কোন দুঃখে ভারতের উৎসব হতে যাবে, এটা নচ্ছার আইপিএল উৎসব

8
VIEWS

বিডি ল নিউজঃ আইপিএল নিয়ে বিশেষ ব্যতিক্রমী লেখা আনন্দবাজারের জন্য নয়াদিল্লি থেকে লিখলেন কীর্তি আজাদ। cheerleaders

রাস্তা থেকে ফ্লাইট, সর্বত্র লোকে আমাকে বার বার একটা প্রশ্ন করছেন। এই ‘ইন্ডিয়া কা তেওহার, আইপিএল’ বস্তুটা নিয়ে আমার মতামত কী?

প্রথমেই সততার সঙ্গে কবুল করে নিচ্ছি, টোয়েন্টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট ব্যাপারটা আমার ঠিক মাথায় ঢোকে না।

আর তার চেয়েও কম বুঝি এখনকার এই আইপিএল টুর্নামেন্টটাকে। যেখানে জীবনে যাঁদের মদ ছুঁতে দেখিনি, তাঁরাও পান করেন। চিয়ার গার্লরা ক্রমাগত নেচে যায়। ব্যাটসম্যানরা তাদের সুপার ব্যাটের শাসনে বলকে বেদম পেটায়। আর কাঁধ ঝুঁকে পড়া বোলার ক্লান্ত শরীরটাকে কষ্ট করে টেনে বোলিং লাইন আপে নিয়ে যায় পরের ডেলিভারিতে আরও মার খাওয়ার প্রস্তুতিতে। আইপিএলের কোচ আর ক্যাপ্টেনরা আপাতদৃষ্টিতে উদ্ভাবনী শক্তি খরচ করে সেই সব অসাধারণ স্ট্র্যাটেজি তৈরি করেন যা দিয়ে ম্যাচ হারা যায়। কারণ এই টুর্নামেন্টে জয়ের চেয়েও হারটা বেশি মূল্যবান!

মানে বলতে চাইছি, আইপিএল নিয়ে আমি সত্যিই চরম বিভ্রান্ত!

গত বৃহস্পতিবারের দিল্লি বনাম চেন্নাই ম্যাচটাই ধরুন। শেষ বল পর্যন্ত রক্তচাপ বাড়ানো টানটান উত্তেজনা। দেখে মনে হবে কী হাড্ডাহাড্ডি লড়াইটাই না হল! অথচ প্রতিবারের মতো এই ম্যাচটাও দিল্লি সেই হারল। চেন্নাই সুপার কিংসের কাছে মাত্র এক রানে। এ বার ম্যাচের হাইলাইটসের দিকে একটু নজর দেওয়া যাক:

১. দিল্লির টিম হলেও তাতে দিল্লির কোনও প্লেয়ার নেই।

২. টিমের তথাকথিত দুই সেরা ব্যাটসম্যান, যুবরাজ সিংহ আর জে পি দুমিনি ব্যাট করতে নামল যথাক্রমে ছয় আর সাত নম্বরে। কুড়ি ওভারের ম্যাচে টিমের সেরা প্লেয়াররা খেলতে এল চোদ্দো আর ষোলোতম ওভারে।

৩. সাধারণত টিমের সেরা তিন ব্যাটসম্যান তাদেরই বলা হয় যারা দায়িত্ব নিয়ে টিমকে জেতানোর কাজটা করে। এখানে কিন্তু আমরা দেখলাম দায়িত্বটা গিয়ে পড়ল তিন নতুনের ঘাড়ে। আর তাদের ষোলো কোটির সিনিয়র সন্তুষ্ট মনে মাঠের বাইরে থেকে চাপের মুখে ওদের ভেঙে পড়তে দেখে গেল।

৪. টিমের কোচ, গুরু গ্যারি নিজের সেরা ব্যাটসম্যানদের  ম্যাচের শেষ তিন-চার ওভার পর্যন্ত ডাগআউটেই রেখে দেওয়ায় বিশ্বাসী। এই আশায় যে, ততক্ষণে টপ অর্ডারের প্রথম পাঁচ জন খেলার এতটাই দফারফা করে ফেলবে যে কোনও অবস্থাতেই আর জেতার সম্ভাবনা থাকবে না। আইপিএল আটে লাস্ট হওয়ার দৌড়ে থাকতে গেলে জয়টাকে এ ভাবে ধরাছোঁয়ার বাইরে করে ফেলা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ।

৫. অ্যালবি মর্কেল আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে লড়াই চালানো সত্ত্বেও দিল্লি ডেয়ারডেভিলস হৃদয়বিদারক হারের দিকে এগিয়ে গেল। মর্কেল টিমকে নেতৃত্ব দিয়ে জেতানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সেরা ব্যাটসম্যানদের ডাগ আউটে বসিয়ে রাখার ‘স্মার্ট স্ট্র্যাটেজি’ ওকে ম্যাচটা জেতাতে দিল না।

আর এমন একটা ম্যাচ হেরে দিল্লির ক্যাপ্টেন জে পি দুমিনি কী বলল?— ‘‘অবিশ্বাস্য ম্যাচ। খুব ছোট মার্জিনে হেরেছি। ছেলেরা যা খেলল তাতে আমি গর্বিত। ম্যাচটা থেকে আমরা অনেক শিক্ষা নেব। বড় পার্টনারশিপ গড়তে না পারলেও রান প্রায় তুলে দিয়েছিলাম। হাতে আর একটা কী দু’টো বল থাকলে আমরাই জিততাম। আজ জিততে পারলে অবশ্যই ভাল হত। তবে সবে প্রথম ম্যাচ। যে ভাবে খেলেছি, তাতে টিমের মনের জোর বাড়ল। টার্নিং পয়েন্ট আমাদের পার্টনারশিপ গড়ার ব্যর্থতা। আর সে জন্যই রানটা প্রায় ধরে ফেলা  দারুণ সাহসী চেষ্টা।’’

আইপিএল নামের এই অর্থহীন উন্মাদনার মধ্য থেকে এ বার যুক্তি খোঁজার চেষ্টা করা যাক দশ কোটি ক্লাবের এক জনের পারফরম্যান্স নিয়ে একটু কাটাছেঁড়া করে—

দীনেশ কার্তিক:

আইপিএলে দীনেশ কার্তিকের পারফরম্যান্সের আন্দাজ পেতে ওর স্ট্যাটিসটিক্সটা দেখুন।

দীনেশ কার্তিকের কী জাদু আছে?

১০৬ ম্যাচে ৯টা হাফসেঞ্চুরি, মোট ২০৬৬ রান, গড় ২৪। যা দেখার পর যে কোনও সুস্থ বুদ্ধির মানুষই প্রশ্ন তুলবেন, ‘‘দীনেশ কার্তিকের কী এমন জাদু আছে যে পর পর দুই মরসুম আইপিএলের নিলামে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দাম উঠেছে ওর?’’ ২০১৪-র নিলামে কার্তিককে সাড়ে বারো কোটিতে কিনেছিল দিল্লি। এ বার আরসিবি ওর জন্য সাড়ে দশ কোটি খরচ করেছে। কার্তিক আইপিএলের সবচেয়ে অভিজ্ঞ ক্রিকেটারদের এক জন। টুর্নামেন্টের একদম প্রথম মরসুম থেকে দিল্লি, পঞ্জাব আর মুম্বইয়ের হয়ে ১০৬ টা ম্যাচ খেলে ফেলেছে। এ বার আইপিএল আটে বেঙ্গালুরু টিম ওর ‘বিশাল অবদান’-এ উপকৃত হবে। বছরের পর বছর আইপিএলের একটা টিম ছেড়ে আরও চড়া দামে নতুন একটা টিমে যাচ্ছে কার্তিক। কিন্তু প্রশ্ন হল, ও যদি সত্যিই এমন মহামূল্যবান ক্রিকেটার হবে, তা হলে ফ্র্যাঞ্চাইজিরা এক বছর খেলানোর পরেই ওকে ছেড়ে দেয় কেন? হয়তো আইপিএলের আর যে চারটে টিমের হয়ে ওর খেলা এখনও বাকি আছে, সেগুলোতে খেলে ফেলার পর প্রশ্নটার উত্তর পাব আমরা! কে বলেছে— এক জায়গায় থাকতে না পারলে ‘সাফল্য’ আসে না!

উদাহরণ আরও আছে… পাঠান ভাইদেরই ধরুন। একদম ধাঁধাঁর মতো!

ধাঁধাঁ এটাও যে, রাহুল দ্রাবিড়ের মতো ভারতের সর্বকালের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান টেরই পেল না তার টিমে গড়াপেটা চলছে! রাহুল তো এক বছর রাজস্থান রয়্যালসের ক্যাপ্টেনও ছিল। টিমের এতগুলো ছেলে দুর্নীতিতে জড়িয়ে, কিন্তু রাহুলের এক বারও মনে হল না কোথাও কিছু গোলমাল আছে! এর চেয়ে তো দেখি  মনমোহন সিংহও চারপাশে কী চলছে সে ব্যাপারে বেশি ওয়াকিবহাল ছিলেন! কিন্তু রাহুল স্ট্র্যাটেজি তৈরিতে এতই ডুবে ছিল যে, টিমের ক্রিকেটাররা পেল্লাই সাইজের তোয়ালে প্যান্টে পুরে বুকিদের সঙ্কেত পাঠাচ্ছে আর তাদের কথা মতো স্পট ফিক্সিং করছে, অথচ সেটা ধরতে পারল না।

রাজস্থান রয়্যালসের আরও একটা নতুন কেলেঙ্কারি ক’দিন হল বেরিয়ে এসেছে। ওদের এক ক্রিকেটারের চাঞ্চল্যকর দাবি, তাকে নাকি এক জন রঞ্জি ক্রিকেটার এ বারের আইপিএলে গড়াপেটার প্রস্তাব দিয়েছিল। খবরে দেখলাম, ওই ক্রিকেটার বোর্ডের দুর্নীতি দমন শাখার অফিসারদের প্রস্তাব পাওয়ার কথা জানিয়েছে। দুর্নীতি দমন টিম ও নিরাপত্তার আধিকারিকরা ব্যাপারটা আরও খতিয়ে দেখতে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পারেন, প্রস্তাব যে দিয়েছিল সে মুম্বইয়ের বাসিন্দা আর ওই ক্রিকেটারেরই রঞ্জি টিমমেট। অর্থাৎ রাজস্থান রয়্যালসের আইপিএল আট অভিযান শুরু হওয়ার আগেই ওদের প্লেয়াররা আন্তরিক উৎসাহে নিজেদের ‘উৎসব’ শুরু করে দিয়েছে। আর রাহুল নিশ্চয়ই বরাবরের মতোই ওর পিছনে টিমে কী চলছে সেটা জানে না!

রঞ্জিব বিসওয়ালের জায়গায় যিনি আইপিএলের চেয়ারম্যান হলেন, সেই রাজীব শুক্ল ২০১৩-র স্পট ফিক্সিং কেলেঙ্কারির পর পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন। দায়িত্বটা তখন বিসওয়াল নেন। কিন্তু রাজীব শুক্লকে আবার ফেরানো  হল। এ বার সঙ্গে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় আর রবি শাস্ত্রীকে গভর্নিং কাউন্সিলে রেখে। রাজীব শুক্লর ক্রিকেট প্রশাসনে (বা সে দিক থেকে দেখলে, অন্য কোনও প্রশাসনেই) থাকার যোগ্যতাটা ঠিক কী, সেটা আমার জানা ছিল না। তাই ব্যাপারটা নিয়ে একটু খোঁজখবর করে যা তথ্য পেলাম সেটা এই রকম, ‘‘রাজীব শুক্ল দাবি করেন তিনি ওপেনিং ব্যাটসম্যান ছিলেন এবং এক সময় বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে ক্রিকেটটা খেলেছেন। ক’বছর আগে ব্রিটেন আর ভারতের পার্লামেন্টারিয়ানদের মধ্যে একটা ক্রিকেট ম্যাচ হয়েছিল। যার আগে ভারতীয় টিমে থাকা সাংসদদের দিল্লির জাতীয় স্টেডিয়ামে প্র্যাকটিস করতে দেখা যায়। শুধু তিন বার মনে করানো সত্ত্বেও শুক্ল যাননি। বড় প্লেয়ারদের মাঠে নামার আগে খুব বেশি প্র্যাকটিস লাগে না ধরে নিয়ে কোচ তাঁকে ফাঁকি দেওয়ার অনুমতি দেন। শুক্ল অবশ্য ম্যাচটা খেলা এড়ানোর অনেক রকম চেষ্টা করেও পারেননি। তবে ম্যাচে যতক্ষণ সম্ভব ব্যাট করতে না নেমে ড্রেসিংরুমে বসে ছিলেন। অনেক অনুরোধের পর শেষ পর্যন্ত ম্যাচের দু’ওভার বাকি থাকতে ওঁকে ন’নম্বরে ব্যাট করতে পাঠানো যায়।

প্যাড আর ক্রিকেট গিয়ারে শুক্লকে দেখে খুবই অস্বস্তিতে আছেন বলে মনে হচ্ছিল। উল্টো দিকে বল করছিলেন বয়স্ক এক ব্রিটিশ এমপি। যাঁর বলের রাজকীয় গতি ঘণ্টায় প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার ছিল। প্রথম বলটা ওয়াইড এবং নিরাপদে উইকেটকিপারের গ্লাভসে গেল। কিন্তু আচমকা সবাই ঘুরে দেখলেন শুক্ল উইকেটে পড়ে গিয়েছেন! উদ্বিগ্ন বোলার আর ফিল্ডাররা ছুটে যান। বল শুক্লকে ছোঁয়া তো দূরের কথা, ওঁর কয়েক মাইলের মধ্যেও যায়নি। কিন্তু সম্ভবত ভয়েই হবে, উনি মাথা ঘুরে পড়ে যান এবং গুরুতর জখম হন। কয়েকটা হাড়গোড় ভাঙায় হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়। তাতে অবশ্য শুক্লের ক্রিকেট-প্রেম এতটুকু কমেনি।’’

এমন মহান ক্রিকেটার দায়িত্বে থাকায় আমি নিশ্চিত, এ বারের আইপিএল আগের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়ে আরও জমে উঠবে।

আপনাদের কিন্তু একটা বিষয় আমাকে স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিতেই হবে… ভারতের সর্বকালের অন্যতম সেরা ক্যাপ্টেন আর ক্রিকেটার, আপনাদের নিজেদের প্রিয় ‘দাদা’ কী করে এই রাজীব শুক্লের অধীনে কাজ করছে? সৌরভের মতো মহান ক্রিকেটারকে এই সার্কাসে যুক্ত থাকতে দেখে ভীষণ অদ্ভুত লাগছে!

আবার হতে পারে আমিই হয়তো বড্ড বেশি সেকেলে হয়ে গিয়েছি। কিংবা বড্ড বেশি সরল!

আইপিএলওয়ালারা পরিকল্পনা করে ক্রিকেটটাকে সোপ অপেরা করে তুলতে চায়। এই চেষ্টার তীব্র প্রতিবাদ করছি। ক্রিকেট খেলাটার চেয়ে বড় মঞ্চ আর কী আছে? তাকে অতিনাটকীয় সোপ করে তোলার কোনও দরকার নেই!

‘ইন্ডিয়া কা তেওহার,’ এই ক্যাচলাইনটাতেও আমার ভীষণ আপত্তি। ভারতের ‘তেওহার মানে এ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা নানান উৎসব— দিওয়ালি, ঈদ, বৈশাখী, ক্রিসমাস, দসেরা। স্পট ফিক্সিং, শ্লীলতাহানি, কারও কলার চেপে ধরার মতো ঘটনাগুলোকে  ভারতের উৎসব বলা চলে না!

এ সব নচ্ছার কাণ্ডকারখানা কোন দুঃখে ভারতের উৎসব হতে যাবে? এগুলো শুধুমাত্র আইপিএলের উৎসব। সঠিক ক্যাচলাইনটা তাই ‘আইপিএল কা তেওহার’। ঈশ্বরের দোহাই, ওটা শুধরে নিন!

সৌজন্যে আনন্দবাজার পত্রিকা

Next Post

Discussion about this post

নিউজ আর্কাইভ

May 2024
S S M T W T F
 123
45678910
11121314151617
18192021222324
25262728293031

Welcome Back!

Login to your account below

Retrieve your password

Please enter your username or email address to reset your password.