একে.এম নাজিম, চবি প্রতিনিধিঃ পরিবেশ দূষণের অজুহাত তুলে পবিত্র ঈদুল আযহায় মুসলমানদের ঘরে ঘরে পাড়া-মহল্লায় কোরবানী দেওয়ার চিরাচরিত ইসলামী ঐতিহ্য বন্ধ করে এর পরিবর্তে সুনির্দিষ্ট জায়গায় পশু কোরবানি দেওয়া এবং নিবন্ধিত লোকের মাধ্যমে পশু জবাইয়ের বিধি জারির সরকারী উদ্যোগে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে এটাকে দেশ থেকে ক্রমান্বয়ে ইসলামী সংস্কৃতি ও চেতনাবোধ মুছে ফেলার ধারাবাহিক ষড়যন্ত্রের অংশ বলে মন্তব্য করেছেন হেফাজতে ইসলামের আমীর হাটহাজারী মাদ্রাসার মহাপরিচালক শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফী। তিনি হতাশা প্রকাশা করে বলেন, সুপরিকল্পিতভাবে দেশে একদিকে নগ্নপনা, বেহায়াপনাসহ ক্ষতিকর সংস্কৃতির বিকাশ ঘটানো হচ্ছে, অন্যদিকে ইসলামী সংস্কৃতিকে হেয় প্রতিপন্ন ও সংকোচনের অপতৎপরতা চালানো হচ্ছে।
হেফাজত আমীরের প্রেসসচিব মাওলানা মুনির আহমদ স্বাক্ষরিত গতকাল (৮ সেপ্টেম্বর) বিকেলে সংবাদপত্রে দেওয়া বিবৃতিতে তিনি আরো বলেন, শুধু পাড়া-মহল্লা থেকে কোরবানীর সংস্কৃতিকে সরিয়ে দেওয়া নয়, যানজটের অজুহাত খাড়া করে পশুর হাটে নিয়ন্ত্রণ আরোপের মাধ্যমে কোরবানী দাতাদের জন্য পশু ক্রয়েও সংকট তৈরীর ষড়যন্ত্র চলছে। তিনি বলেন, কুরবানীর দিন জনসাধারণকে পশুবর্জ্য সুনির্দিষ্ট জায়গায় ফেলার জন্য উদ্বুদ্ধ করে ব্যাপক প্রচারণা চালানোর পাশাপাশি সিটি কর্পোরেশন পশু বর্জ্য অপসারণে কুরবানীর দিন বাড়তি জনবল নিয়োগ দিতে পারত। অথচ সিটি কর্পোরেশনকে রাস্তা মেরামত, নালা-নর্দমা পরিষ্কার ও জলাবদ্ধতা নিরসনের চেয়েও কুরবানীর ঐতিহ্যবাহি সংস্কৃতি সংকোচনেই উৎসাহি দেখা যাচ্ছে। তিনি সরকারের প্রতি শত শত বছর ধরে চালু থাকা ইসলামী নিদর্শন পবিত্র কুরবানীর ঐতিহ্যবিরোধী এই উদ্যোগ বন্ধ করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, এতে করে সরকার বিরুদ্ধে জনগণের মনে মারাত্মক ক্ষোভ ও প্রতিক্রিয়া তৈরী হতে পারে।
বিবৃতিতে হেফাজত আমীর আরো বলেন, একদিকে শহুরে ধনিক শ্রেণীর পান্তা-ইলিশের ক্ষতিকর সংস্কৃতির প্রসার ঘটানোর নানা উদ্যোগ নিয়ে দেশের ৮০-৯০ ভাগ গরীব ও সামর্থহীন জনগণকে উপহাস ও অসহায়ত্বের কথা মনে করিয়ে দেওয়ার চর্চা চলছে, অন্যদিকে পবিত্র কুরবানীকে উপলক্ষ্য করে বেকার পরিবারে গরু পালন, গরুর বেচা-বিক্রির সাথে গরীব মানুষের সম্পৃক্ততা, ঈদের দিন গরীব-মজদুরদের উচ্চ বেতনে কামলা খাটা থেকে শুরু করে কুরবানীর গোস্ত বিলি-বণ্টন, কোরবানীর পশুর চামড়া বিক্রির মূল্য দানসহ সবক্ষেত্রেই গরীবদের জন্য উপকারি সার্বজনীন মুসলিম সংস্কৃতির পবিত্র বুরবানীকে নানাভাবে বাধাগ্রস্ত ও সংকোচিত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে গরীবদের স্বার্থে আঘাত হানা হচ্ছে। ইতিমধ্যেই নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ কুরবানী নিয়ে সরকারের এমন উদ্যোগে কুরবানী দাতাদের নানা সমস্যার মুখোমুখি হওয়ার পাশাপাশি গরীবরাই সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বলে আশংকা প্রকাশ করা হচ্ছে। তাছাড়া উদ্ভুত সমস্যার কারণে ভবিষ্যতে অনেকেই কুরবানীর প্রতি উৎসাহ হারাতে পারেন বলেও আশংকা প্রকাশ করা হয়েছে। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, সরকারের কাজ কি শুধু ধনী মানুষের স্বার্থ রক্ষা করা?
পরিবেশ দূষণের প্রসঙ্গ টেনে হেফাজত আমীর বলেন, পরিবেশ দুষন! রাজপথ মাসের পনের দিন মল-মূত্র ও ময়লা-আবর্জনা মিশ্রিত পানিতে ডুবে একাকার হয়ে থাকলেও সিটি কর্পোরেশনের কার্যকর তৎপরতা দেখা যায় না। অথচ গরীবদের জন্য অত্যন্ত উপকারী এবং মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধের বহিঃপ্রকাশের এই মহান সংস্কৃতির দিনেই তারা পরিবেশ দূষণকে বড় করে দেখাতে চায়।
হেফাজত আমীর বলেন, পবিত্র কুরবানীর মাধ্যমে গভীর আত্মত্যাগের পাশাপাশি মুসলমানদের ধনী-গরীব, ফকীর-মিসকীনদের মধ্যে যে গভীর সহমর্মিতা, আত্মীয়তার মজবুত বন্ধন ও ঐক্যের সংস্কৃতির চর্চা হয়, তাতে ইসলাম বিদ্বেষী চক্র চরম অস্বস্তিতে ভোগেন। এ কারণে বহু পূর্ব থেকেই তারা নানাভাবে পবিত্র কুরবানীর বিরুদ্ধে গভীর অপপ্রচার ও চক্রান্তে লিপ্ত।
হেফাজত আমীর বলেন, পবিত্র কোরবানীর পশু জবাইকে কেন্দ্র করে বাড়ীতে বাড়ীতে, পাড়া-মহল্লায় শিশু-কিশোর, নারী-পুরুষসহ ধনী-গরীব মিলে সর্বস্তরের মুসলমানদের মধ্যে এক ধর্মীয় ভাবগাম্ভির্যপূর্ণ আবেগময় ধর্মীয় উৎসব বিরাজ করে থাকে। যারা মাসে, ছয় মাসে একবার পরিবারের সবাইকে নিয়ে ভাল খাবারের আয়োজন করতে পারে না, এমন সব গরীবদের মাঝে বাড়িতে বাড়িতে অকাতরে কোরবানীর গোস্ত বিতরণ করা হয়ে থাকে। এই সংস্কৃতি শিশু-কিশোররা দেখে ভ্রাতৃত্ববোধ ও সহমর্মীতার ইসলামী আদর্শ শিখে থাকে। মাদ্রাসার গরীব ছাত্র বা প্রতিবেশী গরীবদের মাঝে কোরবানীর পশুর চামড়া বিনামূল্যে বা চামড়া বিক্রয়ের টাকা বিতরণ করার সহমর্মীতার সংস্কৃতি দেখে সকলে অভিভূত হয়। গরীব-মিসকীন ছাড়াও আত্মীয়-স্বজনদের মাঝে কোরবানীর গোস্ত বিতরণের মাধ্যমে সহমর্মীতা ও আত্মীয়তার সম্পর্ক আরো গভীর হওয়ার সংস্কৃতির চর্চা হয় পবিত্র কোরবানীর ফলে। এ ধরণের অগণতি কল্যাণকর প্রথা পবিত্র কোরবানীর মাধ্যমে জনসমাজে চালু রয়েছে।
তিনি বলেন, আমার জোরালো সন্দেহ, পরিবেশ দূষণের অভিযোগ ও পরিচ্ছন্নতার লেবেলে ইসলাম বিদ্বেষী নাস্তিক্যবাদি চক্র এবং প্রতিবেশী দেশের ব্রাহ্মণ্যবাদি চক্রের সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্রে প্ররোচিত হয়ে ক্ষমতাসীন মহলের কেউ কেউ এমন পদক্ষেপে উদ্বুদ্ধ হয়ে থাকতে পারেন। ষড়যন্ত্রকারীদের উদ্দেশ্য, পবিত্র কোরবানী উদযাপনে ক্রমান্বয়ে বাজার সংকট, পশু সংকট, গরু জবাইয়ে সমস্যা তৈরী, গরীবদের মাঝে গোস্ত বিলির প্রথা বিলোপ, গরীব মাদ্রাসা ছাত্র ও ছিন্নমূল প্রতিবেশীদের হক কোরবানীর পশুর চামড়া দখলসহ নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরী করে মানুষকে কোরবানীর প্রতি নিরুৎসাহিত করা এবং নির্ধারিত জায়গা ঠিক করে দিয়ে শিশু-কিশোরদেরকে পবিত্র কোরবানীর চিরাচরিত সংস্কৃতি চর্চা থেকে দূরে রেখে ইসলামের এই গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শনকে সমাজ থেকে বিলোপ বা গুরুত্বহীন করে দেওয়া। পাশাপাশি ইন্টারনেট ভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও নাস্তিক্যবাদিদের তল্পিবাহক বিভিন্ন মিডিয়ায় পশুপ্রেম ও পশু-বধের অপপ্রচার চালিয়ে নতুন প্রজন্মকে কুরবানীর প্রতি ভীতশ্রদ্ধ ও নিরুৎসাহিত করা। অথচ এই পশুপ্রেম ও পশুবধের বন্দনা যারা তুলেন, দেখা যায় একদিনের জন্যও বীফ, মাটন ও চিকেন ছাড়া তাদের ডিশ কল্পনা করা যায় না। তিনি বলেন, ইসলামী সংস্কৃতির বিশেষত্ব হচ্ছে, সকল আনন্দে ধনী-গরীব, ফকীর-মিসকীন, আত্মীয়-স্বজনসহ সকলকে শামিল করে নেওয়া। পবিত্র কুরবানীকে কেন্দ্র করে এই একটা দিন দেশের সকল মুসলমানের পাতিলে একই রান্না হয়, ধনী-গরীব সকল শিশুদের মাঝে আনন্দের হিল্লোল বয়ে যায়। এর চেয়ে সুন্দর ও সহমর্মীতাপূর্ণ সংস্কৃতি আর কি হতে পারে?
Discussion about this post