‘আমি তো মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়ে সাজানো অপরাধের দায় স্বীকার করে জেল খাটতে চাইনি। কিন্তু ক্রসফায়ার থেকে বাঁচতে এসপি সাহেবের সাজানো কথা আদালতে গিয়ে বলি। এ জন্যই হয়তো এখনো বেঁচে আছি। আর বেঁচে আছি বলেই ইতিহাসের ন্যক্কারজনক ওই ঘটনার প্রকৃত সত্য বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু প্রাণভয়ে এখনো আত্মগোপনে আছি।’ গতকাল শনিবার কথাগুলো বলছিলেন ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার আলোচিত চরিত্র জজ মিয়া।
জজ মিয়ার গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর সেনবাগে। কিন্তু ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার কারণে ভিটেমাটি ছাড়তে হয় তাকে। পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ সরকার এলে তার চাকরি হয় মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে। কিন্তু তার পরিচয় জানাজানি হলে তিনি চাকরিটি ছেড়ে দেন। বর্তমানে তিনি রাজধানীর কদমতলীর রায়েরবাগ এলাকা ভাড়া থাকেন মা জোবেদা খাতুন ও বোন খোরশেদাকে নিয়ে। এর আগে তিন বছর ছিলেন নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ থানার সাইনবোর্ড এলাকায়।
জজ মিয়া বলেন, ২১ আগস্ট আমি গ্রামের বাড়িতে বাবুলের চায়ের দোকানে ছিলাম। টেলিভিশনে গ্রেনেড হামলার খবর দেখে এলাকার লোকজনের সঙ্গে এ নিয়ে আলাপও করেছিলাম। সে সময় গ্রামের অনেক মুরব্বিও সেখানে ছিলেন। কিন্তু কয়েক দিন পর নোয়াখালীতে থাকা আমিই ওই ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী হয়ে যাই!
তিনি আরও বলেন, ২০০৪ সালে আমি মতিঝিলের শাপলা চত্বর এলাকায় ফল বিক্রি করতাম। মাঝে মাঝে স্টেডিয়াম মার্কেট এলাকায় পোস্টার বিক্রি করতাম। দুই-তিন মাস পর পর বাড়ি যেতাম। কিন্তু ২১ আগস্ট আমি বাড়িতেই ছিলাম। নৃশংস ওই ঘটনার সাত-আট মাস পর আমাকে বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। সে সময় গ্রামের চৌকিদার বাড়িতে এসে বলেন, ‘তোমার নামে থানায় মামলা আছে। থানা থেকে কবির দারোগা আসতেছে। তুমি এখানে বসো।’ এরপর কবির দারোগা এসে আমার হাতে হ্যান্ডকাফ লাগায়। তখন আমার এলাকার জামাল মেম্বার (ইউপি মেম্বার) কারণ জানতে চাইলেও কোনো জবাব দেননি দারোগা। থানায় নেওয়ার পর কবির দারোগা বলেন, ‘তোমার নামে এখানে কোনো মামলা নাই। ঢাকা থেকে সিআইডির এসপি রশিদ সাহেব (সিআইডির তৎকালীন সহকারী পুলিশ সুপার আবদুর রশিদ) আসতেছেন। ঢাকায় তোমার নামে বড় মামলা আছে।’
জজ মিয়া বলেন, ওই রাতে এএসপি রশিদ সেনবাগ থানায় গিয়ে বলেন, ‘কই, জজ মিয়া কই?’ সে সময় থানাহাজত থেকে আমাকে বের করে আনা হয়। একটা নতুন গামছা কিনে এনে আমার চোখ বাঁধা হয়। থানার সব পুলিশ বের করে দিয়ে আমাকে কয়েকজনের নাম ধরে বলে, ‘এদের চিনোস।’ আমি বলি, চিনি না। তখন এএসপি রশিদ বলেন, ‘২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা কইরা পালাইয়া আইছোস।’ আমি বলি, ওইদিন বাড়িতে বাবুলের চায়ের দোকানে ছিলাম। কিন্তু তারা আমার কোনো কথাই শুনতে চাননি।
সাক্ষ্যপ্রদানের কারণ হিসেবে তিনি বলেন, সেনবাগ থানায় এএসপি রশিদ সাহেব আমাকে থানার মধ্যে ব্যাপক মারধর করেন। একপর্যায়ে বলেন, ‘আমাদের কথা না শুনলে তোরে ক্রসফায়ারে দিব। আর কথা শুনলে তোরে বাঁচাইয়া আনব। তোর ফ্যামিলিকে খরচের টাকা দিব।’ মারের চোটে আমার হাতের হাড় ভেঙে যায়। এরপর আমাকে সেনবাগ থানা থেকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। ক্রসফায়ারের ভয়ে তারা যা শিখিয়ে দেন, সেগুলোই আদালতে বলি, স্বীকারোক্তি দিই।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পর ন্যক্কারজনক ওই ঘটনাকে ভিন্নখাতে নিতে জজ মিয়া নাটক সাজায় সিআইডি। ২০০৫ সালের ৯ জুন নিজ বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করা হয় নিরপরাধ মানুষটিকে। দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী বানিয়ে সিআইডির ওই সময়কার তিন কর্মকর্তা ১৬৪ ধারায় তার স্বীকারোক্তি আদায় করেন। বিনিময়ে তার মাকে প্রতি মাসে সংসার খরচের জন্য ২ হাজার টাকা করে দিতেন তারা। এই পুরো ঘটনার নেপথ্য কারিগর ছিলেন সিআইডির তৎকালীন বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমিন, সহকারী পুলিশ সুপার মুন্সি আতিক ও আব্দুর রশিদ।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দ্রুত পরিস্থিতি পাল্টে যায়। উদ্ঘাটিত হয় প্রকৃত ঘটনা। ২০০৯ সালের ২৬ জুলাই নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে জেল থেকে ছাড়া পান জজ মিয়া। কিন্তু ততদিনে ওলটপালট হয়ে গেছে নিরীহ এ মানুষটির জীবন।
এরপর থেকে এখন পর্যন্ত এক রকম আত্মগোপনেই আছেন জজ মিয়া। কারো সঙ্গে তেমন যোগাযোগ করেন না। নিজের পরিচয়ও দেন না সহজে। যে বাসায় ভাড়া থাকেন সেখানকার মানুষও তার প্রকৃত পরিচয় জানেন না। রেন্ট-এ-কারে একটি ভাড়া মাইক্রোবাস চালান তিনি। ছয় বছর আগে বিক্রি করে দিয়েছেন সেনবাগের বীরকোর্ট গ্রামে থাকা সর্বশেষ সম্পদ পৈতৃক ভিটার ৭ শতাংশ জমি। এরপর আর গ্রামে যাননি। গ্রামের মানুষ তার কোনো ঠিকানা জানে না।
ক্ষোভ নিয়ে জজ মিয়া বলেন, সারাবছর কেউ আমার খোঁজ নেয় না। ২১ আগস্ট এলেই আপনারা (সাংবাদিক) আমার খোঁজ নেন। আপনারা আমাকে এই পর্যন্ত বাঁচাইয়া না আনলেই ভালো হতো। ওই মামলায় আমার ফাঁসি হয়ে গেলে বেঁচে যেতাম। এখন অনেক কষ্টে আছি। দেশে এমন কোনো মানুষ নেই যে আমাকে চেনে না। যেখানেই চাকরির জন্য যাই, সবাই ভয়েই আমাকে চাকরি দিতে চান না। এখন বাধ্য হয়ে ভাড়া গাড়ি চালাই। ঢাকা শহরে খাই আর না খাই ঘর ভাড়া তো দেওয়াই লাগে। এই মামলায় আমার ভিটামাটি সব শেষ। আমার অবস্থা এখন ভিক্ষুকের চেয়েও খারাপ।
তিনি বলেন, আমি আপনাদের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে বারবার অনুরোধ করছি আমার দিকে একটু তাকানোর জন্য। আমি তো তার জন্যই মামলা খেয়েছি। প্রধানমন্ত্রী কত মানুষের দিকে তাকান; কিন্তু আমার দিকে একটু তাকান না। আমি আপনাদের মাধ্যমে আবারও অনুরোধ করছি প্রধানমন্ত্রী যেন আমার দিকে একটু তাকান। সূত্র: আমাদের সময়।
Discussion about this post