কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে নিহত ছাত্রলীগ নেতা কাজী খালিদ সাইফুল্লাহ’র বাবা দাউদকান্দি আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের ধর্মীয় শিক্ষক জয়নাল আবেদীন বলেছেন, তিনি কারো কাছে ছেলে হত্যার বিচার চাইবেন না এবং ছেলে হত্যার বিষয়ে কোন মামলাও দায়ের করবেন না। তিনি অভিযোগ করে বলেন, বিচার কার কাছে চাইবো ? বিশ্ববিদ্যালয়টিতে যারা মানুষ গড়ার কারিগর তারা জানে আমার ছেলেকে কারা হত্যা করেছে। অথচ তারা দেড় শ’ অজ্ঞাতনামাকে আসামী করে মামলা করেছে। অথচ যে মেরেছে, যে গুলি করেছে তার নাম জেনেও বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষ তার নামে মামলা করেনি।
বুধবার বিকালে দৈনিক কুমিল্লার কাগজকে এ সব কথা বলে কেঁদে উঠেন জয়নাল আবেদীন । কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, কোন বিচারকের কাছে বিচার চাইবো ? বিচার চেয়ে লাভ কি ? জয়নাল আবেদীনের বাড়ি কুমিল্লার দাউদকান্দির তুজারভাঙ্গা গ্রামে। তিনি দাউদকান্দি থানা মসজিদের ইমাম। জয়নাল আবেদীন জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা জানে এবং বহু ছাত্রের উপস্থিতিতে আমার ছেলেকে বিপ্লব পিস্তল দিয়ে মাথায় গুলি করে হত্যা করেছে। এ কথা ছাত্র-শিক্ষক সবাই জানে। অথচ মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষকরা ১৫০ জন অজ্ঞাতনামাকে আসামী করে মামলা করেছে।-বুঝেন না ? আমার ছেলের হত্যাকারী হলো বিপ্লব, তার নাম মামলায় নেই! উনারা বিচার করতেছে ? শিক্ষক জয়নাল আবেদীন বলেন, মানুষ গড়ার কারিগররা ভালো হলে মানুষ তৈরি হয় আর এখন ‘অস্ত্র কারিগর’ তৈরি হয়। তিনি বলেন, ছেলেটাকে ঢাকা কলেজ থেকে পাশ করিয়ে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে দিয়েছিলাম। ছেলেটা মেধাবী ছিল। জীবনে অনেক স্বাদ ছিল। আর কারো কাছে বিচার চাইতে যাবো না। তিনি কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেন, আপনারা কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ ছাত্রী সোহাগী জাহান তনুর হত্যার বিচারের জন্য সোচ্চার ছিলেন না ? বিচার কে পেয়েছে তনুর পরিবার ? আপনি ফোন করেছেন আপনাকে ধন্যবাদ। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের ৪র্থ বর্ষের ছাত্র বিপ্লব চন্দ্র দাস। বাড়ি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে শালবন বিহারের পাশে অবস্থিত বৌদ্ধ বিহারের পিছনে টিপরা পল্লীতে। বাড়ির কাছে বিশ্ববিদ্যালয় হলেও সে ক্লাস করতো না। একই বছরে দুইবার ফেল করেছে বিপ্লব। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ি দুই বার ফেল করলে তার ছাত্রত্ব বাতিল হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু গত এক সপ্তাহ হলো সে আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, তাকে নিয়মিত করতে বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট, একাডেমিক কাউন্সিল ও মার্কেটিং বিভাগ এক যোগে কাজ করেছে। মার্কেটিং বিভাগ থেকে তার ছাত্রত্ব ফিরিয়ে দিতে তৃতীয় বার পরীক্ষা নিতে একাডেমিক কাউন্সিলে আবেদন জানানো হয়। সে আবেদন যায় সিন্ডিকেটে। সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্তে বিপ্লব চন্দ্র দাসের জন্য আয়োজন করা হয় তৃতীয় বারের পরীক্ষা। যেখানে বিপ্লব চন্দ্র দাস একাই পরীক্ষার্থী। অথচ সে পরীক্ষায় বিপ্লব পাশ না করলেও ৪০ এর মতো নাম্বার দিয়ে তাকে পাশ করিয়ে প্রমোশন দেয়া হয়। এখনো সে ক্লাসে যায় নি এবং হলেও উঠে নি। ছাত্রলীগের রাজনীতি করার কারনেই সে এ সুবিধা পেয়েছে বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সূত্রগুলো জানিয়েছে। সূত্র জানায়, ১ আগষ্ট প্রথম প্রহরে যখন সংঘর্ষ শুরু হয় তখন বিপ্লব টিভি রুমে গিয়ে প্রথমে বুকে পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করার চেষ্টা করে লোক প্রশাসনের ছাত্র মাসুদুর রহমানকে। কিন্তু পিস্তল থেকে গুলি বের না হওয়া সে বেঁচে যায়। পরে কাজী খালিদ সাইফুল্লাহকে মাথায় গুলি করে। জানা গেছে, বিভিন্ন সময় বিপ্লব চন্দ্র দাস বিভিন্ন গ্রুপের ( মাসুম গ্রুপ, ইলিয়াস গ্রুপ) হয়ে কাজ করলেও সর্বশেষ সে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি নাজমুল হাসান আলিফ ও সাধারণ সম্পাদক রেজা ই ইলাহি গ্রুপের হয়ে কাজ করে। এ বিষয়ে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মো: আলী আশ্রাফের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, বিপ্লব চন্দ্র দাসের বিষয়টি তিনি জানেন না। চার বছরের কোর্সের জন্য ছয় বছর আমরা ‘এলাও’ করি। ছয়টি একাডেমিক ‘ইয়ারই এলাও’ করা হয়। এর মধ্যে পুনরায় ভর্তি হতে পারে। বিপ্লবের বিষয়টি বলতে পারবো না। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তদন্ত কমিটি করে দেওয়া হয়েছে। তারা তদন্ত কাজ শুরুও করেছে। তদন্ত করে নিশ্চয়ই তারা এ বিষয়ে মতামত দেবে। তিনি ঘটনার সময় উপস্থিত ছাত্রদের সহযোগিতা কামনা করে বলেন, ঘটনার সময় যারা উপস্থিত ছিল তারাইতো পুরো ঘটনা দেখেছে। মামলা হয়েছে। পুলিশ ও ডিবি তদন্ত করে দেখছে। নিহত ছাত্র কাজী খালিদ সাইফুল্লার বাবা শিক্ষক জয়নাল আবেদীনের অভিযোগ প্রসঙ্গে উপাচার্য প্রফেসর ড. মো: আলী আশ্রাফ বলেন, ঘটনার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বা কর্মকর্তা কেউ তো সেখানে ছিল না। ঘটনা ঘটার পরে খবর পেয়ে তারপর সবাই সেখানে যায়। আমরা কিভাবে বলবো কে হত্যা করেছে। এ জন্যই তো তদন্ত কমিটি। এ জন্যই মামলা করা। অপর দিকে ছাত্রলীগ নেতা কাজী খালিদ সাইফুল্লাহকে হত্যার ঘটনায় দায়ের করা মামলা গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছে গোয়েন্দা পুলিশ। ছাত্রলীগের দুইটি গ্রুপের পক্ষ থেকে পাওয়া তথ্যের সাথে মিলিয়ে দেখা হচ্ছে নিরপেক্ষ সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যও। বিপ্লবের বিষয়টিও গুরুত্ব দিয়ে দেখছে তদন্ত কর্মকর্তারা। পালিয়ে বেড়ানো বিপ্লবকে ধরতে পারলে খুলে যাবে ঘটনার জট। এমনটাই মনে করছেন তারা। এ দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাব বিস্তার, ঠিকাদারি, নিয়োগ, ছাত্রত্ব ফিরিয়ে দেয়া এবং কোন কোন ছাত্রাবাসে মাদকের আখড়া সব বিষয়ে তদন্ত হওয়া উচিত বলে মনে করছেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা। কেন না ছাত্রলীগ নেতা কাজী খালিদ সাইফুল্লাহ হত্যার ভিত্তি তৈরি হয়েছে এ সব থেকেই এমনটা মনে করেন অনেকে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের এসআই শাহ কামাল আকন্দ জানান, সব ধরনের তথ্য সামনে রেখে নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে তদন্ত কাজ চলছে। হত্যাকারীকে কোন ছাড় দেয়া হবে না। এ দিকে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে ছাত্রলীগ কাজী খালিদ সাইফুল্লাহ নিহত হওয়ার মামলায় গ্রেপ্তার ৬ জনকে একদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন কুমিল্লার আদালত। বুধবার দুপুরে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ৫ দিনের রিমান্ড চাইলে কুমিল্লার সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নাজমুন নাহার সুমি এক দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। ডিবির অফিসার ইনচার্জ মনজুর আলম এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেছেন, বৃহস্পতিবার তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃতদের জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শাহ কামাল আকন্দ জানান, ঘটনার পর আটককৃতদের মধ্যে ছয়জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। রিমান্ডে নেয়া যাদের নেয়া হয়েছে তারা হলেন, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি, বিবিএ ৩য় বর্ষের ছাত্র ও কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের চান্দিশকরা গ্রামের পরশ চন্দ্র দেবনাথের ছেলে ও রুপম চন্দ্র দেব নাথ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক ও সিলেটের সাজেদ বাগিরঘাট গ্রামের আবদুল বাতেনের ছেলে গণিত বিভাগের ৪র্থ বর্ষের ছাত্র রেজাউল ইসলাম মাজেদ, ইংরেজি বিভাগের ছাত্র ও কুমিল্লার দেবিদ্বারের বিষ্ণপুর নোয়াপাড়া গ্রামের জহিরুল আলমের ছেলে জাহিদুল আলম জুয়েল , লোক প্রশাসন বিভাগ মাস্টার্স শেষ বর্ষের ছাত্র কক্সবাজার জেলার কুতুবদিয়ার আবদুস সাত্তারের ছেলে আবুবকর ছিদ্দিক, বিবিএ শেষ বর্ষের ছাত্র ও চট্টগ্রামের মীরশ্বরাইয়ের দূর্গাপুর গ্রামের মৃত বিমল নাথের ছেলে সুদীপ্তনাথ , নৃ-বিজ্ঞান ৩য় বর্ষের ছাত্র ও মাগুরা সদর উপজেলার সাতদোহা পাড়া গ্রামের কার্তিক চন্দ্র বিশ্বাসের ছেলে সজন বরণ বিশ্বাস । জানা গেছে, গ্রেপ্তারকৃতরা কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের বহিস্কৃত নেতা ইলিয়াস হোসেন সবুজ গ্রুপের নেতা। কুমিল্লা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (দক্ষিণ) আবদুল্লা আল মামুন জানান, মামলার তদন্তে কোন গ্রুপ দেখা হচ্ছে না। যারা ঘটনার সময় সক্রিয় ছিল তাদের বিষয়টি প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। |
সুত্র দৈনিক কুমিল্লার কাগজকে |
Discussion about this post