে উত্তর দিয়েছে।কিন্তু নিজেই কিছু জিজ্ঞেস করেন নি।আকাশ ভরা ঘৃনা তার উপর যে!আজকে সুরেলা ব্যক্তিগত প্রথা ভেঙ্গে ম্যানেজার কে জিজ্ঞেস করে, “স্যার কি করলে আমি আমার বেতন পাব?” উত্তরে ম্যানেজার বলেন, “সুরেলা,আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি।দীর্ঘদিন তোমাকে দেখতে দেখতে তোমার জন্য প্রচন্ড একটা ভালোবাসা তৈরি হয়েছে আমার মনে।তুমি চাইলেই আমি তোমাকে বিয়ে করবো।এতে লোকে আমাকে মন্দ বলবে।কিন্তু তোমার মর্যাদা বরং আরও বাড়বে”।……শেষ না করতেই সুরেলা নিজ অবস্থান ভুলে গিয়ে ক্ষপাত এক চড় বসায় ম্যানেজারের গালে।
চড় খেয়েও ম্যানেজার আরও শান্ত হলেন।কিছু বললেন ও আর।রাত ৯তার দিকে সুরেলার ফনে একাদিক কল দেখে তার সামি-কল রিসিভ করতে বলে।সুরেলা ফোন রিসিভ করে, “সুরেলা,আমাকে ক্ষমা করে দাও।তোমার মাসের বেতন আমার কাছে জমা আছে।যখন পার এসে নিয়ে যাবে।আর অফিসে নিয়মিত এসো।জব এটা continue কর……।বিন্দু পরিমাণ ভাল লাগেনি কথাগুলু সুরেলার।তার স্বামী বলে, “অফিসে কি-কোন সমস্যা?মেয়েরা তাদের বায়নার কথা আমাকে বলছে।তুমি নাকি ওদের কোন বায়নাই রাখছনা,আর বেতনের টাকা দিয়ে কি করছো”?
“না কোন সমস্যা নয়।বেতন ঠিক জায়গাতেই জমা আছে”।বলে শেষ করে সুরেলা।
পর দিন সুরেলা অফিসে গিয়ে ম্যানেজারকে বেতনের কথা বললে ম্যানেজার শুরু করেন, “ছয় মাসে তুমি নিয়মিত অফিসে না আসলেও তুমি পুরো বেতন পাবে এমন কি এর পর সারাজীবন অফিসে না আসলেও বেতন পাবে”।………
অফিসে না এসে বেতন নেওয়ার ইচ্ছা আমার নেই।কিন্তু আমি ত আপনার প্রস্থাবে রাজি হতে পারিনা”।–সুরেলা বলে।
সেটা তোমার ব্যাপার। আমি জোর করবো না।ভেবে দেখ……”এক সেকেন্ড দেরি না করে সুরেলা বাসায় আসে।ছয় মাসের বেতন এক সাথে পেয়ে মেয়েদের জন্য অনেক কিছু নিয়ে আসবে বলে মনস্থির করছিল সে।কিন্তু সবই ধুলিৎসাত হয়ে যায়।রাতে ম্যানেজার ফোনে কল দেন।রিসিভ না করতে তিনি এসএমএস পাঠান।লেখা আছে, “আমাকে সারাজীবন ভালবাসতে হবে এমন তো কথা নেই।কিন্তু দু একবার তো ভালবাসতে পার।আর তা না হলে ছয় মাসের বেতনের কথা ভুলে যাও”।ম্যানেজারের আসল রুপ প্রকাশিত হয়।
সুরেলার মনে বিদ্রোহ জেগে উঠে।কিভাবে সমাজের এই নরপশুদের শায়েস্তা করা যায়।একদিন মন স্থির করে শাস্তি তাকে দিতেই হবে।ম্যানেজারের নাম্বার ডায়াল করে সুরেলা বলল “স্যার আমি আপনার প্রস্তাবে রাজি।কোনদিন আসবো?শুধু একবারই ডাকবেন।সাথে ছয় মাসের বেতন সাথে রাখবেন”……
ম্যানেজারের উলঙ্গতার সুযোগে এক ফাঁকে সুরেলা তার পিঠে ছুরি বসিয়ে দেয়।হত্যার দায়ে পুলিশ তাকে আটক করলে সুরেলা মোবাইলে ম্যানেজারের এসএমএস দেখলেও তাকে যাবৎজীবন কারাদন্ড থেকে কেউ রক্ষা করতে পারেনি……………।
Discussion about this post